শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

নতুন কৌশলে বিএনপি-জামায়াতের শত শত নেতাকর্মী গ্রেপ্তার

সাখাওয়াত হোসেন
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:০১
নতুন কৌশলে বিএনপি-জামায়াতের শত শত নেতাকর্মী গ্রেপ্তার

সরকারের পদত্যাগের মাধ্যমে অক্টোবরের মধ্যে রাজপথের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চায় বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে ১২ দিনের গুচ্ছ কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছে দলটি। তবে এতে সফলতা না আসলে হরতাল অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। আর এতে সরকার বাধা দিলে অসহযোগ আন্দোলনের দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। দেওয়া হতে পারে রাজধানী ঢাকা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নির্বাচন কমিশন ও সচিবালয় কেন্দ্রিক কর্মসূচির ঘোষণা।

এদিকে বিএনপির সঙ্গে কোনোরকম বোঝাপড়া ছাড়াই রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াত। শিগগিরই নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে দলটি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলমান এক দফার আন্দোলনে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামার সিদ্ধান্তের কথা এরই মধ্যে সারা দেশের দায়িত্বশীল নেতাদের জানিয়েছেন দলীয় হাইকমান্ড। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত রাজপথ নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর পণ নিয়েছে। এ জন্য তারা তাদের নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে রাজপথে ত্রিমুখী উপস্থিতি রক্তক্ষয়ী সংঘাত-সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। এ আশঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন গোয়েন্দারা। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা নতুন কৌশলে নীরবে ধরপাকড় অভিযানে নেমেছে। চলমান অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ধরপাকড় না করে তৃণমূলের সক্রিয় কর্মীদের আটকের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

যাতে তাদের গ্রেপ্তারে রাজনৈতিক অঙ্গন সহসা সরগরম হয়ে না ওঠে। তবে সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিয়ে পরবর্তীতে সময়-সুযোগ বুঝে এ অভিযান জোরদার করা হবে বলে পুলিশের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

তবে নিত্যনতুন গায়েবি মামলা, পুরনো নাশকতার ঘটনায় সম্পৃক্ততা, সন্দেহভাজন কিংবা নাশকতার পরিকল্পনার কথিত অভিযোগ এনে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ে কৌশলী অভিযান জোরদার করা হলে হিতে বিপরীত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, এ ইস্যুতে নিরপেক্ষ থাকার জন্য বেশ আগে থেকেই বিশে^র বিভিন্ন রাষ্ট্র আগে থেকেই সরকারকে নানাভাবে চাপ দিচ্ছে। বিশেষ করে আন্দোলনের আগে গায়েবি মামলায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার-হয়রানি ও নির্যাতন না করার ব্যাপারে বারংবার সতর্ক করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নতুন করে ব্যাপক হারে ধরপাকড় অভিযান চালানো হলে সরকার বেকায়দায় পড়তে পারে।

অন্যদিকে বিরোধী পক্ষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আন্দোলন কর্মসূচি চালাতে না পারলে আত্মগোপনে থেকে চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে পারে। এমনকি জঙ্গি তৎপরতা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে পুলিশের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিগত সময়ের মতো বিরোধী দলের আন্দোলন কর্মসূচির আগে গণহারে ধরপাকড় অভিযান চালানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে সুনির্দিষ্ট মামলার ভিত্তিতে নীরবে ধরপাকড় অভিযান অব্যাহত রাখা হবে। পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে নতুন কৌশল নেবে পুলিশ। মিছিল, সভা-সমাবেশে যোগ দেওয়ার পথ একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার না করে অভিযুক্ত আসামিদের একজন-দু’জন করে বাসা-বাড়ি, কর্মস্থল কিংবা যাতায়াতের পথে আটক করা হবে। সুনির্দিষ্ট মামলায় আটককৃতদের কারও আদালত থেকে জামিন নেওয়া থাকলে পুলিশ যাচাই-বাছাই শেষে তাদের ছেড়ে দিবে। ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে। এ কৌশলেই এখন ধরপাকড় অভিযান চালানো হচ্ছে।

তবে ধরপাকড়ের শিকার বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের অনেকের অভিযোগ, স্থায়ী জামিনে থাকা সত্ত্বেও তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। আটককৃতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে না পাঠিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের হেফাজতে দীর্ঘ সময় আটকে রাখছে। এ সময় তাদের ভয়ভীতি দেখানোর পাশাপাশি হয়রানি-নির্যাতন করা হচ্ছে। কারাগারে যাওয়ার আগে তারা অনেকে তাদের গ্রেপ্তারের খবর স্বজনদের জানাতে পারছেন না।

এদিকে গত কয়েকদিনে পুলিশের পক্ষ থেকে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ে সাঁড়াশি কোনো অভিযান পরিচালনার কথা বলা না হলেও বিচ্ছিন্নভাবে বিরোধী শিবিরের বিভিন্ন পর্যায়ের শত শত নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে। তাদের স্বজনদের অনেকের অভিযোগ, পুলিশ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠাচ্ছে। অথচ এ খবর তারা দুই-তিন দিন পরে পাচ্ছেন।

