রোববার, ১৫ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঈদ পুনর্মিলনী ও সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠিত

জাহাঙ্গীর আলম, বিশেষ প্রতিনিধি
  ১৪ জুন ২০২৫, ১৪:৪৫
কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঈদ পুনর্মিলনী ও সাংস্কৃতিক উৎসব অনুষ্ঠিত
কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে আয়োজন করা হয় ব্যতিক্রমধর্মী ঈদ পুনর্মিলনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে আয়োজন করা হয় ব্যতিক্রমধর্মী ঈদ পুনর্মিলনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ‘বন্দিদের মানবিক মর্যাদা ও ঈদের আনন্দ সবার জন্য’ এই মূলমন্ত্রকে ধারণ করে তিন দিনব্যাপী আয়োজিত এ অনুষ্ঠান ছিল ব্যতিক্রমী, সুশৃঙ্খল এবং হৃদয়স্পর্শী। এই আয়োজন কেবল একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি যেন একটি ভালোবাসার আবহ তৈরি করে দেয় কারাগারের ভেতরে।

ঈদের আগে থেকেই কারাগারজুড়ে প্রস্তুতির ব্যস্ততা লক্ষ করা যায়। কারা কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ৫ জুন কারাগারের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে একই রঙ ও ডিজাইনের শাড়ি ও পাঞ্জাবি বিতরণ করা হয়। এই ঐক্যবদ্ধ পোশাক ধারণা স্টাফদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের চিত্র ফুটিয়ে তোলে।

1

পরদিন, ৬ জুন তারিখে অসহায় ও দরিদ্র বন্দি এবং তাঁদের সঙ্গে থাকা শিশুদের মাঝে ঈদের পোশাক বিতরণ করা হয়। এছাড়াও মহিলা বন্দীদের জন্য কসমেটিকস সামগ্রী প্রদান এবং ‘মেহেদি উৎসব’-এর আয়োজন করা হয়, যাতে বন্দিনীরা ঈদের উৎসবে নিজেদের অংশীদার ভাবতে পারেন। এ উদ্যোগ ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং মানবিক।

এছাড়া ৭ জুন, ঈদের দিন সকালে বন্দিদের জন্য দুটি ঈদের জামাত আয়োজন করা হয়। জামাত শেষে সকলে কোলাকুলি করে একে অপরের ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এরপর সারাদিনব্যাপী বন্দি ও স্টাফদের জন্য উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। মেনুতে ছিল গরুর মাংস, মুরগি, মাছ, পোলাও এবং অন্যান্য সুস্বাদু খাবার যা সকলকে উৎসবের আনন্দে মাতিয়ে তোলে।

এছাড়াও ঈদের দিন বন্দিদের মধ্যে খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। মহিলা ও পুরুষ বন্দিদের জন্য আলাদা আলাদা খেলা আয়োজনের ফলে সকলে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে অংশগ্রহণ করতে পারেন। বিকেলে পৃথকভাবে মহিলা ও পুরুষ বন্দিদের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেখানে বন্দিরাই আবৃত্তি, সংগীত ও অন্যান্য পরিবেশনার মাধ্যমে তাদের প্রতিভা প্রকাশ করেন।

ঈদের দিন থেকে শুরু করে ৯ জুন পর্যন্ত মোট তিন দিন আগত দর্শনার্থীদের জন্য রাখা হয় বিশেষ রিসেপশন ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা। শিশুদের মধ্যে বিতরণ করা হয় চকলেট, চিপস, কেক ও বেলুন, যা তাদের মুখে এনে দেয় নির্মল হাসি। দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিদিন বিতরণ করা হয় মিষ্টি, পায়েস ও অন্যান্য পরিবেশনা।

সাথে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাও চালু রাখা হয় এই তিন দিনে, যেখানে দর্শনার্থীরা প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেন। ওয়াশরুমগুলোর নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা হয় এবং প্রতিমুহূর্তে পানির সরবরাহ ও স্যালাইনের ব্যবস্থা রাখায় দর্শনার্থীরা ছিল সন্তুষ্ট।

ঈদের দিন থেকে পরবর্তী দুই দিন বন্দিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়। বন্দিদের মোবাইলে পরিবারের সঙ্গে কথা বলানোর ব্যবস্থা এবং বাড়ি থেকে আনা খাবার গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়, যা বন্দিদের মানসিক প্রশান্তি ও আত্মিক তৃপ্তির বড় উৎস হয়ে ওঠে।

কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গত ১২ জুন বন্দিদের মাঝে মৌসুমী ফল বিতরণ করা হয়। ফলের মধ্যে ছিল আম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদি। এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ বন্দিদের মাঝে ঈদের আমেজকে দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে।

১৩ জুন অনুষ্ঠিত হয় কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের জন্য বিশেষ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। দিনব্যাপী নানা প্রতিযোগিতা—ফুটবল টুর্নামেন্ট, ইউনিফর্ম পরিধান প্রতিযোগিতা, ভাবিদের জন্য চেয়ার সিটিং ও পিলো পাসিং—উৎসবের আমেজে ভিন্নমাত্রা যোগ করে।

ঈদের পূর্ণতা আসে ১৩ জুন রাতে আয়োজিত ‘স্টাফ ও তাঁদের পরিবারের জন্য ঈদ পুনর্মিলনী সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা’-তে। এই সন্ধ্যায় গান, কবিতা, নাটিকা ও হাস্যরসাত্মক পরিবেশনা সবাইকে আপ্লুত করে তোলে। পরে কেক কাটা ও পুরস্কার বিতরণীর মধ্য দিয়ে তিন দিনব্যাপী ঈদ আয়োজনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

কারাগারে বন্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা এক দর্শনার্থী বলেন, কারাগারে এমন পরিবেশ আগে দেখি নাই। কারা কর্মকর্তা -কর্মচারী থেকে শুরু করে বন্দী ও দর্শনার্থীদের জন্য চমৎকার ও আনন্দদায়ক যে আয়োজন করেছে তা নিসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

এই আয়োজনের ব্যাপারে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হালিমা খাতুনের কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারা মহাপরিদর্শকের নির্দেশনা ও মানবিকতার জায়গা থেকে এই আয়োজন করেছি। কারা কর্মকর্তা -কর্মচারী, বন্দী ও দর্শনার্থী সর্বোপরি সকলের মধ্যে ঈদের আনন্দকে আরো প্রাণবন্ত করার জন্য ও কারাগারে অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা এই আয়োজন করেছি।

সুশীল সমাজ মনে করে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের এই ঈদ পুনর্মিলনী ও সাংস্কৃতিক আয়োজন একটি মানবিক দৃষ্টান্ত। এটি প্রমাণ করে যে, কারাগারের প্রাচীরের ভেতরেও ভালোবাসা, আনন্দ এবং সংস্কৃতি স্থান করে নিতে পারে। বন্দিদের মধ্যে মনোবল ও সামাজিক আচরণ উন্নয়নে এই ধরনের আয়োজনে গভীর প্রভাব পড়ে। এ আয়োজন নিঃসন্দেহে দেশের অন্যান্য কারাগারগুলোর জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে