শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

ভারতের মুসলিম নাগরিকদের ‘অস্ত্রের মুখে অবৈধভাবে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে নয়াদিল্লি’

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন
  ১৯ জুন ২০২৫, ২২:০৫
আপডেট  : ১৯ জুন ২০২৫, ২২:০৬
ভারতের মুসলিম নাগরিকদের ‘অস্ত্রের মুখে অবৈধভাবে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে নয়াদিল্লি’
২৬ এপ্রিল ভারতের আহমেদাবাদে অভিযান চালিয়ে বহু মানুষকে আটক করে ভারতের পুলিশ। ছবি: সংগৃহীত

ভারত সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলিমদের অবৈধভাবে বাংলাদেশে নির্বাসিত করার অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে নিপীড়নের অভিযান আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর মতে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ভারতজুড়ে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী বলে সন্দেহ করছে নয়াদিল্লি।

তাদের অনেককে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত করে সীমান্ত পার করে প্রতিবেশী মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আইনজীবী এবং নির্বাসিতদের বিবরণ অনুসারে, অবৈধভাবে নির্বাসিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে - এমন ব্যক্তিদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকরাও রয়েছেন।

বেশ কয়েকটি বিবরণ অনুসারে, যারা 'পুশ ইন' করার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল তাদের ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বন্দুকের মুখে হুমকি দিয়েছিল।

এরপর থেকে প্রায় ২০০ জনকে বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষীরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে শনাক্ত করার পর ভারতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এদের মধ্যে কিছু লোককে বাড়ি ফেরার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ভূখণ্ড দিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সিনিয়র গবেষক তাসকিন ফাহমিনা বলেন, আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করার পরিবর্তে, ভারত মূলত মুসলিম এবং নিম্নআয়ের সম্প্রদায়কে তাদের নিজস্ব দেশ থেকে কোনো সম্মতি ছাড়াই বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে।

ভারতের এই চাপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিল যে, তারা যেন সরকারি পদ্ধতি অনুসারে পরামর্শ এবং যাচাই-বাছাই ছাড়াই সীমান্ত দিয়ে 'পুশ ইন' বন্ধ করে।

কিন্তু নয়াদিল্লি সেই চিঠিগুলোর কোনো উত্তর দেয়নি বলে জানানো হয়েছে।

ভারত থেকে যাদের বিতাড়িত করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন ৬২ বছর বয়সী হাজেরা খাতুন। তিনি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী একজন বয়স্ক নারী।

তার মেয়ে জোরিনা বেগম বলেন, তাদের কাছে প্রমাণ করার জন্য নথি রয়েছে যে, তার মায়ের পরিবারের দুই প্রজন্ম ভারতে জন্মগ্রহণ করেছে। জোরিনা প্রশ্ন করেন, 'তিনি কীভাবে বাংলাদেশি হতে পারেন?'

২৫ মে পুলিশ হাজেরা খাতুনকে তুলে নিয়ে যায় এবং পরের দিন ১৪ জন মুসলিমের সাথে তাকে একটি ভ্যানে তুলে দেয়। তাদেরকে মাঝরাতে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়।

হাজেরা খাতুন বলেন, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) তাদের সীমান্ত পার হতে বাধ্য করে।

হাজেরা বলেন, তারা আমাদের সাথে পশুর মতো আচরণ করেছিল। আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম যে, আমরা ভারতীয়, কেন আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করব? কিন্তু তারা আমাদের বন্দুক দেখিয়ে হুমকি দিয়েছিল, 'যদি তোমরা না যাও, তাহলে আমরা তোমাদের গুলি করব।'

হাজেরা উল্লেখ করেন, 'ভারতীয় দিক থেকে চারটি গুলির শব্দ শোনার পর আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম এবং দ্রুত সীমান্ত পার হয়ে হেঁটে চলে গিয়েছিলাম।'

বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা এই দলটিকে আটক করে মাঠের একটি অস্থায়ী শিবিরে রাখে।

হাজেরা জানান, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ তাদের দলটিকে থাকতে দেবে না, কারণ নথিপত্রে দেখা গেছে, তারা ভারতীয় নাগরিক। এরপর তাদের একটি ট্রাকে করে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয় এবং হেঁটে ভারতে যেতে বলা হয়।

হাজেরা খাতুন বলেন, আমরা যখন ফিরে আসি, তখন পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল।

আমাদের বন এবং নদীর মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে হয়েছিল ... আমরা এত ভয় পেয়েছিলাম যে, ভেবেছিলাম যদি বিএসএফ অফিসাররা আমাদের ফিরে আসতে দেখে, তাহলে তারা আমাদের মেরে ফেলবে। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমরা মারা যাব।'

অবশেষে ৩১ মে তিনি তার গ্রামে (ভারতের মধ্যে) ফিরে যান। তার পরিবারের মতে, তার আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং গভীরভাবে আহত ছিলেন।