রাজধানীর ইস্কাটন এলাকার বাসিন্দা বিএনপিকর্মী আব্দুর রহমানের এক নিকটাত্মীয় এ প্রতিবেদককে জানান, আটকের তিন দিন পর তাকে (রহমান) গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এই তিন দিন কোথায় কীভাবে রাখা হয়েছে তা তারা জানেন না। পরে কারাগার থেকে তার সেখানে অবস্থানের কথা জানানো হয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনের তারিখ যত ঘনিয়ে আসছে ততই তারা (সরকার) বিভিন্ন অজুহাতে সারা দেশে গণতান্ত্রিক কর্মী এবং বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দিয়ে ধরপাকড় বাড়াচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা আদালতে হাজিরা দিতে ব্যস্ত। নেতাকর্মীরা কেউ বাসায় থাকতে পারছেন না। নির্বাচন থেকে বিরোধী সব দলকে দূরে সরিয়ে রাখতেই এ অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে। বিগত সময়ও একই ধরনের অপকৌশল চালানো হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

দলের নীতি-নির্ধারকরা মনে করেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দুই কৌশলে বিএনপিকে চাপে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ সরকার। প্রথমত, এক দফার আন্দোলনের প্রাণ শক্তি মধ্যম ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাইকারি হারে গ্রেপ্তার। দ্বিতীয়ত, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করে সাজা দেওয়া। যাতে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন। আর এজন্য সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগকে অবৈধভাবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ তোলেন বিএনপির হাইকমান্ড।

তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের দাবি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বাইরে পুলিশ কাউকে আটক করছে না। যাদের বিরুদ্ধে আদালতের অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট রয়েছে, যারা সন্দেহভাজন বা নিয়মিত মামলার আসামি পুলিশ কেবল তাদের গ্রেপ্তার করেছে। এটি পুলিশের রুটিনওয়ার্ক। নিরীহ কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।

তবে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের দাবি, পুলিশের একটি বড় অংশ পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। তারা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের দমন-পীড়নে সরকারের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করছে। আন্দোলনের নামে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা নাশকতা ও নানা ধরনের সহিংসতায় জড়াতে পারে এ ধুঁয়া তুলে শুধু তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অথচ বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচিতে সরকার দলীয় যেসব নেতাকর্মী প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে মহড়া দিয়েছে, গুলি ছুড়েছে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে ‘নাশকতার পরিকল্পনার’ অভিযোগে ময়মনসিংহের ত্রিশালে উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে একটি মামলা করে পুলিশ। মামলায় উপজেলা বিএনপির ২৬ নেতাকর্মীর নামসহ অজ্ঞাতনামা আরও ২০-২৫ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ১২ সেপ্টেম্বর এ মামলায় কানিহারী ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন পলাশ, সদস্য জাকারিয়া রহমান ও হারুনসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে।

গত ১ সেপ্টেম্বর সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর হামলা, বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার ও নাশকতার অভিযোগে নেত্রকোনায় বিএনপি ও দলটির অঙ্গসংগঠনের সহস্রাধিক নেতাকর্মীর নামে ৩টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। এ ঘটনায় পূর্বধলা উপজেলা থেকে আটক ১৩ জন বিএনপি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।

গত ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ৪৬ নেতাকর্মীকে আটক করে ঢাকা মহানগরীর যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। এর আগে তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় নাশকতার অভিযোগে একটি মামলা রুজু করা হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মফিজুল আলমের দাবি, ওইদিন সকালে যাত্রাবাড়ী থানা সংলগ্ন বউবাজার কাজলা এলাকায় মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলেন জামায়াতের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান।

নাশকতার পরিকল্পনা ও পুলিশি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে ১৫ আগস্ট ঠাকুরগাঁওয়ে জেলা জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি কফিল উদ্দীন আহমেদসহ জামায়াত-বিএনপির ২২ নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়। এর আগে তাদের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। গত ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁও জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মুহাম্মাদ আলমগীরসহ সারা দেশে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৬১ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম জানান, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ওয়ারেন্ট ছিল না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিরোধী দলের শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা ও সাজানো মামলা দেওয়া হচ্ছে।

রোববার ঢাকার সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণে যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোট ভাইয়ের জামিনের ব্যাপারে আইনজীবীর পরামর্শ নিতে এসেছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে এলাকার একটি ভাঙচুরের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছিল। তবে এতদিন সে হোস্টেলে থেকে নির্বিঘ্নে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল। ক’দিন আগে বাড়িতে এসে ঘুরে যাওয়ার পথে তাকে আটক করা হয়। যা তারা তাৎক্ষণিক জানতে পারেননি। তার ভাই বিএনপির সক্রিয় নেতাকর্মী না হলেও কট্টর সমর্থক বলে স্বীকার করেন মোস্তাফিজুর।

আইনজীবী মাহবুব আলম জানান, গত কয়েকদিন ধরে মোস্তাফিজুরের মতো অনেক স্বজনেরই আদালত প্রাঙ্গণে নতুন করে আনাগোনা বেড়েছে। বিভিন্ন মামলা, নাশকতার পরিকল্পনা ও সন্দেহভাজন হিসেবে তাদের কারও ছোট ভাই, কারও সন্তান, কারও বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই গ্রেপ্তারের পরপরই এ তথ্য পাননি বলে অভিযোগ তুলেছেন।

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে