মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

টিকটকের জনপ্রিয় ১০০ মানসিক স্বাস্থ্য ভিডিওর অর্ধেকের বেশি ভুল তথ্য ছড়ায়!

যাযাদি ডেস্ক
  ০১ জুন ২০২৫, ১২:৩৯
আপডেট  : ০১ জুন ২০২৫, ১২:৪১
টিকটকের জনপ্রিয় ১০০ মানসিক স্বাস্থ্য ভিডিওর অর্ধেকের বেশি ভুল তথ্য ছড়ায়!
ছবি : সংগৃহীত

টিকটকের মানসিক স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত শীর্ষ ভিডিওগুলোর অর্ধেকেরও বেশি ভিডিও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে—এমন তথ্য উঠে এসেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান-এর এক তদন্তে।

গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ভুল চিকিৎসা-পরামর্শ দিচ্ছেন, চিকিৎসার ভাষা ভুলভাবে ব্যবহার করছেন এবং 'দ্রুত সমাধান'-এর মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছেন।

1

মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা খুঁজতে গিয়ে মানুষ একাধিক অসংগত পরামর্শের মুখোমুখি হচ্ছেন—যেমন, 'উদ্বেগ কমাতে গোসলের সময় কমলা খাওয়া'র মতো প্রস্তাব, কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ছাড়া বিভিন্ন সাপ্লিমেন্ট (যেমন জাফরান, ম্যাগনেশিয়াম গ্লাইসিনেট ও তুলসী) ব্যবহারের পরামর্শ, 'এক ঘণ্টার মধ্যে ট্রমা নিরাময়' পদ্ধতি, এমনকি সাধারণ আবেগকেও 'পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার' বা নির্যাতনের লক্ষণ হিসেবে তুলে ধরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর, ক্ষতিকর ও কখনো কখনো বিপজ্জনক মানসিক স্বাস্থ্য-পরামর্শ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি অত্যন্ত 'ভীতিকর' ও 'উদ্বেগজনক'। তারা সরকারকে এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের বিস্তার রোধে নিয়ন্ত্রণ জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন।

'গার্ডিয়ান' টিকটকে #mentalhealthtips হ্যাশট্যাগের শীর্ষ ১০০টি ভিডিও পর্যালোচনা করে সেগুলো কয়েকজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোবিজ্ঞানী ও একাডেমিক বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠায়।

বিশেষজ্ঞরা দেখেন, ট্রমা, নিউরোডাইভারজেন্স, উদ্বেগ, হতাশা ও গুরুতর মানসিক অসুস্থতা নিয়ে পরামর্শ দেওয়া ১০০টি ভিডিওর মধ্যে ৫২টিতেই কোনও না কোনও বিভ্রান্তিকর তথ্য রয়েছে। কিছু কিছু ভিডিও তো আবার একেবারেই অস্পষ্ট এবং মোটেও সহায়ক নয়।

কিংস কলেজ লন্ডনের সাইকোলজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের গবেষক এবং নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট ডেভিড ওকাই উদ্বেগ ও হতাশা-সম্পর্কিত ভিডিওগুলো পর্যালোচনা করে বলেন, অনেক পোস্টে চিকিৎসার ভাষা ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ''ওয়েলবিইং', 'উদ্বেগ' ও 'মেন্টাল ডিসঅর্ডার' শব্দগুলোকে একে অপরের স্থানে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে মানসিক অসুস্থতা আসলে কী—সে সম্পর্কে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।''

তিনি আরও বলেন, অনেক ভিডিওতে মানুষের সীমিত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা অজানা গল্পের ভিত্তিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যা 'সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে'।

এগুলো দেখায়, কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংক্ষিপ্ত, মনোযোগকাড়া উপস্থাপনা প্রায়ই সঠিক চিকিৎসা-পদ্ধতির জটিল বাস্তবতা ছাপিয়ে যায়।

অনেক ভিডিওতে থেরাপির কার্যকারিতা অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ডেভিড বলেন,'থেরাপির কার্যকারিতা প্রমাণিত, কিন্তু এটিকে কোনও 'জাদুমন্ত্র', 'দ্রুত সমাধান' বা 'একই সবার জন্য উপযোগী' হিসেবে দেখানো ঠিক নয়।'

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস)-এর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড্যান পল্টার গুরুতর মানসিক অসুস্থতা নিয়ে ভিডিওগুলো পর্যবেক্ষণ করে বলেন, 'কিছু ভিডিওতে দৈনন্দিন আবেগ ও অভিজ্ঞতাকে গুরুতর মানসিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এতে সহজে প্রভাবিত হওয়া মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারেন, পাশাপাশি গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্তদের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা তুচ্ছ করে ফেলা হয়।'

ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির অনুমোদিত মনোবিজ্ঞানী অ্যাম্বার জনস্টোন ট্রমা–সংক্রান্ত ভিডিওগুলো পর্যালোচনা করে বলেন, বেশিরভাগ ভিডিওতে কিছুটা সত্য থাকলেও সেগুলো পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) বা ট্রমার জটিলতাকে অতিমাত্রায় সরলীকৃতভাবে তুলে ধরে।

তিনি বলেন, 'প্রতিটি ভিডিওই এই ভুল ধারণা দেয় যে, সবার পিটিএসডি অভিজ্ঞতা ও উপসর্গ একই এবং সেগুলো ৩০-সেকেন্ডের ভিডিওতে সহজেই বোঝানো যায়। তবে, বাস্তবে পিটিএসডি ও ট্রমার উপসর্গ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন এবং বুঝতে পেশাদার ও অনুমোদিত চিকিৎসকের সাহায্য প্রয়োজন।'

জনস্টোন আরও জানান, 'টিকটক এখন এমন একটি ধারণা ছড়াচ্ছে যে, সবকিছুর জন্যই কোনও না কোনও রহস্যময় সার্বজনীন পরামর্শ আছে, যা মানুষকে বিভিন্ন মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেবে। অথচ বাস্তবে এগুলো মানুষের মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করতে পারে, এক ধরণের ব্যর্থতার অনুভূতি তৈরি করতে পারে।'

যদিও টিকটক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যারা চিকিৎসা নেওয়াকে নিরুৎসাহিত করে বা বিপজ্জনক চিকিৎসা-পদ্ধতি প্রচার করে, এমন ভিডিও সরিয়ে ফেলা হয়।

লেবার পার্টির সংসদ সদস্য চি ওনওয়ুরাহ, যিনি একটি প্রযুক্তি–বিষয়ক কমিটিও পরিচালনা করেন, বলেন—সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর বিষয়টি নিয়ে তার কমিটি তদন্ত করছে।

তিনি জানান, 'অনলাইন নিরাপত্তা আইন (ওএসএ) কতটা কার্যকরভাবে অনলাইনে মিথ্যা বা ক্ষতিকর বিষয়বস্তু দমনে সক্ষম এবং এগুলো প্রচারে অ্যালগরিদমের ভূমিকা'—এ বিষয়ে 'গুরুতর উদ্বেগ' দেখা দিয়েছে।

লিবারেল ডেমোক্র্যাট এমপি ভিক্টোরিয়া কলিন্সও এই প্রতিবেদনের ফলাফলের প্রশংসা করে বলেন, সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে জনগণকে 'ভুল তথ্য' থেকে সুরক্ষিত রাখা যায়।

যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য ও সমাজসেবা সংক্রান্ত সিলেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান লেবার এমপি পাওলেট হ্যামিল্টন বলেন, সামাজিক মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক ভ্রান্ত তথ্যগুলো 'উদ্বেগজনক'।

তিনি বলেন, 'সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত এই 'টিপস'–এর ওপর নির্ভর না করে, যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদারদের সহায়তা নেওয়া উচিত।'

রয়েল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টস–এর অনলাইন সেফটি লিড প্রফেসর বার্নাডকা ডুবিকা বলেছেন, সামাজিক মাধ্যম সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করলেও, মানুষকে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে প্রমাণভিত্তিক হালনাগাদ স্বাস্থ্য তথ্য পাওয়ার সুযোগ থাকা উচিত।

তিনি বলেন, 'কেবলমাত্র প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে বিস্তৃত মূল্যায়নের ভিত্তিতেই মানসিক রোগ নির্ধারণ সম্ভব।'

টিকটকের এক মুখপাত্র বলেন, 'টিকটক হলো এমন একটি জায়গা, যেখানে কোটি কোটি মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নিজেদের যাত্রা ভাগাভাগি করেন এবং সমমনা মানুষের সমর্থন পান।

তবে, এই প্রতিবেদনের পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধা দেয় এবং মানুষকে নিজেদের গল্প সবার সামনে উপস্থাপন করাকে নিরুৎসাহিত করে ।'

তিনি আরও জানান, 'আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও এনএইচএসের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করি, যাতে আমাদের প্ল্যাটফর্মে নির্ভরযোগ্য তথ্য ছড়ানো যায়। ক্ষতিকর ভুয়া তথ্যের ৯৮ শতাংশ আমরা অভিযোগ পাওয়ার আগেই সরিয়ে ফেলি।'

সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, মন্ত্রীরা 'অনলাইনে ক্ষতিকর মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্যের প্রভাব কমাতে' অনলাইন নিরাপত্তা আইন কার্যকর করতে কাজ করছে। এই আইনে বলা হয়েছে, এমন তথ্য শিশুদের জন্য ক্ষতিকর বা অবৈধ হলে, প্ল্যাটফর্মগুলোর তা দমন করা বাধ্যতামূলক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে