২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একাই ৩০৩টি আসনে জিতেছিল। উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, বিহারের মতো যে রাজ্যগুলোতে বেশি আসন রয়েছে, সেখানে বিজেপি চূড়ান্ত ভালো ফল করেছিল। পশ্চিমবঙ্গে অভাবনীয়ভাবে ১৮টি আসনে জেতে তারা। এসব রাজ্যে তাদের আসন সংখ্যা কমার আশঙ্কা রয়েছে। ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে ১৬টিতে বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে। সম্প্রতি কর্ণাটকে ভোটে কংগ্রেসের বিপুল জয়ে ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখছে গেরুয়া শিবির। চলতি বছরের শেষে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের দিকে নজর রয়েছে। এখানে কংগ্রেস জিতলে বিজেপির ওপর চাপ আরও বাড়বে...
ভারতে বিজেপির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়তে মঞ্চ গড়েছে বিরোধীরা। ঘোষিত লক্ষ্য একটাই, হারাতে হবে বিজেপিকে। যদিও ‘ইনডিয়া’ জোটের একাধিক দলের মধ্যে বনিবনা নেই। তাই শুরুতেই প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কতটা চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারবে ‘ইনডিয়া’?
নতুন জোটের জন্ম : প্রায় এক দশক ধরে ভারতের রাজনীতি মোদিময়। শুধু লোকসভা নয়, বিধানসভা ভোটেও বিজেপি জয় পেয়েছে তার মুখ সামনে রেখে। বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্ন জোরালোভাবে উঠছে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের মুখে। এর সঙ্গে রয়েছে ৯ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা।
এই পরিস্থিতিতে একজোট ভারতের কয়েকটি অগ্রণী বিরোধী শক্তি। কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুতে গত ১৭ ও ১৮ জুলাই বিরোধীদের সম্মিলিত সভায় জন্ম হয়েছে নতুন জোটের। বিরোধীদের দ্বিতীয় বৈঠক হয়েছে বিহারের পাটনায়। জোটের নাম ‘ইনডিয়ান ন্যাশনাল ডেভলেপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স’ (আইএনডিআইএ) বা ‘ইনডিয়া’।
জোটে রয়েছে ২৬টি দল। কংগ্রেস ও বামপন্থিদের পাশাপাশি শরিক পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস, উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি, বিহারের জনতা দল ইউনাইটেড, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, দিল্লির আম আদমি পার্টি, মহারাষ্ট্রের এনসিপির মতো গুরুত্বপূর্ণ একঝাঁক আঞ্চলিক দল।
শুধু বৈঠক নয়, মাঠের লড়াইয়ে জোটের নেতাদের একসঙ্গে শামিল হতে দেখা যাচ্ছে। মণিপুর ইস্যুতে পার্লামেন্টের ভেতরে ও বাইরে প্রতিবাদে একজোট বিরোধীরা। প্রধানমন্ত্রী মোদির বিবৃতি দাবি করে লোকসভার চলতি বর্ষকালীন অধিবেশনে অচল করে রেখেছে ‘ইনডিয়া’। জোটের প্রতিনিধিরা গেছেন মণিপুর সফরে। একসঙ্গে বৈঠক করেছেন রাষ্ট্রপতির কাছে।
বিজেপি উদ্বেগে : কিছুদিন আগেই নরেন্দ্র মোদি দাবি করেছিলেন, তিনি একাই সব বিরোধীর চেয়ে বেশি শক্তিশালী! সেই চিত্রে এখন বদল দেখা যাচ্ছে। পাটনায় যেদিন বৈঠকে বসেছিল বিরোধী জোট, সেই দিনই দিল্লিতে ‘মৃতপ্রায়’ এনডিএ-র সভা ডাকে বিজেপি। ৩৮টি দল তাতে যোগ দেয়। ২৫ বছর আগে এনডিএ তৈরি হয়েছিল। বছরের পর বছর বিজেপি নেতৃত্বাধীন এই জোট ছিল কার্যত অস্তিত্বহীন, তাকে ফের কেন জাগিয়ে তোলা? যেখানে ৩৮টি দলের মধ্যে ১৬টির লোকসভায় কোনো প্রতিনিধি নেই। কখনো ভোটে লড়েনি ৯টি দল।
মোদি ‘ইনডিয়া’ জোটের নাম নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। ইস্ট ইনডিয়া কোম্পানি, ইনডিয়ান মুজাহিদিনের মতো সংগঠনের প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন। তা হলে কি বিজেপি বিরোধীদের সঙ্ঘবদ্ধ চেহারা দেখে উদ্বেগে? বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভারতের মানুষ জনতা সরকার দেখেছে। ভিপি সিং, চন্দ্রশেখর, গুজরাল, দেবগৌড়ার সরকার দেখেছে। ভোটাররা অস্থায়ী সরকার চায় না। তাই বিরোধীদের এই জমায়েত নিয়ে বিজেপি চিন্তিত নয়।’ শমীকের যুক্তি, ‘যে বাম ও কংগ্রেস নেতাকর্মী পশ্চিমবঙ্গে খুন হচ্ছেন, যারা বলছেন মোদি-দিদি গটআপ, তারা কীভাবে ভোটের জন্য কেন্দ্রীয় স্তরে হাত মেলাচ্ছেন?’
‘ইনডিয়া’র অন্দরে : বিজেপির এই প্রশ্ন অস্বস্তিতে রাখছে জোটকে। ‘ইনডিয়া’র শরিকরা একাধিক রাজ্যে মুখোমুখি। একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়ার ফর্মুলা বের করা কি সহজ হবে? সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেই দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে বোঝাপড়া হবে না। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ বিষয়ে নীরব থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ নেতৃত্ব তৃণমূলের বিরুদ্ধে একেবারে খড়্গহস্ত।
তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, গণতন্ত্র হত্যার ভূরি ভূরি অভিযোগ উঠেছে। গত মাসের পঞ্চায়েত নির্বাচন রাজ্যের শাসক-বিরোধী সংঘাতকে আরও তীব্র করেছে। দুই পক্ষের হানাহানিতে ৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ভোটে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছে।
কংগ্রেস নেতা, আইনজীবী কৌস্তভ বাগচী বলেন, ‘২০১১ সাল থেকে তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে যে অত্যাচার চালাচ্ছে, তার বিরোধিতা করতেই হবে। এরা কংগ্রেসকে দিনের পর দিন দুর্বল করেছে। এরা পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তৃণমূলকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়া হবে না।’
জোটে ঠান্ডা লড়াই : তৃণমূল জাতীয় ও রাজ্যের পরিস্থিতিকে আলাদা করে দেখছে। তৃণমূল মুখপাত্র, আইনজীবী বিশ্বজিৎ দেব বলেন, ‘রাজ্যে লড়াই হবে, কিন্তু কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সবাই একটি বিষয়ে একমত- বিজেপি সরকারকে সরাতে হবে। রাজ্য ও কেন্দ্রের রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। গণতন্ত্র, সংবিধান রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে এটা জরুরি।’
কিন্তু তৃণমূলের বিরুদ্ধেই তো গণতন্ত্র হত্যার অভিযোগ উঠছে! বিশ্বজিতের ব্যাখ্যা, ‘বিরোধীরা পরিকল্পিত সন্ত্রাস চালিয়েছে। আমাদের ১৮ জন কর্মী খুন হয়েছেন ৬০ হাজারের বেশি কেন্দ্রের কতগুলোয় গণ্ডগোল হয়েছে? ভোটের ফলই বলছে মানুষ কাদের পক্ষে।’
বিজেপি ও তৃণমূল, উভয়কেই প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখছে বাম-কংগ্রেস। একই সুর আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীর। তার প্রশ্ন, ‘পশ্চিমবঙ্গে যারা সংবিধান রক্ষা করছে না, তারা কেন্দ্রে বিজেপির বিরুদ্ধে কী লড়বে?’
কৌস্তভের মন্তব্য, ‘বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতেই হবে। এই রাজ্য থেকে তৃণমূলকে উৎখাত করা ততটাই জরুরি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে যে নির্দেশ পেয়েছি, তাতে আমাদের তৃণমূল বিরোধিতা অব্যাহত থাকবে।’ এই সংঘাত কি ‘ইনডিয়া’র সম্ভাবনায় পানি ঢেলে দিতে পারে? সিনিয়র সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে যেমন বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের লড়াই, তেমনই কেরালায় বাম ও কংগ্রেস মুখোমুখি। দিল্লি ও পাঞ্জাবে কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টির লড়াই। এটা কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনের ভোট। বিজেপি বিরোধিতার লক্ষ্যে সবাই এক থাকলে রাজ্যের পরিস্থিতি বাধা হবে না।’
ভোটের অঙ্ক : এমন জটিল সমীকরণের মধ্যে ভোটের পাটিগণিত নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একাই ৩০৩টি আসনে জিতেছিল। উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, বিহারের মতো যে রাজ্যগুলোয় বেশি আসন রয়েছে, সেখানে বিজেপি চূড়ান্ত ভালো ফল করেছিল। পশ্চিমবঙ্গে অভাবনীয়ভাবে ১৮টি আসনে জেতে তারা। এসব রাজ্যে তাদের আসন সংখ্যা কমার আশঙ্কা রয়েছে।
ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে ১৬টিতে বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে। সম্প্রতি কর্ণাটকে ভোটে কংগ্রেসের বিপুল জয়ে ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখছে গেরুয়া শিবির। চলতি বছরের শেষে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের দিকে নজর রয়েছে। এখানে কংগ্রেস জিতলে বিজেপির ওপর চাপ আরও বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে বিরোধীরা জোট বাঁধায় বিজেপির কাজ কি কঠিন হবে? সুমন ভট্টাচার্য বলেন, ‘গত লোকসভায় বিজেপি ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এনডিএ মিলিয়ে ৪৫ শতাংশ। সেই সময়ের জোটসঙ্গী জেডিইউ, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা বেরিয়ে গেছে। আকালি দলও নেই সঙ্গে। ২০১৯ সালে কংগ্রেস ১৯ শতাংশের বেশি ভোট পায়। ‘ইনডিয়া’ জোটের বাকি শরিকরা ২০ শতাংশের মতো। তাই অঙ্কের হিসেবে দুই পক্ষের বিশেষ ফারাক নেই।’
মোদি বনাম অন্য দল : বিজেপি বারবার প্রশ্ন তোলে, মোদির বিরুদ্ধে বিরোধীদের নেতা কে? কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি রাহুল গান্ধী ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা করে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছেন। কিন্তু বিরোধী জোটের আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে একাধিক মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন, যারা অভিজ্ঞতায় রাহুলকে পেছনে ফেলবেন। পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিহারের নীতিশ কুমার, দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা কি ক্ষমতার দৌড়ে নেই?
বিরোধীরা বলছে, জোটের নেতা পরে ঠিক হবে। এখন জোট সক্রিয় থাকবে ইস্যুর ভিত্তিতে। মণিপুর নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে বিরোধীরা। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও একজোট হওয়ার বার্তা দেশকে দিতে চাইছেন রাহুলরা।
এখন পর্যন্ত কোনো শিবিরেই না থাকা তেলেঙ্গনা ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতি, ওড়িশার বিজু জনতা দল, অন্ধ্রের তেলুগু দেশম, ওয়াইএসআর কংগ্রেস কোন দিকে যাবে, নজর রয়েছে সেই দিকেও। চলতি বছরের বিধানসভা নির্বাচন সেমিফাইনাল। তার ফলের পর দুই শিবির বিভাজন স্পষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। সংবাদসূত্র : ডিডাব্লিউ নিউজ
যাযাদি/ এস