সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় ভারতীয় গণমাধ্যমের ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি

যাযাদি ডেস্ক
  ১৮ মে ২০২৫, ১৯:০১
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় ভারতীয় গণমাধ্যমের ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি
ছবি: সংগৃহীত

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় ভারতীয় গণমাধ্যমের ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি

যাযাদি ডেস্ক

1

সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সামরিক উত্তেজনার পর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমমে একের পর এক ভারতের নজরকাড়া 'সাফল্যের' দাবি উঠে এসেছে। ভারতীয় হামলায় পাকিস্তানের পারমাণবিক ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ভূপাতিত করেছে পাকিস্তানের দুটি যুদ্ধবিমান, এমনকি ধ্বংস করা হয়েছে পাকিস্তানের করাচি বন্দরের একটি অংশও—যা কি না দেশটির তেল সরবরাহ ও বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার! প্রতিটি খবরই ছিল তথ্যবহুল, নির্দিষ্ট এবং দৃঢ়ভাবে উপস্থাপিত। কিন্তু পরে দেখা যায়, এগুলোর কোনোটিই সত্য ছিল না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব, অর্ধসত্য, ভুয়া ছবি-ভিডিও, মিম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিতে (এআই) বিকৃত বক্তব্য—সব মিলিয়ে ভারত-পাক সীমান্তের এপারে-ওপারে, উভয় দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে একধরনের বিভ্রান্তি ও উত্তেজনা।

তবে এসব তথ্যের একাংশ শুধু অনলাইন প্ল্যাটফর্মেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, কিছু ভুয়া ও যাচাইবিহীন তথ্য প্রবেশ করে ভারতীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও। যেসব সংবাদমাধ্যম এক সময় স্বাধীন ও নিরপেক্ষতার জন্য পরিচিত ছিল, তারাও এখন জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার জোয়ারে ভেসে যাচাই না করেই খবর ছড়িয়েছে।

চারদিনের এই সংঘাতে খবর প্রচারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে অনেকে, প্রতিযোগিতা চলে 'কার আগে কে প্রচার করবে'। সংবাদ পাঠক ও টিভি বিশ্লেষকরা যেন যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন জোগানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একাধিক পরিচিত টিভি চ্যানেল যাচাই না করে ভুয়া বা পুরোপুরি সাজানো খবর সম্প্রচার করেছে।

সবচেয়ে আলোচিত ছিল পাকিস্তানের একটি পারমাণবিক স্থাপনায় ভারতের হামলার ফলে সেখানে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে। প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় একটি বিশদ মানচিত্র, যেখানে হামলার নকশাও দেখানো হয়। কিন্তু এমন গুরুতর দাবির পেছনে ছিল না কোনো নির্ভরযোগ্য উৎস বা নিশ্চিত তথ্য।

এমনকি ভারতীয় নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে করাচি বন্দরে হামলা চালানোর কথাও দাবি করা হয়, যা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। পরে জানা যায়, সেই দাবিরও কোনো ভিত্তি ছিল না।

বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন আমেরিকান ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক সুমিত্রা বাদ্রীনাথন। এবারের ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময় ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া খবর ছড়ানোর প্রবণতা তাকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।

তিনি বলেন, 'আমরা সাধারণত ভুয়া তথ্য বলতে বুঝি—কোনো নামহীন অ্যাকাউন্ট থেকে আসা অস্পষ্ট বার্তা, বা এমন কিছু যার উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না।' কিন্তু এবারের পরিস্থিতি আলাদা। সুমিত্রার মতে, যাদের আগে বিশ্বাসযোগ্য সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হতো, তারাই এবার সরাসরি মনগড়া খবর প্রচার করেছেন। তিনি বলেন,'যেসব উৎসকে আমরা আগে নির্ভরযোগ্য ভাবতাম, তারা নিজেই ভুয়া তথ্য ছড়াতে শুরু করলে সেটি সবচেয়ে ভয়ানক।'

২০১৯ সালের ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্যের সয়লাব দেখা গিয়েছিল। তবে এবারের পার্থক্য হলো—মূলধারার সংবাদমাধ্যম এবং প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকরাও তাতে সক্রিয়ভাবে জড়িত।

যুদ্ধ বা সামরিক উত্তেজনার সময় মিথ্যা তথ্য ছড়ানো সব পক্ষেরই পরিচিত কৌশল। কেউ কেউ তা ইচ্ছাকৃতভাবে করে, আবার কেউ কেউ তাড়াহুড়োর মধ্যে ভুল তথ্য প্রচার করে ফেলে G মূলধারার সংবাদমাধ্যমও মাঝে মাঝে নিজেদের দেশের সামরিক 'সাফল্য'কে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরতে গিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে পড়ে।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এর মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর পরিধি ও গতি কয়েক গুণ বেড়েছে। আর একে ঘিরে ভারতে একটি নতুন সংকটও তৈরি হয়েছে—বিশেষ করে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতায় আসার পর বাকস্বাধীনতার পরিসর আগের চেয়ে এখন অনেকটাই সংকুচিত ।

সরকারবিরোধী খবর প্রকাশ থেকে অনেক ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এখন বিরত থাকছে। বেশ কিছু বড় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সরকারি নীতির পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে। যদিও কিছু স্বাধীন অনলাইন মিডিয়া সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চেষ্টা করছে, তাদের প্রভাব সীমিত থেকেই যাচ্ছে।

ভারতের এক স্বনামধন্য সাংবাদিক এবং 'ইন্ডিয়া টুডে' টেলিভিশনের উপস্থাপক রাজদীপ সরদেসাই গত সপ্তাহে সরাসরি সম্প্রচারে পাকিস্তানের জঙ্গি বিমানের ভূপাতিত হওয়ার খবর প্রচারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, খবরটি 'সত্য প্রমাণিত হয়নি।'

এর কয়েক দিন পর, গত শনিবার নিজের ইউটিউব চ্যানেলে তিনি আবারো ক্ষমা চেয়ে বলেন, 'এসব ভুয়া তথ্যের বেশিরভাগই দেশপ্রেমের আড়ালে লুকানো ডানপন্থীদের পরিকল্পিত প্রচারণার অংশ। ২৪ ঘণ্টা সংবাদ প্রচারকারী চ্যানেলগুলোও মাঝে মাঝে এই ফাঁদে পড়ে যায়।'

ক্যার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড্যানিয়েল সিলভারম্যান-এর ভাষ্যে, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য বা 'ডিসইনফরমেশন' অর্থাৎ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়ানো মিথ্যা তথ্য সাধারণত উসকানি দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়—কখনো তা কিছু গোপন রাখতেও ব্যবহৃত হয়, তবে মূলত এটি এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যেন মানুষের আবেগকে উস্কে দিয়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তানের দীর্ঘ সময়ের শত্রুতার প্রেক্ষাপটে, দুই দেশের জনগণের মধ্যে মিথ্যা তথ্য বিশ্বাস করার এবং ছড়ানোর প্রবণতা অনেক বেশি। ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ছড়ানো ভুয়া তথ্য যাচাইয়ের কাজে নিয়োজিত স্বাধীন ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্ম 'অল্ট নিউজ' সম্প্রতি বেশ কিছু টিভি চ্যানেলের ভুয়া প্রতিবেদনের প্রমাণ তুলে ধরেছে। এসব প্রতিবেদনের মধ্যে রয়েছে ভারতের জাতীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী চ্যানেল 'আজতক' ও 'নিউজ১৮'-এর খবরও।

'তথ্য পরিবেশ পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে,' মন্তব্য করেন অল্ট নিউজের সহ-প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা। তার মতে, ফ্যাক্টচেকিং বিভ্রান্তি মোকাবিলার কার্যকর উপায় হলেও এর খেসারতও রয়েছে—অল্ট নিউজের বিরুদ্ধে একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান মানহানির মামলা দায়ের করেছে এবং তাদের সাংবাদিকরাও হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ২০ কোটিরও বেশি পরিবারের টেলিভিশন রয়েছে এবং প্রায় ৪৫০টি বেসরকারি চ্যানেল শুধুমাত্র সংবাদ প্রচারে নিয়োজিত, ফলে টেলিভিশনই দেশটিতে তথ্যের প্রধান উৎস।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি পরিচিত টিভি চ্যানেল ভারতীয় নৌবাহিনীর 'করাচি বন্দরে হামলা' সংক্রান্ত একটি খবর সম্প্রচার করে, যা দ্রুত ভাইরাল হয়। 'করাচি' ও 'করাচি বন্দর'—এই শব্দগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন্ডিং হয়ে ওঠে। বিভিন্ন পোস্টে করাচির আকাশে বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট ধোঁয়ার ছবি ছড়িয়ে পড়ে।

তবে পরে তথ্য যাচাইকারীরা (ফ্যাক্ট-চেকার) নিশ্চিত করেন, ভাইরাল হওয়া ছবিগুলো করাচির নয়—এগুলো গাজার ধ্বংসাবশেষের পুরোনো ছবি। সংঘাত শেষে এক বিবৃতিতে ভারতীয় নৌবাহিনী জানায়, তারা করাচি আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকলেও বাস্তবে কোনো হামলা চালানো হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে