শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে নারীর অবস্থান

আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অবদানকে ছোট করে দেখা হয়। তাই, সব সময় তারা মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়। বেসরকারি অক্সফামের একটি প্রতিবেদন অনুসারে গত এক দশকে শ্রম বাজারে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ২ কোটির ওপরে বেড়েছে। যার ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী শ্রমিক। আর এদের অধিকাংশই মজুরি বৈষম্যের শিকার। নারীদের বৃহৎ অংশ দেশের প্রধান রপ্তানি বাণিজ্য পোশাক শিল্পে কাজ করেন। জরিপে দেখা গেছে, ৮৪.৭ শতাংশ নারী শ্রমিক পোশাক কারখানায় মৌখিক নির্যাতন বা গালাগালি শিকার হন। ৭১.৩ শতাংশ মানসিক নির্যাতনের, ২০ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের এবং ১২.৭ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হন।
শাকিল আহামেদ সুরোজ
  ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

'বিশ্বের যা কিছু সৃষ্টির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর'।?বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কবিতার মাধ্যমেই সমাজে নারীর ভূমিকা কতটুকু তা বোঝা যায়। শুধু বাংলাদেশ-ই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের ধারায় নারীর উন্নয়ন বা উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ এক অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, লিঙ্গবৈষম্য, উগ্রবাদী শাসন-শোষণ, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, অর্থনৈতিক দৈনদশাসহ নানা বিষয় নারীর ক্ষমতাকে আজ কুক্ষিগত করার পাশাপাশি নারীর অগ্রযাত্রার পথে বাধার সৃষ্টি করেছে। তাই নারীর উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী এসব সমস্যা থেকে নারীর উত্তরণের পথ সুগম করে সমাজের সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণসহ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে প্রতি বছর ৮ মার্চ পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ।

আমরা নারী দিবসের পেছনের ইতিহাস অনেকেই জানি না। আসুন জানা যাক, ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নারীদের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। এ দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের একটি সূচ তৈরি করখানার নারী শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেন। কারখানার মানবেতর পরিবেশ, ১২ ঘণ্টার কর্মসময়, অপর্যাপ্ত বেতন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বিরুদ্ধে তাদের এক প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। কিন্তু পুলিশ এই শান্তিপূর্ণ মিছিলে মহিলা শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন চালায়। বহু শ্রমিককে আটক করা হয়। এই ঘটনার স্মরণে ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ মহিলা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে নিউইয়র্ক সূচ শ্রমিকরা। এভাবেই সংঘবদ্ধ হতে থাকে মহিলা শ্রমিকদের আন্দোলন। এক সময় তা কারখানা ও ইউনিয়নের গন্ডি অতিক্রম করে। ১৯০৮ সালে জার্মান সমাজতন্ত্রী নারীনেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় জার্মানিতে। এই সম্মেলনে নারীদের ন্যায্য মজুরি, কর্মঘণ্টা এবং ভোটাধিকারের দাবি উত্থাপিত হয়। ১৯১০ সালের ২য় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ডেনমার্কের কোপেনহেগে। এতে ১৭টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দেন। এ সম্মেলনেই ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯১১ সালে প্রথম ৮ মার্চ দিবসটি পালিত হয়। ১৯১৪ সাল থেকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে দিবসটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হতে থাকে। ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ দিবসটি পালন করে থাকে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দিবসটি পালনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয় ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এ সময় জাতিসংঘ দিবসটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দিবসটি পালনের আহ্বান জানায়। এর ফলে, অধিকারবঞ্চিত নারী সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির পথ সুগম হয়। নারীর অধিকার রক্ষা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এটি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। বিশ্ব আজ একবিংশ শতাব্দীতে পা রেখেছে; পা রেখেছে এক নতুন সহস্রাব্দে। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বিশ্বে নারী সমাজের অবস্থা কিন্তু মোটেও সুখকর নয়। এটাই সত্য যে, গত তিন দশকে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার নারী সমাজের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু এটা সত্য যে, নারী সমাজের ওই অগ্রগতি কোনো অবস্থাতেই পুরুষ সমাজ কর্তৃক অর্জিত অগ্রগতির সমকক্ষ নয়। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারী সমাজের অবস্থা তো এখনো রীতিমতো আশঙ্কাজনক। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্র্য সীমার নিচে রয়ে গেছে প্রায় ৬০ কোটি নারী। অপরদিকে, উন্নত দেশগুলোতে দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করা নারীদের সংখ্যা কম নয়। ইতালি, নরওয়ে, ফ্রান্স বা সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশেও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নারী দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। বলা বাহুল্য, দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করা নারীদের হার পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। সমগ্র বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নারী-পুরুষের তুলনা করলে বর্তমান বিশ্বে নারীদের অবস্থা আরো স্পষ্ট হবে। বিশ্বের অশিক্ষিত জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ নারী এবং বিশ্বে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী ৭০ শতাংশই নারী। এবার আসি আমাদের দেশের কথায়, আজও আমাদের দেশের নারীরা পুরুষশাসিত সমাজের কাছে অবহেলিত। এ দেশের আর্থসামাজিক পরিবেশে গোঁড়ামি, অসাম্প্রদায়িকতা প্রবল। ফলে নারীর অধিকার লঙ্ঘিত হয় সবচেয়ে বেশি। নারীর সম অধিকার ও নারী মুক্তির কথা জোর গলায় বলা হচ্ছে, কিন্তু নারীর অবস্থানে প্রত্যাশিত পরিবর্তন হয়নি। আজও অসংখ্য নারী এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ ও যৌতুকের শিকার হচ্ছে। আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অবদানকে ছোট করে দেখা হয়। তাই, সব সময় তারা মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়। বেসরকারি অক্সফামের একটি প্রতিবেদন অনুসারে গত এক দশকে শ্রম বাজারে নারী শ্রমিকের সংখ্যা ২ কোটির ওপরে বেড়েছে। যার ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী শ্রমিক। আর এদের অধিকাংশই মজুরি বৈষম্যের শিকার। নারীদের বৃহৎ অংশ দেশের প্রধান রপ্তানি বাণিজ্য পোশাকশিল্পে কাজ করেন। জরিপে দেখা গেছে, ৮৪.৭ শতাংশ নারী শ্রমিক পোশাক কারখানায় মৌখিক নির্যাতন বা গালাগালি শিকার হন। ৭১.৩ শতাংশ মানসিক নির্যাতনের, ২০ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের এবং ১২.৭ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হন। দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ নারী হওয়ায় দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সর্বত্র নারীর জয়জয়কার। দুই দশকে রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, ক্রীড়া এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে সরকারি বেসরকারি ইতিবাচক মনোভাবের কারণে। অর্থনৈতিকভাবে নারী সমাজ অনেক অগ্রসর হয়েছে। অনলাইন ব্যবসায়, কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে জাগরণ হয়েছে ২ দশকে। এ কথা ঠিক, নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে কখনোই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে শুধু নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই যথেষ্ট নয়, কর্মক্ষেত্রে তাদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের শ্রমমূল্য বৈষম্য দূর করা তাই জরুরি। বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে তখন তার সঙ্গে পালস্না দিয়ে নারীরাও সমাজে তাদের অবদানের স্বাক্ষর রাখছে। তাই একবিংশ শতাব্দীতে এসে নারীরা আজ মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছে, জয় করেছেন হিমালয় পর্বত রাজনীতিতেও বেশ শক্ত অবস্থান দখল করেছেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীর পদচারণা বিশ্বকে আরো নতুনত্বে নিয়ে যাবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে