সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

ট্রাম্পের ইরানে হামলা ঝুঁকিপূর্ণ জুয়ার চাল

যাযাদি ডেস্ক
  ২২ জুন ২০২৫, ১৭:০১
ট্রাম্পের ইরানে হামলা ঝুঁকিপূর্ণ জুয়ার চাল
ছবি সংগৃহীত

ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে পা রাখার আগে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ-সংঘাত বন্ধে নিজেকে ‘শান্তির দূত’ হিসেবে তুলে ধরবেন তিনি।

কিন্তু সময় বলছে ভিন্ন কথা। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি জড়িয়ে নিয়ে নিজের কথারই উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলেন ট্রাম্প। শান্তি আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন সেই অঞ্চলে বড় ধরনের যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ট্রাম্পের কারণে।

ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর খবর নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে জানানোর ঠিক দুই ঘণ্টা পর হোয়াইট হাউস থেকে জাতির উদ্দেশে এক টেলিভিশন ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, এই অভিযান ছিল একটি ‘দর্শনীয় সামরিক সাফল্য’।

ট্রাম্প আরও মন্তব্য করেন, এই পদক্ষেপই একটি স্থায়ী শান্তির দরজা খুলে দেবে, যেখানে ইরান আর পারমাণবিক শক্তি হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও প্রতিরক্ষাসচিব পিট হেগসেথকে পাশে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এক ভাষণ দেন।

যেখানে ইরানকে সতর্ক করে বলেন, যদি তারা তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ না করে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ হামলার মুখোমুখি হতে হবে।

ট্রাম্প বলেন, এখনো অনেক লক্ষ্যবস্তু বাকি আছে এবং যুক্তরাষ্ট্র সেগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত, নিখুঁত ও দক্ষতার সঙ্গে অভিযান চালাবে।

তবে প্রেসিডেন্টের এই আত্মবিশ্বাসী বক্তব্যের বিপরীতে ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সম্পৃক্ততা অব্যাহত থাকলে তা যুক্তরাষ্ট্র, গোটা অঞ্চল এবং বিশ্বজুড়ে এক ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

এদিকে ইরান জানিয়েছে, মার্কিন হামলায় তাদের অত্যন্ত সুরক্ষিত ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় খুবই সামান্য ক্ষতি হয়েছে। তবে কোন পক্ষের কথা শেষ পর্যন্ত সত্য প্রমাণিত হয়, তা সময়ই বলে দেবে।

যদি ইরান পাল্টা জবাব দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় যেতে বাধ্য হতে পারে। এই পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক করে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, এর ফলে ‘একটি বিশৃঙ্খলার চক্র’ তৈরি হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্য ইতিমধ্যেই চরম উত্তেজনার মধ্যে রয়েছে।

‘দুই সপ্তাহ’ হয়ে গেল ‘দুই দিন’

গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প ইরানকে দুই সপ্তাহ সময় দেন। কিন্তু সেই সময়সীমা এসে ঠেকল দুই দিনে। গতকাল শনিবার রাতে হামলার পদক্ষেপের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

প্রশ্ন উঠেছে, ওই ‘দুই সপ্তাহ’ কি আসলে কৌশলী প্রতারণা ছিল? ইরানকে কি একরকম নিশ্চিন্ত করতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প? নাকি তার মনোনীত ‘শান্তির দূত’ স্টিভ উইটকফের নেতৃত্বে যে গোপন আলোচনা চলছিল, তা ভেঙে পড়েছিল?

হামলার পরপরই এখনো অনেক কিছু অস্পষ্ট। তবে ট্রাম্প তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টে ও টেলিভিশনে ভাষণে শান্তির সম্ভাবনার দরজা খোলা রাখার চেষ্টা করেন।

তবে এটিকে হয়তো অতিরিক্ত আশাবাদ হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ, ইসরায়েল ইরানের সামরিক সক্ষমতা দুর্বল করতে যতই চেষ্টা করুক না কেন, আয়াতুল্লাহ খামেনির হাতে এখনো অনেক অস্ত্র রয়ে গেছে। পরিস্থিতি খুব দ্রুত জটিল ও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।

পারমাণবিক কর্মসূচির ‘মুকুট রত্ন’ ফোরদোসহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার পর ইরান কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা দেখতে এখন শুরু হয়েছে প্রতীক্ষার পালা।

ট্রাম্প আশা করছেন, মার্কিন এই হামলা ইরানকে আলোচনার টেবিলে আরও বড় ছাড় দিতে বাধ্য করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—যে দেশ ইসরায়েলি হামলার মধ্যেও সংলাপে রাজি হয়নি, সেখানে মার্কিন বোমা পড়তে থাকলে তাদের মনোভাব আরও কঠোর হওয়াটাই স্বাভাবিক।

আর ট্রাম্প যদিও ইঙ্গিত দিচ্ছেন, এই মার্কিন হামলাটি ছিল একটি একক ও সফল অভিযান। তবে যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে আবার হামলা চালানোর জন্য চাপ বাড়বে। আর তা না করলে প্রেসিডেন্ট সামান্য সামরিক লাভের বিনিময়ে একটি বড় রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছেন।

রাজনৈতিক ঝুঁকি

ট্রাম্পের নেওয়া এই ঝুঁকি কেবল আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নয়, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার সম্ভাবনায় আগেই ডেমোক্র্যাটদের কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন ট্রাম্প। এমনকি তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ মুভমেন্টের ভেতর থেকেও এর বিরোধিতা এসেছে।

অনেকে মনে করছেন, ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে জাতির উদ্দেশে ভাষণের সময় ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও ও প্রতিরক্ষাসচিব হেগসেথকে পাশে রাখার মাধ্যমে নিজ দলের মধ্যে ঐক্যের বার্তা দিতে চেয়েছেন।

যদি যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এই হামলাই শেষ হামলা হয়ে থাকে, তাহলে ট্রাম্পের নিজ দলের ভেতরে যে বিভক্তি, তা শুধরে নেওয়া যাবে। তবে ট্রাম্প যদি এই পদক্ষেপকে দীর্ঘায়িত করে যুক্তরাষ্ট্রকে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে টেনে নিয়ে যান, তাহলে নিজ ঘরেই প্রতিবাদের মুখে পড়তে হবে তাঁকে।

নির্বাচনী প্রচারণায় বারবার বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্টদের সময়ে বিদেশি যুদ্ধে মার্কিন হস্তক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন ট্রাম্প। এমনকি নিজের প্রথম মেয়াদে কোনো যুদ্ধ না করা নিয়ে গর্ব তাঁর। এরপরও ট্রাম্পের গতকাল শনিবারের এই হামলা একধরনের আগ্রাসী পদক্ষেপই বলা যায়।

তবে ট্রাম্প তাঁর চাল দিয়েছেন। কিন্তু এখন কী হবে, সেটার পুরোটা আর ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণে নেই। ট্রাম্প নিজেই বলছেন এ কথা। খবর:বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে