ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর যে আকাঙ্ক্ষা বারবার ব্যক্ত করে এসেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা বাস্তব হয়েই দেখা দিয়েছে।
আজ শুক্রবার ভোররাতের দিকে দেশটির হামলায় ইরানের রাজধানী তেহরানসহ বেশ কয়েকটি শহর কেঁপে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসা অসংখ্য ছবিতে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যাচ্ছে।
তেল আবিব এদিন ইরানের বেশ কজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীর প্রাণও কেড়ে নিয়েছে। এ হামলাকে গত বছরের দুই দফার হামলার সঙ্গে মেলালে ভুল হবে। সেগুলোকে ‘সতর্কবার্তা’ ধরলে শুক্রবারের হামলা মূলত ‘যুদ্ধের আমন্ত্রণ’- বলছেন বিশ্লেষকরা।
এমন নজিরবিহীন হামলার পর ইরানও প্রতিক্রিয়া দেখাবে। এরই মধ্যে তারা ইসরাইলকে লক্ষ্য করে ১০০টির মতো ড্রোন ছুড়েছে বলে জানিয়েছে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। সেসব ড্রোন ভূপাতিত করার ছবিও টেলিগ্রামে এসেছে।
কিন্তু এই প্রতিক্রিয়াই শেষ নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের ধারণা, ইরান আরও বড় আকারে প্রতিশোধ নেবে, যা পুরো অঞ্চলকেই যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তেমনটা হলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়বে বলে বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন, বলছে সিএনএন।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইউরোপের অনেক মিত্রের সঙ্গে তেল আবিবের টানাপড়েন চললেও ওয়াশিংটনের কাছ থেকে তারা সবসময়ই ইরান ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে সমর্থন পেয়ে এসেছে। এবার হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে সমঝোতা করতে সতর্ক করেছেন।
কেবল তা-ই নয় ইসরাইলে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র সরবরাহ করা দেশও যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবারের হামলায় ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বিমান ব্যবহারের কথাও গর্ব ভরেই বলছে।
এ হামলা যে হতে পারে তার ইঙ্গিত মিলছিল কয়েকদিন ধরেই। ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে জরুরি-নয় এমন কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ইরানে ইসরায়েলের হামলা ‘আসন্ন’ বলে বারবারই সতর্ক করছিল।
এর ধারাবাহিকতায় শুক্রবার ভোররাতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানা এবং সামরিক কমান্ডারদের লক্ষ্য করে হামলা শুরু করে তেল আবিব। কয়েক দফায় শতাধিক হামলায় তারা ইরানের অন্তত ৮টি স্থাপনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে বলে দাবি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর। ইসরায়েলি হামলায় ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও রাডারেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
তেল আবিবের ভাষ্য, তেহরান যাতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে একটি দীর্ঘমেয়াদি অভিযানের শুরু হিসেবে এই হামলা চালাল তাদের সামরিক বাহিনী।
হামলার ঘোষণা দিয়ে নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘কিছুক্ষণ আগে শুরু হয়েছে ইসরাইলের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ । আমাদের এই সামরিক অভিযানের লক্ষ্য ইরানি হুমকি প্রতিরোধ করা। যতদিন না এই হুমকি বন্ধ হচ্ছে, ততদিন এ অভিযান চলবে।’
এর প্রতিক্রিয়ায় ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইসরাইলকে ‘তিক্ত ও বেদনাদায়ক’ পরিণতি ভোগ করার প্রস্তুতি নিতে বলেছেন।
ইরানের পাল্টা হামলা মোকাবেলায় ইসরাইলে এরই মধ্যে জরুরি অবস্থাও জারি করা হয়েছে। এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে ইসরাইলের বাসিন্দারাতো বটেই, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সবাই ‘বড় যুদ্ধ বেধে যাওয়ার’ আশঙ্কা করছেন।
সমরশক্তি বিবেচনায় পশ্চিমা দেশগুলো সমর্থিত ইসরাইল এগিয়ে থাকলেও ইরানের শক্তি হচ্ছে তাদের ‘প্রতিরোধ অক্ষ’। যে অক্ষে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতিরা থেকে শুরু করে ইরাক ও সিরিয়ায় ক্রিয়াশীল অনেকগুলো মিলিশিয়া গোষ্ঠী রয়েছে।
গত বছর যুদ্ধে ইসরাইল হিজবুল্লাহর শক্তি অনেকটা খর্ব করলেও সশস্ত্র গোষ্ঠীটি এখনও ক্রিয়াশীল, এবং এর প্রভাব এত সহজে মুছে যাওয়ার নয় বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে নতুন একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন গত কয়েক মাস ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। এ নিয়ে রোববার দুই পক্ষের মধ্যে ষষ্ঠ দফার বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু ইসরাইলের হামলা যে ওই আলোচনায় ইতি টেনে দেবে, তা বলাই বাহুল্য।
গত বছর ইসরাইল ও ইরান দীর্ঘদিনের ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ ছেড়ে সরাসরি একে অপরের ওপর হামলা চালিয়েছিল।
সেবার যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র ইসরাইলকে ইরানের জ্বালানি ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করতে নিষেধ করে দিয়েছিল। এরপরও ইরানও তাদের পাল্টা হামলায় রাশ টেনেছিল। দৃশ্যত ব্যাপক হামলা করলেও তেহরান নিশানা ঠিক করেছিল এমনভাবে যেন ক্ষয়ক্ষতি খুব কম হয়।
সেই তুলনায় ইসরাইলের শুক্রবারের হামলা ছিল ‘ভয়াবহ তীব্র’। তারা এবার ইরানের মূল মূল পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এ তালিকায় আছে নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা, আছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানাও। তেল আবিবের হামলায় প্রাণ গেছে ইরানের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল হোসেইন সালামি ও সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরির।
সিএনএনের নিরাপত্তা বিশ্লেষক বেথ সেনার বলছেন, ‘ইরানের সালামির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যানকে। আমেরিকার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটলে তারা কি করতে পারে একবার ভেবে দেখুন।’
সেনারের মতে, ইরান এখন ‘অস্তিত্বের সঙ্কটে’, যে কারণে ইসরাইল শেষবার যেমনটা দেখেছে তার তুলনায় এবার তারা ‘ব্যাপক, অনেক বড়সড় পাল্টা হামলা সামলানোর’ প্রস্তুতি নিতে পারে।
তবে সব বিশেষজ্ঞ আবার একই রকম ভাবছেন না। আটলান্টিক কাউন্সিলের স্কোক্রফট সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জ্যেষ্ঠ পরিচালক ম্যাথু ক্রোয়েনিগ মনে করছেন, ইসরাইল হামলা চালালেও ইরানের পাল্টা হামলা চালানোর সক্ষমতা কম।
এ সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত ইরানকেই নিতে হবে। তারা কি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ অব্যাহত রাখবে, নাকি ঝুঁকি নিয়েই তা চালিয়ে যাবে, তার ওপরই আসছে মাস বা বছরগুলোতে ইসরায়েলি প্রতিক্রিয়া নির্ভর করবে, বলেছেন তিনি।
মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইসরাইলের প্রভাব যে এখন সবচেয়ে বেশি তা বেশিরভাগ লোকই মানবে। অনেক আরব দেশ মুখে তাদেরকে স্বীকৃতি না দিলেও গোপনে ঠিকই সম্পর্ক রেখে চলেছে। ইরানের প্রভাব নিয়ে চিন্তিত সৌদি আরবসহ সুন্নি দেশগুলো প্রায়ই ইরানবিরোধী তেল আবিবের নানান পদক্ষেপে ‘পরোক্ষ সহায়তা’ করে এসেছে।
এসব দেশের বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। যে কারণে আটলান্টিক কাউন্সিলের মিডল ইস্ট প্রোগ্রামের অনাবাসিক জ্যেষ্ঠ ফেলো রিচার্ড লে’বেরন মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র না চাইলেও মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ হলে তাকে তাতে জড়িয়ে পড়তেই হবে।
ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা চলতে থাকলে ওয়াশিংটনকে অবশ্যই তেল আবিবের পাশে থাকতে হবে, যদিও দৃশ্যত তারা কূটনীতির মাধ্যমেই তেহরানের পরমাণু কর্মসূচির সমাধান চেয়েছিল, বলছেন লে’বেরন।
নানা ধরনের ‘সম্ভাব্য দৃশ্যপট’ তৈরি হলেও পুরোটাই যে ইরান ও তার মিত্রদের সক্ষমতা এবং তাদের প্রতিক্রিয়ার ধরনের ওপর নির্ভর করছে, সে বিষয়ে একমত প্রায় সবাই।
পাশাপাশি বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধ বেধে গেলে তা যে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য, বিশেষ করে তেল সরবরাহে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে তা নিয়েও তারা বেশ উদ্বিগ্ন।