তথ্য প্রযুক্তি

ইরান-ইসরাইল সংঘাত শুরুর পর থেকে অনলাইনে ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি ভেরিফাইড কয়েক ডজন পোস্ট পর্যালোচনা করে এই তথ্য তুলে ধরেছে।

বিবিসির বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি করা বেশ কয়েকটি ভিডিও, যা ইরানের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে গর্ব করে, পাশাপাশি ইসরাইলি লক্ষ্যবস্তুতে হামলার পরের ঘটনাগুলি দেখানো জাল ক্লিপ। বিবিসি ভেরিফাই যে তিনটি সর্বাধিক দেখা জাল ভিডিও পেয়েছে তা সম্মিলিতভাবে একাধিক প্ল্যাটফর্মে ১০ কোটিরও বেশি ভিউ সংগ্রহ করেছে।

ইসরাইলপন্থী অ্যাকাউন্টগুলিও অনলাইনে ভুল তথ্য শেয়ার করেছে, প্রধানত ইরানে বিক্ষোভ এবং সমাবেশের পুরানো ক্লিপগুলি পুনঃপ্রচার করে, মিথ্যা দাবি করে যে তারা সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ভিন্নমত এবং ইসরাইলের সামরিক অভিযানের প্রতি ইরানিদের সমর্থন দেখায়।

ইসরাইল ১৩ জুন ইরানে হামলা শুরু করে, যার ফলে ইসরাইল বেশ কয়েক দফা ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা চালানো হয়।

ওপেন-সোর্স চিত্র বিশ্লেষণকারী একটি সংস্থা অনলাইনে বিভ্রান্তিকর তথ্যের পরিমাণকে "আশ্চর্যজনক" বলে বর্ণনা করেছে এবং কিছু "সংশ্লিষ্ট কৃষক" অনলাইনে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তৈরি বিভ্রান্তিকর সামগ্রী ভাগ করে সংঘাত থেকে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছে।

আমরা পাকিস্তানের সম্পর্কহীন ফুটেজ থেকে শুরু করে অক্টোবর ২০২৪ সালের স্ট্রাইকের পুনর্ব্যবহৃত ভিডিও - যার মধ্যে কিছু ২০ মিলিয়নেরও বেশি ভিউ সংগ্রহ করেছে - এবং গেম ক্লিপ এবং এআই-উত্পাদিত সামগ্রী বাস্তব ঘটনা হিসাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, "জিওকনফার্মড, অনলাইন যাচাইকরণ গোষ্ঠী, X-এ লিখেছে।

কিছু অ্যাকাউন্ট বিভ্রান্তিকর তথ্যের "সুপার-স্প্রেডার" হয়ে উঠেছে, তাদের অনুসারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির সাথে পুরস্কৃত হয়েছে। তেহরানের কর্তৃপক্ষের সাথে কোনও স্পষ্ট সম্পর্ক নেই এমন একটি ইরানপন্থী অ্যাকাউন্ট - ডেইলি ইরান মিলিটারি - X-তে তার অনুসারীদের ১৩ জুন ৭০০,০০০ এরও বেশি থেকে ১৯ জুনের মধ্যে ১.৪ মিলিয়নে পৌঁছেছে, যা এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ৮৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।

এটি এমন অনেক অস্পষ্ট অ্যাকাউন্টের মধ্যে একটি যা সম্প্রতি মানুষের ফিডে উপস্থিত হয়েছে। সকলেরই নীল টিক আছে, বার্তা পাঠানোর ক্ষেত্রে তারা প্রচুর এবং বারবার ভুল তথ্য পোস্ট করেছে। যেহেতু কেউ কেউ আপাতদৃষ্টিতে অফিসিয়াল নাম ব্যবহার করে, তাই কিছু লোক ধরে নিয়েছে যে এগুলি আসল অ্যাকাউন্ট, তবে আসলে কে প্রোফাইলগুলি চালাচ্ছে তা স্পষ্ট নয়।

বিশ্লেষক গোষ্ঠী গেট রিয়েলের প্রধান তদন্তকারী কর্মকর্তা ইমানুয়েল সালিবা বিবিসি ভেরিফাইকে বলেন, "সংঘাতের সময় আমরা প্রথমবারের মতো জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করতে দেখেছি", এই বিভ্রান্তির ধারা চিহ্নিত করেছে।

টিকটকে ২.১১ কোটি ভিউ হওয়া আরেকটি ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে যে, বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনীর হাতে ইসরায়েলি এফ-৩৫ বিমান ভূপাতিত করা হচ্ছে, কিন্তু ফুটেজটি আসলে একটি ফ্লাইট সিমুলেটর ভিডিও গেম থেকে নেওয়া হয়েছে। বিবিসি ভেরিফাইয়ের সাথে যোগাযোগ করার পর টিকটক ফুটেজটি সরিয়ে ফেলেছে।

মিস কাপলান বলেন যে এফ-৩৫ বিমানের উপর কিছু জোর দেওয়া হচ্ছে এমন কিছু অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে যা অ্যালেথিয়া পূর্বে রাশিয়ার প্রভাব অভিযানের সাথে যুক্ত করেছে।

তিনি উল্লেখ করেছেন যে রাশিয়ার প্রভাব অভিযান সম্প্রতি ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রতি সমর্থনকে দুর্বল করার চেষ্টা থেকে পশ্চিমা - বিশেষ করে আমেরিকান - অস্ত্রের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহের বীজ বপনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

"রাশিয়ার আসলে এফ-৩৫ এর প্রতি কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। তাহলে তারা কী করতে পারে? তারা নির্দিষ্ট কিছু দেশের মধ্যে এর প্রতি সমর্থনকে দুর্বল করার চেষ্টা করতে পারে," মিস কাপলান বলেন।

ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ এবং অন্যান্য সংঘাতের উপর আগে প্রভাব বিস্তারকারী সুপরিচিত অ্যাকাউন্টগুলি দ্বারাও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।

তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন, তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে কেউ কেউ এই সংঘাতকে অর্থায়নের চেষ্টা করছে, কিছু প্রধান সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম বিপুল সংখ্যক ভিউ অর্জনকারী অ্যাকাউন্টগুলিকে অর্থ প্রদানের প্রস্তাব দিচ্ছে।

বিপরীতে, ইসরাইলপন্থী পোস্টগুলি মূলত এমন পরামর্শের উপর কেন্দ্রীভূত হয়েছে যে ইরান সরকার হামলা অব্যাহত থাকার সাথে সাথে ক্রমবর্ধমান বিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে।

এর মধ্যে একটি বহুল প্রচারিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-উত্পাদিত ভিডিও রয়েছে যা মিথ্যাভাবে দাবি করে যে ইরানিরা তেহরানের রাস্তায় "আমরা ইসরাইলকে ভালোবাসি" স্লোগান দিচ্ছে।

তবে, সাম্প্রতিক দিনগুলিতে - এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার বিষয়ে জল্পনা-কল্পনা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে - কিছু অ্যাকাউন্ট তেহরানের উপর বি-২ বোমারু বিমানের এআই-উত্পাদিত ছবি পোস্ট করতে শুরু করেছে। ইরানে ইসরায়েলের হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে বি-২ খুব মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, কারণ এটিই একমাত্র বিমান যা ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনায় কার্যকরভাবে আক্রমণ চালাতে সক্ষম।

ইরান এবং ইসরায়েলের সরকারী সূত্রগুলি কিছু ভুয়া ছবি শেয়ার করেছে। তেহরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম হামলার ভুয়া ফুটেজ এবং একটি বিধ্বস্ত F-35 জেটের একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-উত্পাদিত ছবি শেয়ার করেছে, অন্যদিকে ইসরাইল প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) দ্বারা শেয়ার করা একটি পোস্টে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যারেজের পুরানো, সম্পর্কহীন ফুটেজ ব্যবহারের জন্য X-তে একটি কমিউনিটি নোট পেয়েছে।

বিবিসি ভেরিফাই দ্বারা পর্যালোচনা করা অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্য X-এ শেয়ার করা হয়েছে, ব্যবহারকারীরা প্রায়শই পোস্টের সত্যতা যাচাই করার জন্য প্ল্যাটফর্মের AI চ্যাটবট - Grok-এর দিকে ঝুঁকছেন।

তবে, কিছু ক্ষেত্রে Grok জোর দিয়েছিলেন যে AI ভিডিওগুলি বাস্তব। এরকম একটি ভিডিওতে পাহাড়ের ধারের একটি কমপ্লেক্স থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনকারী ট্রাকের অবিরাম স্রোত দেখা গেছে। ভিডিওতে AI বিষয়বস্তুর কাহিনীর লক্ষণগুলি তাদের নিজস্ব ইচ্ছায় সরানো অন্তর্ভুক্ত, মিসেস সালিবা বলেন।

কিন্তু X ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়ায়, গ্রোক বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে ভিডিওটি আসল এবং নিউজউইক এবং রয়টার্স সহ মিডিয়া আউটলেটগুলির প্রতিবেদন উদ্ধৃত করেছেন। "স্পষ্টতার জন্য বিশ্বস্ত সংবাদ পরীক্ষা করুন," চ্যাটবটটি বেশ কয়েকটি বার্তায় উপসংহারে পৌঁছেছে।

চ্যাটবটের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য বিবিসি ভেরিফাইয়ের অনুরোধে X সাড়া দেয়নি।

অনেক ভিডিও টিকটক এবং ইনস্টাগ্রামেও প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি ভেরিফাইকে দেওয়া এক বিবৃতিতে, টিকটক বলেছে যে এটি সক্রিয়ভাবে সম্প্রদায় নির্দেশিকা প্রয়োগ করে "যা ভুল, বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা বিষয়বস্তু নিষিদ্ধ করে" এবং এটি "বিভ্রান্তিকর বিষয়বস্তু যাচাই" করার জন্য স্বাধীন ফ্যাক্ট চেকারদের সাথে কাজ করে।

ইনস্টাগ্রামের মালিক মেটা মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি। অনলাইনে জাল তৈরিকারীদের প্রেরণা ভিন্ন হলেও, সাধারণ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা অনেকগুলি শেয়ার করেন।

নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ম্যাথিউ ফ্যাসিয়ানি পরামর্শ দিয়েছেন যে যখন লোকেরা দ্বিধা এবং রাজনীতির কারণে উত্থাপিত দ্বিধাগুলির মুখোমুখি হয় তখন অনলাইনে বিভ্রান্তিকর তথ্য আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।

"এটি বৃহত্তর সামাজিক ও মানসিক সমস্যার কথা বলে যে লোকেরা যদি তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে জিনিসগুলি পুনরায় ভাগ করে নিতে চায়, এবং সাধারণভাবে, আরও চাঞ্চল্যকর আবেগগত বিষয়বস্তু অনলাইনে আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।"

বিবিসি ভেরিফাই; সূত্র: বিবিসি