মেয়াদ শেষ হলেও পদ ছাড়তে চাইছে না জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে ওয়ার্ড ইনচার্জরা। আইন অনুযায়ী দুই বছর মেয়াদ হলেও প্রায় দুই ডজন ওয়ার্ডের ইনচার্জরা এ পদে বহাল আছেন বছরের পর বছর। সম্প্রতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের সরিয়ে নতুন ওয়ার্ড ইনচার্জদের নাম প্রকাশ করে নির্দেশনা জারি করলেও কেউ কেউ প্রভাব খাটিয়ে আগের পদেই থাকার চেষ্টা করছেন।
তাদের মধ্যে অন্যতম বিলকিস বেগম। মূলত তিনিই এই সিন্ডিকেটের প্রধান।আওয়ামী সিন্ডিকেটের সরাসরি মদদে এই সিনিয়র স্টাফ নার্স দীর্ঘদিন ধরে ওয়ার্ড ইনচার্জ পদ দখল করে আছেন। এখন আবার তিনিই নিজেকে অন্য রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে একই পদে বহাল থাকতে চাইছেন।
এই হাসপাতালে আইসিইউ,সিসিইউ ও ইমের্জেন্সিসহ প্রায় ২৫ টি ওয়ার্ড রয়েছে। এসব ওয়ার্ডের ইনচার্জ হিসেবে ২ বছরের জন্য নিয়োগ পান সিনিয়র স্টাফ নার্সরা।কিন্তু গত ১৫ বছর ধরে এই পদে যেই এসেছেন সেই দীর্ঘদিন থাকার চেষ্টা করেছেন। হাসপাতাল সূত্রের মতে বেশিভাগ ইনচার্জের গড় মেয়াদ ৪-৫ বছর।
অতীতেও হাসপাতালে পরিচালকরা বিভিন্ন সময়ে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার ইনচার্জদের সরানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছেন। আওয়ামী লীগ পন্থী চিকিৎসক নেতা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিন্ডিকেট এর সাথে জড়িত থাকায় তা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই ওয়ার্ড ইনচার্জদের অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে হাসপাতালের ডাক্তার নার্স সহ বিভিন্ন স্তরে কর্মকর্তা কর্মচারীরা। এবার যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে তাই নতুন পরিচালক দায়িত্ব নেয়ার পর সব মেয়াদ উত্তীর্ণ ইনচার্জদের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে নির্দেশনা জারি করে। কেউ কেউ পদ ছাড়লেও অনেকেই দায়িত্ব ছাড়তে নারাজ।
তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের এসব ইনচার্জ দের বিভিন্ন দুর্নীতির খবর প্রকাশ হওয়ার পর সরে যেতে সম্মত হয়েছে। তবে একজন ব্যতিক্রম। তিনি সিসিইউ ইনচার্জ বিলকিস বেগম।মূলত তার নেতৃত্বেই এই ওয়াড ইনচার্জরা আওয়ামী লীগ শাসনামলে দাপিয়ে বেরিয়েছে। আর এদের প্রত্যক্ষভাবে মদত দিয়েছে আওয়ামী পন্থী চিকিৎসক নেতারা।
এদিকে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে রোগী ভোগান্তি চিত্র পুরনো। যেহেতু যেহেতু বেসরকারি হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল তাই সাধারণ মানুষের ভরসার এই সরকারি হাসপাতালটি। এখানে রোগীদের সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা থাকলেও সে সব সেবা নিতে পারেন না অনেকেই। আর এর মূলেই রয়েছে এসব ওয়ার্ড ইনচার্জারা। হাসপাতালের কর্মকর্তাদের অভিযোগ রয়েছে বিগত সরকারের আমলে এসব ওয়ার্ড ইনচার্জরা রাতারাতি কোটিপতি বনে গেছেন। মুমূর্ষ রোগীদের জিম্মি করে নানা কৌশলে আদায় করেন অর্থ। হাসপাতালের বেড বাণিজ্য হতে শুরু করে ওষুধ বিক্রি, তাদের নিয়মিত কাজ। এছাড়াও আইসিইউ, সিসিইউ’তে বেড পেতে তাদের কাছেই যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে গুণতে হয় নগদ টাকা।
হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, মেয়াদ উত্তীর্ণ অধিকাংশ ইনচার্জ দায়িত্ব ছাড়তে রাজি হয়েছে। তবে বিলকিস বেগম এখনো বিভিন্ন মহল থেকে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। এতদিন তিনি আওয়ামী লীগের খুব কাছের লোক হলেও এখন নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন বিএনপির লোক বলে।
এর আগেও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বিলকিস বেগমকে নিয়ে একাধিক রিপোর্ট হয়েছে। তবুও তিনি স্বপদে বহত ছিলেন। হাসপাতালটির সিসিইউ ওয়ার্ড নিজের দুর্নীতি আকরা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বিশেষ করে ওষুধ বিক্রিতে তার জুড়ি নেই। সিসিইউতে রোগী আসার সাথে সাথেই অন্তত কয়েক হাজার টাকার ওযুধ ও অন্যান্য জিনিসপত্র ফার্মেসি থেকে কিনে আনতে বলেন। যদিও এসব ওষুধের অধিকাংশই হাসপাতাল কতৃপক্ষ সরবরাহ করে থাকে। রোগীদের কেনা এসব ওষুধ পরবর্তীতে বাইরের বিক্রি করে।
অনুসন্ধানে দেখাগেছে সিসিইউতে কোন স্টোর রুম না থাকলেও, রোগীদের কেনা এসব ওষুধ ও অন্যান্য জিনিস সংরক্ষনের জন্য ডাক্তার ও নার্সদের ব্যবহৃত একটি টয়লেটকে স্টোর হিসেব ব্যবহার করা হয়। যার নেতৃত্বে রয়েছে বিলকিস বেগম। ওয়ার্ড বয়দের দিয়ে প্রতিদিন যা বিক্রি করে মোটা অংকের টাকা ইনকাম করেন তিনি। অভিযোগ আছে নতুন রোগী আনার জন্য দ্রæত ডাক্তারদের বলে থেকে সরিয়ে দেন এই বিলকিস। যেন তার ইনকাম ভালো চলে। এই অর্থের একটা অংশ তার অনুগত ওয়ার্ড বয় ও সিন্ডিকেট সদস্যরা পায়। এভাবেই রাতারাতি কাটিপতি বনে গিয়েছেন বিলকিস। শধু তাই নয় হাসপাতালের ডাক্তার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক কর্মচারীকে নিজের সিন্ডিকেটের অনুগত করে তুলেছেন। তাই চাইলেই বিলকিসকে কেউ কিছু বলতে পারে না।
গত পাঁচ বছর ধরে এই পদে রয়েছেন কিন্তু এখনোও যেতে যাচ্ছেন না। নতুন পরিচালক হিমশীল খাচ্ছেন এই সিন্ডিকেট ভেঙে তাদেরকে সরাতে। হাসপাতাল কতৃপক্ষ জানিয়েছে এতদিন স্বাচিবের নেতাদের দিয়ে বিলকিস বেগম তদবির চালালেও এখন তদবির চালাচ্ছেন সাবেক হৃদ রোগের ডাক্তারদের দিয়ে। যাদের আওয়ামী লীগের ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। তেমনি একজন সাবেক ডাক্তার ইনচার্জ সরকারি অধ্যাপক আব্দুল মোমেন। তিনিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে নেতারা নানাভাবে এই বিলকিস বেগমকে দায়িত্বে রাখার জন্য চাপ পরিচালককে চাপ দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলেন, এই বিলিকিসের নেতৃত্বেই দীর্ঘদিন ধরে রোগীদের হয়রানি করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে কয়েক বছর ধরেই গণমাধ্যমে খবর প্রচার হলেও তিনি স্বাস্থ্যের সিন্ডিকেটের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়েছেন। সাধারন কর্মকর্তা থেকে পরিচালক সবাইকেই চুপ করিয়ে দেওয়া হত। এখন আগের সরকার নেই তবুও বিলকিসের ক্ষমতার দাপট অব্যহত রয়েছে। সম্প্রতি হাসপাতালে বড় পরিসরে নতুন একটি আইসিইউ ওয়ার্ড চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেখানে ইনচার্জে থাকর জন্য চেষ্টা করছেন তিনি। তবে দ্রæত নতুন নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিলকিসসহ সবাইকেই তা মেনে নিতে হবে।
যাযাদি/ এস