গত বছরের জুলাইয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে অভ্যুত্থান চলাকালে আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন ছয় শিক্ষার্থী। কেউ শহীদ হয়েছেন জুলাইয়ের মাঝামাঝি, কেউ আগস্টের শুরুতে।
তাদের কেউ কেউ মৃত্যুর কিছুদিন আগে ফেসবুকে লিখে গিয়েছেন বর্ণময় বিদায়বার্তা। আর আজ, তাদের সহপাঠীরা পরীক্ষার হলে ঢোকার আগে চোখের পানি মুছেছে। কারণ বন্ধুরা নেই। আছে কেবল তাদের গল্প, কিছু স্মৃতি, কিছু না-পাওয়া।
আজ শুরু হয়েছে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। দেশজুড়ে লাখো শিক্ষার্থী সকালে কেন্দ্রে উপস্থিত হলেও কিছু চিরচেনা মুখ আজ অনুপস্থিত—কারণ, তাঁরা আর নেই।
গত বছরের জুলাই আন্দোলনে নিহত হওয়া কয়েক তরুণের আজ পরীক্ষায় বসার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষার হলে তাঁদের জন্য আজ বরাদ্দ শুধু শূন্যতা।
আবদুল্লাহ, ফারহান, আহনাফ, মারুফ, সৈকত, সাদ, ইমাম ও ইয়াসির—এরা সবাই দেশের বিভিন্ন কলেজে একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিল।
উচ্চমাধ্যমিকের রেজিস্ট্রেশনও করেছিল। কেউ হতে চেয়েছিল গবেষক, কেউ চিকিৎসক, কেউবা ডিজাইনার। কিন্তু আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে তাঁদের জীবনের পথচলা থেমে যায়।
"ছেলেটা পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা বলেছিল, আজ তার রেজিস্ট্রেশন কার্ডটাই বুকে চেপে রাখছি," —কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন এক শহীদ মায়ের।
বন্ধুরা ফোন করে শুধু বলেছে, ‘আমাদের জন্য দোয়া করবেন’
গত বছরের ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সে। তার মা ফাতেমা তুজ জোহরা জানালেন, পরীক্ষার আগের রাতে তার বন্ধুরা ফোন করে শুধু কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, “খালাম্মা, আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”
তিনি বলেন, “ছেলে তো নেই, ওদের মধ্যেই এখন আমার ছেলে।”
তাঁর ছোট ছেলে বর্তমানে ক্যান্সারে আক্রান্ত, স্বামী হারিয়েছেন মার্চে। এই মা যেন জীবনযুদ্ধের প্রতিটি রণাঙ্গনে একা সৈনিক।
'ছেলে ছিল বন্ধু, তার অভাব অপূরণীয়'
মারুফ হোসেনের বাবা মো. ইদ্রিস বলেন, ছেলেকে আন্দোলনের সময় গুলি করে হত্যা করা হয়। মরদেহও দেওয়া হয়নি সহজে। তিন দিন পর হাসপাতালে গিয়ে ছেলের মরদেহ নিতে হয়েছে অর্ধগলিত অবস্থায়।
“ছেলে শুধু আমার সন্তান ছিল না, আমার বন্ধু ছিল। তার চলে যাওয়ায় আমরা যেন দুনিয়ায় নিঃস্ব হয়ে গেছি।”
তিনি জানান, কবরটিও অস্থায়ী, ১০ লাখ টাকা না দিলে তা রাখা যাবে না—এমন হুমকি দেওয়া হয়েছে তাঁকে।
স্মৃতি ছুঁয়ে কান্নায় ভেঙে পড়া মা-বাবা
শাহীন কলেজের ছাত্র আহনাফের মা গিয়েছিলেন ছেলের স্মৃতিফলকে। ছেলের নামাঙ্কিত ফলকে হাত ছুঁয়ে অঝোরে কেঁদেছেন। একই কলেজ থেকে ‘গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়েছে শহীদ সাদকেও। পরীক্ষার আগের দিন সাদ তার ফেসবুকে লিখেছিল, “যে দেশের জন্ম রক্তে, তার ইতিহাসও রক্তে রচিত হয়।”
ইমাম হাসান তায়িম, যাকে কাছ থেকে গুলি করা হয়েছিল—তার ভাই বলেন, “পুলিশ যেন ২০০ গুলি করেছিল ওকে। বাবা স্ট্রোক করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, মা বিষণ্নতায় ভুগছেন।”
“তোমরা নেই, কিন্তু তোমাদের ঋণ থেকে যাবে” আজকের দিনে বন্ধুরা ফেসবুকে লিখেছে, “তোমাদের খুব মনে পড়ছে ভাই। এই ঋণ আমরা কোনোদিন শোধ করতে পারব না।” পরীক্ষার দিন যে হাসিমুখে সেলফি তোলা হতো, সেই জায়গা জুড়ে এখন শুধু অশ্রু, আরেকটি খালি বেঞ্চ।
এই তরুণরা আর কোনো দিন পরীক্ষার হলে যাবে না, মায়ের হাতের রান্না খাবে না, নতুন জামায় ঈদ করবে না। কিন্তু তাঁদের শূন্যতা প্রশ্ন তুলেছে—এই আত্মত্যাগের দায় কে নেবে?