দেশের রাজনীতির ইতিহাসে বাঁক বদলের বহুল আলোচিত-সমালোচিত ওয়ান-ইলেভেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
প্রসঙ্গত, জরুরি অবস্থা জারির পর রাজনৈতিক দলগুলোর সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় রাজনৈতিক নেতাদের ধরপাকড়। দুর্নীতির অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা মামলায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই তখন গ্রেপ্তার হন। রাজনৈতিক মাঠ শূণ্য হয়ে যায়, তখন রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার মতো দু: সাহস করেনি অনেক নেতাকর্মীরা। ঠিক তখন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি পুনর্গঠন, দু:সময়ের কান্ডারি হয়ে হাল ধরেন সৈয়দ সাদাত আহমেদ। তৃণমুলের নেতাকর্মীদের আশা ও ভরশার স্থল হয়ে কাজ করে যান তিনি।
সৈয়দ সাদাত আহমেদ ছিলেন চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স (সিএসএফ) এর সক্রিয় সদস্য। সরকার বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে ছিলেন সামনের কাতারে। মাঠের আন্দোলনে উপস্থিতির মধ্যেই নিজের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখেননি, দলের কর্মসূচী সফল করতে পারিবারিক অর্থ ব্যয় করেছেন দুই হাতে। দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ সাদাতের কর্মকান্ড ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের টার্গেটে পরিণত করে।
আর তাই স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ২০১৭ সালের ২২ আগষ্ট রাজধানির রেডিসন হোটেলের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়। কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা আজও তাঁর অজানা। গোপন স্থানে নেওয়ার পর সাদাতের ওপর জিজ্ঞাসাবাদের নামে অমানুষিক নির্যাতনও করা হয়। আয়নাঘরের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দি সাদাত বুঝতে পারেন জীবন নিয়ে আর পরিবারের মাঝে, দেশের মানুষের কাছে, এমনকি বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদি দল-বিএনপির হয়ে কাজ করা হবে না কখনো।
আয়নাঘরে প্রতিটি দিন ছিলো তার জন্য অতন্ত্য কষ্টের। কারণ এমন সব বাজে প্রশ্ন করা হতো, নানা অকথ্য ভাষায় গালাগালিও শুনতে হয়েছে। এ সময় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যারা তাকে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তাদের অনেকেই দেশের বাইরের ছিলো।
দিন যতই গড়াতে লাগলো সৈয়দ সাদাত বুঝতে পারলেন ও নিশ্চিত হলেন, পৃথিবীর খোলা আকাশের নিচে সন্তানের হাত ধরে আর হাঁটা হবে না। আর সময় কাটানো হবে না পরিবারের সঙ্গে। আয়না ঘরে নির্মম নির্যাতনের মুখেও বিএনপির এই নেতাকে দলের বিরুদ্ধে কিছু বলাতে পারেনি শেখ হাসিনার দোসররা। বন্দি অবস্থায় ১৩টি সাদা কাগজে তার জবানবন্দি লিখে দিতে বলা হয়েছিলো। সেখানে তিনি দলের নীতি আদর্শ নিয়ে লিখেছেন, ফলে তিনি আরও রোষানলে পড়েন, নির্যাতনের মাত্রাও বেড়ে যায়।
নিখোঁজ হওয়ার পর সাদাতের পরিবারের সদস্যরা তার কোন খোঁজ পায়নি, তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ কেউ পরিবারের কাছে অর্থ দাবি করেছেন তাকে কম নির্যাতন করা হবে বলে। কিন্তু কোন যোগাযোগ করতে দেয়া হয়নি, এক সময় পরিবারের সদস্যরাও ধরেই নিয়েছিলো সাদাত আর বেঁচে নেই।
নিখোঁজ থাকার চার মাস ৮ দিন পরে সৈয়দ সাদাত আহমেদকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গণমাধ্যমের সামনে রামপুরা ব্রিজ থেকে তাকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবি কার্যালয়ে তাকে আরও ২৮ দিন আটকে রাখা হয়।
এনিয়ে এরই মধ্যে গুম কমিশনে লিখত অভিযোগ দিয়েছেন সাদাত। বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আয়না ঘরের মতো কোনো প্রতিহিংসার রাজনীতি এ দেশে যেন ফিরে না আসে। তিনি বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা ছিলো দলের কেউ যেন অশান্তি, ভাঙচুর, চাঁদাবাজি না করে। প্রতিহিংসার রাজনীতি তিনি করতে দিতে চান না এবং আমরাও যারা বিএনপিকে ধারণ করি, লালন করি তারাও এ পথ বেছে নিতে চাই না। সেই সঙ্গে যারা গুম ছিলেন তাদের কাউন্সিলিং দেওয়ার আহ্বানও জানান বিএনপির এই নেতা।
এদিকে গুম হওয়া অনেক নেতাকে দল এরই মধ্যে মূল্যায়ন করেছে। নীতিনির্ধারণী ফোরামসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রেখে দল ও দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম সৈয়দ সাদাত আহমেদের বেলায়। গুম হওয়ার আগে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন করা হলেও কোন পদ দেওয়া হয়নি তাকে। এখন কোন পদে নেই সাদাত আহমেদ। আঞ্চলিক কোন পদেও রাখা হয়নি তাকে। তবে চলমান দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ত্যাগী এই নেতা থাকবেন এমনই প্রত্যাশা করছেন তার অনুসারীরা।
আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি জেল, জুলুম, নির্যাতনের প্রতিযোগিতায় বিএনপির যেক'জন নেতা থাকবেন একবারে সামনের কাতারে তাদের মধ্যে অন্যতম বিএনপির নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য সৈয়দ সাদাত আহমেদ নাম থাকাটাও স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু ৪ মাস ৮ দিন আয়নাঘরে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েও বিএনপির পতাকা সমুন্নত রাখতে পিছপা হননি এই নেতা। অথচ ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের ১০ মাসেও এই নেতার মূল্যায়ন না হওয়ায় তার অনুসারীদের প্রশ্ন সাদাতকে আর কত ত্যাগ স্বীকার করতে হবে ।