এপ্রিল মাসে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে সশস্ত্র হামলায় ২৫ জন পর্যটক এবং একজন গাইড নিহত হওয়ার পর, তথাকথিত 'অবৈধ বাংলাদেশিদের' বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকারের ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন শুরু হয়। মূলত এরপর থেকে বিজেপি সরকার 'বহিরাগতদের' বহিষ্কারের কথা বলে।

গত মে মাসে অপারেশন সিন্ধুর শুরু হওয়ার পর ব্যাপক ধরপাকড় বৃদ্ধি পায়, যখন ভারত প্রতিবেশী মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানে হামলা চালায়।

১১ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে তাদের হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার অংশ হিসেবে দেশের ২০ কোটি মুসলিমকে নির্যাতন, হয়রানি এবং ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ রয়েছে। যদিও বিজেপি সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে।

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে উত্তর-পূর্ব রাজ্য আসামে মুসলিমদের সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যবস্তু এবং নির্বাসন করা হয়েছে। কারণ বিজেপি-শাসিত রাজ্য সরকার 'অনুপ্রবেশকারী' আখ্যা দিয়ে সেসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী অভিযান জোরদার করেছে। মানবাধিকার কর্মীদের মতে, রাজ্যে সম্প্রতি আটক করা প্রায় ১০০ জন নিখোঁজ রয়েছে।

এই সপ্তাহে আসামের কট্টরপন্থী বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা বলেছেন, এখন রাজ্যের নীতি হলো 'অবৈধ বিদেশিদের' স্বয়ংক্রিয়ভাবে বহিষ্কার করা। 'এই প্রক্রিয়া আরও তীব্র এবং ত্বরান্বিত করা হবে'।

যারা ভারতীয় নাগরিক বলে দাবি করেছেন, তাদের সকলেই ভারতে ফিরে যেতে পারেনি। বাংলাদেশে এখনো আটকে থাকাদের মধ্যে রয়েছেন আসামের ৬৭ বছর বয়সী মালেকা বেগম, যাকে ২৫ মে পুলিশ আটক করে।

বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম থেকে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় ফোনে কথা বলতে গিয়ে মালেকা বলেন, ২৭ মে মধ্যরাতে বাংলাদেশে পাঠানো প্রায় ২০ জন মুসলিমের একটি দলের মধ্যে তিনিই একমাত্র নারী ছিলেন। তিনি বলেন, বিএসএফ তাদের বন্দুকের মুখে সীমান্ত অতিক্রম করার নির্দেশ দিয়েছিল। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ এবং সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারেন না।

মালেকা বেগমের ছেলে ইমরান আলী বলেন, তার মা ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন, তা প্রমাণ করার জন্য তার কাছে নথিপত্র ছিল। তার সাত ভাইবোনেরও প্রমাণ ছিল।

তিনি বলেন, তাকে বাংলাদেশে নির্বাসন দেওয়া সম্পূর্ণ অবৈধ। আমি এখন বুঝতে পারছি না কীভাবে আমরা তাকে বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারি। সে বৃদ্ধ এবং অসুস্থ। আমরা তাকে নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন।

এসব বিষয়ে আসাম পুলিশ এবং বিএসএফ বারবার মন্তব্যের জন্য অনুরোধ করলেও তারা দ্য গার্ডিয়ানের অনুরোধে কোনো সাড়া দেয়নি।

নয়াদিল্লি গুজরাট, রাজস্থান এবং মহারাষ্ট্র রাজ্য থেকেও শত শত মানুষকে - যাদের বেশিরভাগই মুসলিম, নির্বাসিত করা হয়েছে।

গুজরাটে পুলিশ ৬,৫০০ জনেরও বেশি সন্দেহভাজন 'বাংলাদেশি নাগরিককে' আটক করার দাবি করেছে। কিন্তু পরে ঘোষণা করা হয়, তাদের মধ্যে মাত্র ৪৫০ জন অবৈধ বলে প্রমাণিত হয়েছে।

গত সপ্তাহেও বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা মুম্বাই থেকে আটকের পর 'পুশ ইন' করে চার মুসলিম পুরুষকে ফিরিয়ে দেয়। তখন জানা গিয়েছিল, এসব লোক পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে আসা ভারতীয় শ্রমিক।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী ভারতের এই পদক্ষেপকে 'মানবিক শাসনব্যবস্থার বিচ্যুতি' বলে নিন্দা জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, এটি আন্তর্জাতিক আইন এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মর্যাদার পরিপন্থী। মানুষকে বনে ফেলে রাখা, নারী ও শিশুদের নদীতে জোর করে ফেলা, অথবা ভূমিহিন শরণার্থীদের সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার মতো কাজ মানবাধিকারের নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে