পেনিসিলিন থেকে চেতনানাশক, স্যাকারিন থেকে চুইংগাম—পৃথিবী বদলে দেওয়া এমন কিছু জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে স্রেফ দুর্ঘটনা বা ভুলের কারণে! সেরকম ৫টি আবিষ্কারের কথা বলছি।
চেতনানাশক
আবিষ্কারক: হোরেস ওয়েলস, মার্কিন দন্ত্যচিকিৎসক (১৮১৫–১৮৪৮) আবিষ্কারের বছর: ১৮৪৪
যা ঘটেছিল: প্রথম দিকে নাইট্রাস অক্সাইড ব্যবহার করা হতো শুধু স্টেজ শো–তে। ‘লাফিং গ্যাস’ নামে পরিচিত এই গ্যাসের উপস্থিতিতে মানুষ অবিশ্বাস্যভাবে হাসতে শুরু করে। হরেসের এক দন্ত্যচিকিৎসক বন্ধু একটি স্টেজ শোয়ের জন্য অতিরিক্ত লাফিং গ্যাস গ্রহণ করেন এবং শো করতে করতে তাঁর পা কেটে গিয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। অথচ হরেসের সেই বন্ধু বুঝতেই পারেননি যে তিনি এত বেশি ব্যথা পেয়েছেন!
ফলাফল: নাইট্রাস অক্সাইডের ব্যবহার শুরু হলো মূলত অস্ত্রোপচার ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা চেতনানাশক হিসেবে।
চুইংগাম
আবিষ্কারক: টমাস অ্যাডামস, মার্কিন উদ্ভাবক (১৮১৮–১৯০৫)
আবিষ্কারের বছর: ১৮৭১যা ঘটেছিল: শুনুন চুইংগামের ইতিহাস কিন্তু অনেক পুরোনো। প্রাচীন মিসর, গ্রিক ও আজটেক সভ্যতায় চুইংগামের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ১৮৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রথম ফ্লেবারযুক্ত চুইংগাম আনেন ফার্মাসিস্ট জন কলগ্যান। তবে বলছি আধুনিক চুইংগামের কথা। এর আবিষ্কারক টমাস অ্যাডামস। ১৮৬০–এর দশকে মেক্সিকোর অষ্টম প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও লোপেজ দে সান্তা আনা নির্বাসিত হন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে। সে সময় তাঁর সচিব ছিলেন টমাস অ্যাডামস।
তাঁর হাতে মেক্সিকো থেকে আনা ম্যানিলক্যারাগাছের আঠা তুলে দেন সান্তা আনা। পরামর্শ দেন চিকল দিয়ে কৃত্রিম রবার তৈরি করতে। সে সময় রবারের দাম ছিল চড়া। টমাস সেই চিকল দিয়ে বাইসাইকেলের টায়ার, জুতা ও খেলনা তৈরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তবে বাড়ির পাশে ওষুধের দোকানে ছোট্ট একটা মেয়েকে চুইংগাম কিনতে দেখে টমাসের মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। তাঁর মনে পড়ে, সান্তা আনা ও মেক্সিকোর লোকজন চিকল চিবোয়। তাই চিকল দিয়ে চুইংগামই বানিয়ে ফেলেন টমাস। ১৮৬৯ সালে এর সঙ্গে যোগ করেন ফ্লেবার। ১৮৭১ সালে পেটেন্ট করে ছাড়েন বাজারে।
ফলাফল: ‘অ্যাডামস নিউইয়র্ক নাম্বার ওয়ান’ হয়ে গেল পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত চুইংগাম।
স্যাকারিন
আবিষ্কারক: কনস্তান্তিন ফ্যালবার্গ, রুশ রসায়নবিদ (১৮৫০–১৯১০) আবিষ্কারের বছর: ১৮৭৯
যা ঘটেছিল: যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইরা রেমসেন (১৮৪৬–১৯২৭) গবেষণা করছিলেন খনিজ আলকাতরার উপজাত নিয়ে। তাঁর সহকারী ছিলেন কনস্তান্তিন ফ্যালবার্গ। একদিন সন্ধ্যায় কাজ শেষে ফ্যালবার্গ গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে চলে যান খাবার খেতে। হঠাৎ খেয়াল করেন, খাবারটা বেশ মিষ্টি লাগছে।
আর তখনই টের পান, খাবার নয়, আদতে তাঁর হাতে লেগে থাকা একটি রাসায়নিক যৌগই মিষ্টি স্বাদের উৎস। এভাবেই তিনি খুঁজে পান স্যাকারিন। আর এই স্যাকারিন ছিল ক্যালরিমুক্ত।
ফলাফল: ১৮৭৪ সালে ফ্যালবার্গ গোপনে স্যাকারিনের পেটেন্ট করে ফেলেন। ক্যালরি ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ না থাকায় স্যাকারিনকে চিনির বিকল্প হিসেবে খেতে শুরু করে ডায়াবেটিক রোগীরা। রাতারাতি ধনী হয়ে যান ফ্যালবার্গ। তবে রেমসেন এতে ভীষণ নাখোশ হন।
পেনিসিলিন
আবিষ্কারক: আলেকজান্ডার ফ্লেমিং, স্কটিশ চিকিৎসক ও জীবাণুবিজ্ঞানী (১৮৮১–১৯৫৫) আবিষ্কারের বছর: ১৯২৮
যা ঘটেছিল: ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণার মাঝামাঝি একটা পর্যায়ে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ছুটিতে চলে যান। ছুটিতে যাওয়ার আগে একটা নোংরা পেট্রি ডিশ (গবেষণাগারের ছোট বাটিবিশেষ) রেখে যান গবেষণাগারের সিংকে।
ছুটি শেষে ফিরে আসার পর ফ্লেমিং দেখেন যে ফেলে রাখা পেট্রি ডিশে ব্যাকটেরিয়া জমে আছে। শুধু যে অংশে পেনিসিলিয়াম ছত্রাক জমে ছিল, সেই অংশে কোনো ব্যাকটেরিয়া নেই!
ফলাফল: এই ঘটনার ফলাফল হিসেবে দুটি ঘটনা ঘটল।
এক. পেনিসিলিয়াম ছত্রাক থেকে পেনিসিলিন আবিষ্কৃত হলো।
দুই. ফ্লেমিংয়ের স্ত্রী সারাহ ম্যারিয়ন ম্যাকএলরয় একজন গৃহপরিচারিকা নিয়োগ দিলেন গবেষণাগার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য! পেনিসিলিন ছিল ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করা প্রথম ওষুধ। পেনিসিলিন আজও ব্যবহৃত হচ্ছে।
মাইক্রোওয়েভ ওভেন
আবিষ্কারক: পার্সি স্পেনসার, মার্কিন প্রকৌশলী (১৮৯৪–১৯৭০)
আবিষ্কারের বছর: ১৯৪৫
যা ঘটেছিল: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদারি কোম্পানি ‘রেথিওন’এ কাজ করতেন পার্সি স্পেনসার। রাডার প্রযুক্তি আরও উন্নত করার জন্য গবেষণা করছিলেন তিনি। তখন রাডারের জন্য মাইক্রোওয়েভ উৎপন্ন করতে ব্যবহৃত হতো ‘ক্যাভিটি ম্যাগনেট্রন’ নামের যন্ত্র। একদিন ওই যন্ত্রের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্পেনসার, তাঁর পকেটে ছিল একটা চকলেট বার।
স্পেনসার হঠাৎ খেয়াল করেন, চকলেটটি গলে গেছে! কারণ খুঁজতে লাগলেন স্পেনসার। ক্যাভিটি ম্যাগনেট্রনের পাশে রাখলেন পপকর্ন। ফুটফাট করে পপকর্ন ফুটতেই নিশ্চিত হলেন মাইক্রোওয়েভের কারণেই এমনটা হচ্ছে। শুরু করলেন আরও গবেষণা। এভাবেই উদ্ভাবিত হলো মাইক্রোওয়েভ ওভেন।
ফলাফল: ১৯৪৭ সালে রেথিওন বাজারে আনে প্রথম বাণিজ্যিক মাইক্রোওয়েভ ওভেন ‘রাডার্যাঞ্জ’। ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি লম্বা ওভেনটির দাম ছিল ৫ হাজার ডলার, এখনকার হিসাবে প্রায় ৭০ হাজার ডলার!