শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

হোয়াইট হাউজে আসিম মুনির: যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কে নাটকীয় মোড়

যাযাদি ডেস্ক
  ১৯ জুন ২০২৫, ২১:৩৯
হোয়াইট হাউজে আসিম মুনির: যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কে নাটকীয় মোড়
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউজে একান্ত বৈঠক করেছেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হোয়াইট হাউজে! ইতিহাসে এমন দৃশ্য খুবই বিরল। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউজে একান্ত বৈঠক করেছেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। এটি নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, কারণ মুনির পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান নন, তবুও যুক্তরাষ্ট্র তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং সম্মান জানিয়েছে, যেন তিনি কোনো রাষ্ট্রপ্রধানই।

মাত্র কয়েক বছর আগেও ডোনাল্ড ট্রাম্প পাকিস্তানকে ‘মিথ্যার আশ্রয়স্থল’ এবং ‘সন্ত্রাসীদের নিরাপদ ঘাঁটি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

সেই পাকিস্তানকেই আজ তিনি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। এটিকে যদি নাটকীয় পরিবর্তন বলা হয়, তাতে বিন্দুমাত্র অতিরঞ্জন হবে না।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এক নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে।

মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনার সময় মার্কিন মধ্যস্থতা এ সম্পর্ককে আরও সুসংহত করেছে। এক কথায় বলা যায়, সম্পর্কের পেছনে কার্যকরী হাত আসলে যুদ্ধ ঠেকানোর রাজনীতি।

সম্প্রতি কাশ্মীর সীমান্তে সংঘর্ষে ভারতীয় নাগরিক নিহত হওয়ার পর পাল্টাপাল্টি হামলা চলে দুই দেশের মধ্যে। ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরিণতি পারমাণবিক সংঘাতেও রূপ নিতে পারত। ঠিক সেই সময় হোয়াইট হাউজ সক্রিয়ভাবে যুদ্ধবিরতির পথে মধ্যস্থতা করে। ট্রাম্প নিজেই দাবি করেছেন, এই যুদ্ধ থামাতে মুনির ও মোদী—দুজনই তার সহযোগিতা করেছেন। যদিও ভারত এই দাবি পুরোপুরি অস্বীকার করেছে এবং একে দ্বিপাক্ষিক সমাধান বলেই দাবি করে।

এখানেই শুরু হয় প্রশ্ন। যুদ্ধ থামানোর যে কৃতিত্ব ট্রাম্প নিজে নিচ্ছেন, তার পেছনে কী পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা অর্জনই মূল টার্গেট? হোয়াইট হাউজে মুনিরের উপস্থিতি কেবল যুদ্ধ-পরিস্থিতি মোকাবেলার পরিণাম নয়, বরং তা ভবিষ্যতের সম্পর্ক পুনর্গঠনের সূচনাবিন্দু বলেই মনে করছেন অনেকেই।

পাকিস্তান বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে লেনদেনমূলক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। আফগান যুদ্ধ, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান থেকে শুরু করে বিন লাদেন ধরা পড়ার ঘটনায় এমন সম্পর্কেরই প্রতিফলন ছিল।

তবে ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটির কাছেই ধরা পড়ার পর থেকে সম্পর্ক ছিল রীতিমতো অবিশ্বাসে ঢাকা।

তবে বর্তমান বিশ্বে ভূরাজনীতির মানচিত্র বদলেছে। চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেলেও পাকিস্তান আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করতে চাচ্ছে।

কারণ অর্থনীতি, প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য এখনো যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প নেই।

এখানেই আসছে বিনিয়োগ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে বিরল খনিজসম্পদ, শুল্কমুক্ত বাণিজ্য এবং ক্রিপ্টোসহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে।

যা প্রতিরক্ষা, রোবোটিক্স এবং প্রযুক্তি শিল্পে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লাভজনক হতে পারে।

সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে পাকিস্তানের বর্তমান ভূমিকা নিয়েও ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন মার্কিন সেনাকর্তা জেনারেল মাইকেল কুরিল্লা। তিনি বলেন, “পাকিস্তান এখন আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী।”

কিন্তু, সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে—এই সম্পর্ক পুনর্গঠন কি গণতন্ত্রের বিনিময়ে হচ্ছে? পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরেই সেনাবাহিনীর একচ্ছত্র আধিপত্য চলছে।

মুনির হচ্ছেন দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত হয়েছেন। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার অবস্থান কতটা শক্তিশালী, সেটি শুধু এই আমন্ত্রণই নয়, তার সিদ্ধান্ত গ্রহণক্ষমতার মাধ্যমেও স্পষ্ট।

রুমী এবং আনসারের মতো বিশ্লেষকেরা সতর্ক করেছেন, এই ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক যতটা না রাষ্ট্রের মধ্যে, তার চেয়ে বেশি গঠিত হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও গোপনীয় সমঝোতার মাধ্যমে।

এর ফলে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে, তা ভবিষ্যতে পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হতে পারে।

সামগ্রিকভাবে বলা যায়, হোয়াইট হাউজে আসিম মুনিরের আগমন একটি নাটকীয় মোড় বটে—কিন্তু এই মোড়ে গন্তব্য কোন দিকে, সেটিই এখনো প্রশ্নচিহ্ন হয়ে আছে।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে