হাইব্রিডদের ভিড়ে ত্যাগী নেতাকর্মীরা যেন কোণঠাসা হয়ে না পড়ে- সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে বিএনপি। সেই সঙ্গে গত ১৭ বছরে ত্যাগী, পরীক্ষিত ও নির্যাতনের স্বীকার এমন একটি নেতাকর্মীকেও অবমূল্যায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
জানা গেছে, সারাদেশে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের ‘অবাধ্য’ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের স্ত‚প জমা হয়েছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর হামলা, দখল, অর্থ দাবি, আধিপত্য বিস্তার এবং দলীয় নির্দেশনা অমান্য করাসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গত আড়াই মাসে দেড় হাজারের বেশি নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে বহিষ্কার, অব্যাহতি, পদাবনতি ও কমিটি বাতিল করার মতো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরও অভিযোগ আসা এখনো থামেনি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে অনেকের ক্ষেত্রে অভিযোগ আসছে এমন প্রমাণও পেয়েছে দলের হাইকমান্ড। সে ক্ষেত্রে বেশ কয়েকজন নিরপরাধ হয়েও শাস্তি পেয়েছেন। সঙ্গত কারণে অভিযোগ আরও বেশি যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতা জানান, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সুবিধাভোগী ও অনুপ্রবেশকারীর ভিড়ে ত্যাগী নেতাকর্মীরা বাহ্যিকভাবে কোণঠাসা মনে হলেও দ্রæত সময়ের মধ্যে এই বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে। গত ১৭ বছরে বিএনপির দুর্দিনে যারা জীবন বাজি রেখে দলের জন্য কাজ করেছে তারা দলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেই সময়ে, ২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থার সরকারের সময় এবং ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কার কি ভূমিকা ছিল সেসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে কারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, ১/১১ প্রেক্ষাপটে দল ও জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কারা ষড়যন্ত্র করেছেন তাদের একটি তালিকাও করা হচ্ছে। পাশাপাশি মামলা-হামলা কিংবা নির্যাতনের মুখেও ছিলেন না, ঘরছাড়াও হতে হয়নি, বিগত দিনে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন, আওয়ামী সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন তাদের তালিকাও হচ্ছে। সেইসঙ্গে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে যেসব নেতাকর্মী রাজপথ কাঁপিয়েছেন, মামলা-হামলায় সর্বশান্ত হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছেন তাদের ডাটাও সংগ্রহে রাখা হচ্ছে।
বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, নব্য বিএনপি নামধারীরা দলের হর্তাকর্তা হয়ে ত্যাগীর ওপর ছড়ি ঘুরাবেন-তা হবে না। প্রকৃত দলপ্রেমীদের অবশ্যই মূল্যায়ন করা হবে।
এবিষয়ে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপির দুর্দিনে যারা ত্যাগ করেছেন, পরিশ্রম করেছেন দল তাদের মূল্যায়ন করবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ বিষয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন সময়ে আশ্বস্ত করেছেন। অন্যদিকে হাইব্রিড নেতাদের বিষয়ে তারা সতর্ক রয়েছেন। এরই মধ্যে দল থেকে নেতাকর্মীদের সতর্ক করা হয়েছে। দলে যোগদান অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। এরপরও বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে অনেকে অনেক অপকর্ম করছেন। যাদের সঙ্গে বিএনপির ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা নেই। এসব বিষয়ে তারা যথেষ্ট সজাগ রয়েছেন।
গত মাসে ঢাকা মহানগর উত্তর কমিটি নানা অনিয়মের অভিযোগের কারণে বিলুপ্ত করার পর স্বল্পসময়ের মধ্যে কমিটি দেওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। কারণ এ সময়ের মধ্যে ওইসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই এবং ৫ আগস্ট পরবর্তী কার কি ভূমকিা ছিল- সেসব বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছেন দলের হাইকমান্ড। যেসব নেতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ, বিশেষ করে প্রভাবশালীদের অভিযোগ তা খতিয়ে দেখা হয়েছে। পাশাপাশি যে প্রভাবশালী নেতারা অভিযোগ করেছেন তাদের কি ভ‚মিকা সে তথ্যও সংগ্রহ করেছেন একাধিক সোর্স থেকে। নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সুনির্দিষ্ট কারণেও একাধিক রিপোর্ট বিএনপির ভারপ্রাপ্ত প্রধানের কাছে জমা হয়েছে। এরপরেই নতুন কমিটির জন্য একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন। যেকোনো সময় এই কমিটি ঘোষণা করা হবে।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ মহানগরের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অনিয়মের অভিযোগ না উঠায় এই কমিটির প্রতি সন্তুষ্ট দলের হাইকমান্ড। শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ না থাকলেও এই শাখার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তবে শুধু অভিযোগের পাওয়া মাত্রই এখন ব্যাবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কারণ, অভিযোগ যাচাই বাচার করা হচ্ছে। সম্পতি হাজারীবাগ থানা বিএনপির সাবেক আহবায়ক মজিবর রহমান মজু ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ অনেক অনিয়মের লিখিত অভিযোগ যায় মহানগর কার্যালয়ে। যাচাই বাছাই করে এরই মধ্যে ২২নং ওয়ার্ডের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। আর মজুর বিরুদ্ধে অভিযোগ যাচাই বাছাই চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশবাসীসহ বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী চান বিগত স্বৈরাচার সরকারের দোসরদের উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনতে। অথচ দলের একটি অংশ ব্যক্তিগত স্বার্থে বিতর্কিত লুটেরা-দানবদের ত্রাণকর্তা হিসেবে দাঁড়াচ্ছেন। অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হলেও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে এতদিন জীবন বাজি রেখে যেসব ত্যাগী নেতাকর্মী রাজপথে ছিলেন তারা ক্ষুব্ধ। সবমিলে দলের সুবিধাভোগীদের নিয়ন্ত্রণ করা যেমন যাচ্ছে না, তেমনি ত্যাগী নেতাকর্মীদের দাবিও উপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এনিয়ে উভয় সংকটে পড়েছেন বিএনপির হাইকমান্ড। এজন্য হাইব্রিড ও ত্যাগীদের বিষয়ে বিএনপি বেশ সতর্কতার সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
এদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে যারা বহাল তবিয়তে ছিলেন তাদের তালিকাও করছে বিএনপি। এরমেধ্যে কারা ওই সময়ে নিজেদের মতো করে ব্যবসা করেছেন, নিরাপদে থেকেছেন। তারা যেমন তালিকায় স্থান পাচ্ছেন তেমনি দুদকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকার পরেও বহাল তবিয়তে ছিলেন তাদের বিষয়ে দলের আলোচনা শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি ওই সময় প্রভাবশালী হওয়ার কারণে কিছু করার ‘সাহস’ না পাওয়ার তালিকায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুলের নাম আসায় এনিয়ে রহস্যের গন্ধ খুঁজছে বিএনপি। ত্যাগী সুবিধাভোগীদের মূল্যায়নের তালিকায় এসব বিষয় স্থান পাবে বলে জানা গেছে।
যাযাদি/ এসএম