রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
নতুন মেয়াদে ক্ষমতা

পুতিন নিয়ে উদ্বিগ্ন পশ্চিমারা

যাযাদি ডেস্ক
  ১৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভস্নাদিমির পুতিন

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে ভস্নাদিমির পুতিন আরও ছয় বছর ক্ষমতায় থাকতে চলেছেন। গত শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত চলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের টানা ভোটগ্রহণ। তবে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় তেমন কোনো নাটকীয় চমক ছিল না। আসলে নির্বাচন শেষে তিনি কী করতে যাচ্ছেন, সেটাই এখন মনোযোগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুতিন আরও এক মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণ করে কী করতে পারেন, তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা।

দেশটির ভোটদান পর্ব শেষ হয়েছে রোববার এবং এটা নিশ্চিত যে, এর ফলে পুতিন ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। আর এর অর্থ হচ্ছে, তিনি প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টানা ৩০ বছর রাশিয়ার নেতৃত্ব দিতে চলেছেন। এ পর্যন্ত তিনি যে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছেন এবং দেশের ভেতর বিরোধী কণ্ঠকে কার্যকরভাবে রোধ করেছেন, এতে পুতিনের হাত আরও শক্ত হয়েছে এবং সম্ভবত অনিয়ন্ত্রিত থেকেছে।

এই অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে রুশ অর্থনীতির বিস্ময়কর স্থিতিস্থাপকতার কারণে। যদিও ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালানোর পর রাশিয়ার ওপর ব্যাপকভাবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তবে এতে রাশিয়ার অর্থনীতির খুব বেশি ক্ষতি হয়নি।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুদ্ধক্ষেত্রে মস্কোর ক্রমবর্ধমান এবং নিয়মিত অগ্রগতিও রাশিয়াকে শক্তিশালী করেছে, যেমন করেছে আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের তরফ থেকে কিয়েভের প্রতি সামরিক সহায়তার অনিশ্চিত অবস্থা। একই সঙ্গে, কোনো কোনো পশ্চিমা দেশে প্রগতিশীল সামাজিক নীতির বিরোধিতা বস্তুত পুতিনের 'ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ'র- কথারই প্রতিধ্বনি। সংক্ষেপে বলা যায়, খুব কম দৃশ্যমান বাধা নিয়ে পুতিন তার নতুন মেয়াদ শুরু করতে যাচ্ছেন, যার ফলে খুব শিগগিরই গুরুত্বপূর্ণ নতুন কর্ম তৎপরতা দেখা যেতে পারে।

আমেরিকার করনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রাইন রোজেনফিল্ড, যিনি কমিউনিজম-উত্তর সময়ের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেন, তিনি এক মন্তব্যে বলেন, 'রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, যেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এর পর কী হবে। জনপ্রিয় নয়, এমন সব পদক্ষেপ পুতিন প্রায়ই নির্বাচন পর্যন্ত স্থগিত রাখেন।'

দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম জনপ্রিয় যে পদক্ষপেটি তিনি নিতে পারেন, তা হলো- ইউক্রেনে লড়াই করার জন্য দ্বিতীয়বার রিজার্ভে থাকা সেনাদের যুদ্ধে পাঠানোর জন্য ডাকা। প্রথমবার যখন ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি এটি করেছিলেন, তখন এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ হয়েছিল এবং যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আহ্বান এড়াতে একদল রুশ নাগরিক দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। তবে এই দ্বিতীয়বার সেনা সমাবেশ ঘটানো জনগণের কাছে যতই অগ্রহণযোগ্য হোক না কেন, ১৮ মাস আগে যে সেনাদের যুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল, তাদের স্বজনরা খানিকটা প্রশমিত বোধ করবেন। রাশিয়ায় কেউ কেউ মনে করেন তাই-ই হবে।

গবেষণা গোষ্ঠী 'র?্যান্ড করপোরেশন'র জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ব্রায়ান মাইকেল জেনকিন্স বলেন, রাশিয়ার নেতারা এখন তাদের 'প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে গোটা রুশ সমাজকে সংঘবদ্ধ করা'র কথা বলছেন। তিনি আরও বলেন, 'এই বাক্যাংশের সুনির্দিষ্ট অর্থটা পুরোপুরি পরিষ্কার নয়, তবে এতে বোঝানো হচ্ছে যে, রাশিয়ার নেতৃত্ব যেন এটা বোঝেন যে, পুতিনের এই যুদ্ধ দীর্ঘ সময় ধরে চলবে আর সে জন্যই সম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। অন্য কথায়, রুশ সমাজকে সব সময় যুদ্ধের জন্য সংগঠিত থাকতে হবে।'

তবে 'কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টার'র একজন সিনিয়র ফেলো তাতিয়ানা স্ট্যানোভায়া বলেন, পুতিনের ঠিক ওই ভাবে যুদ্ধের জন্য লোকজনকে সংগঠিত করানোর প্রয়োজন নেই, কারণ অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এলাকা থেকে বহু রুশ নাগরিক যুদ্ধের জন্য স্বেচ্ছায় নাম স্বাক্ষর করেছেন। যাতে তারা বাড়িতে বসে সীমিত সুযোগে যা উপার্জন করেন, তার চেয়ে বেশি আয় করতে পারেন। তিনি বলেন, এ ছাড়া পুতিনের এই আপাত আত্মবিশ্বাস যে যুদ্ধ আসলে রাশিয়ার অনুকূলে রয়েছে, তাকে সম্ভবত এ ব্যাপারে জোর দিতে উদ্বুব্ধ করে যে, ইউক্রেনের জন্য এই সংঘাতের অবসান ঘটানোর একমাত্র পথ হচ্ছে আলোচনার টেবিলে বসা। বস্তুত যার মানে হচ্ছে আত্মসমর্পণ করানো।

ওয়াশিংটনে ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন যখন ক্রমশ কমে আসছে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ এবং পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী রাদেক সিকর্সকি উভয়ই সম্প্রতি বলেছেন যে, কিয়েভের সমর্থনে সেনা পাঠানোর সম্ভাবনা বড়জোর আনুমানিক। আর এসব বিবৃতি মাথায় রেখেই পুতিন হয়ত ন্যাটোর প্রতিজ্ঞা পরীক্ষা করে দেখতে আগ্রহী।

আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ডেভিস সেন্টার ফর রাশিয়ান অ্যান্ড ইউরেশিয়ান স্টাডিজ'র নির্বাহী পরিচালক আলেক্সান্দ্রা ভ্যাক্রু বলেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আর্টিকেল ফাইভের প্রতি ন্যাটোর অঙ্গীকার রাশিয়া মূল্যায়ন করার চেষ্টা করবে। ওই আর্টিকেলে জোটের অভিন্ন প্রতিরক্ষা নিশ্চয়তার কথা রয়েছে, যার মানে হচ্ছে ন্যাটোর যে কোনো একজন সদস্যের ওপর আক্রমণ সবার প্রতি আক্রমণ বলে গণ্য হবে।

তিনি বলেন, 'আমার তো মনে হয় না যে, পুতিন মনে করেন- তাকে অন্য সব দেশের চেয়ে শারীরিকভাবে, সামরিকভাবে আরও শক্তিশালী হতে হবে। তিনি শুধু চান, তারা আরও দুর্বল হোক এবং আরও ক্ষয়িষ্ণু হোক। আর তাই তার নিজের জন্যই প্রশ্ন হচ্ছে, আমার নিজেকে আরও শক্তিশালী করে তোলার জন্য অত না ভেবে, (ভাবতে হবে) আমি অন্য সবাইকে কীভাবে আর দুর্বল করব?'

ভ্যাক্রু আরও বলেন, 'সুতরাং সেটা করতে হলে, আপনাকে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, যেখানে আর্টিকেল ফাইভ পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আর যদি হাল্কা বা অনিশ্চিত প্রতিক্রিয়া পান, তা হলে আপনি নিজেই দেখিয়ে দিলেন যে, ন্যাটো হচ্ছে কেবলমাত্র একটা কাগুজে বাঘ।'

অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পুতিন তার এই নতুন মেয়াদে আরও দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন বলে ধারণা পশ্চিমা বিশ্লেষকদের। যদিও বিরোধীদের সমর্থক এবং স্বাধীন মাধ্যমকে এরই মধ্যে দমন করা হয়েছে বলে মনে করেন তারা।

স্ট্যানোভায়া মনে করেন, পুতিন নিজে কোনো দমনমূলক পদক্ষেপ পরিচালনা করেন না। তবে তিনি এই রকম কর্মকান্ডকে অনুমোদন দেন, যেগুলো অন্যরা প্রস্তুত করে এই প্রত্যাশায় যে, এগুলোই তাদের নেতা চান। তিনি বলেন, 'অনেকেই টিকে থাকতে এবং খাপ খাইয়ে নিতে চায়। তারা নিজেদের মধ্যে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এবং প্রায়ই তাদের পরস্পরবিরোধী স্বার্থ থাকে। আর তারা সমান্তরালে নিজেদের নিরাপত্তা ও এই সরকারের স্থিতিশীলতাকে নিশ্চিত করতে চায়।'

গত বছর রাশিয়া সমকামীসহ এলজিবিটিকিউর 'আন্দোলন'কে চরমপন্থি আন্দোলন বলে অভিহিত করে এবং নিষিদ্ধ করে দেয়। কর্মকর্তারা বলছেন, আসলে সেটা ছিল ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের পক্ষে লড়াই। দেশটির আদালতও লিঙ্গ পরিবর্তন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

'ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন'র রুশ রাজনীতি-বিষয়ক সহযোগী অধ্যাপক বেন নোবেল বলেন, তিনি মনে করেন পুতিনের আসন্ন এই নতুন মেয়াদে এলজিবিটিকিউ সমাজ আরও নিপীড়নের শিকার হতে পারে। তার মতে, ক্রেমলিনের চোখে তারা হচ্ছে, 'ক্ষয়িষ্ণু পশ্চিম থেকে আমদানি করা'। তথ্যসূত্র : এপি অনলাইন

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুদ্ধক্ষেত্রে মস্কোর ক্রমবর্ধমান এবং নিয়মিত অগ্রগতিও রাশিয়াকে শক্তিশালী করেছে, যেমন করেছে আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের তরফ থেকে কিয়েভের প্রতি সামরিক সহায়তার অনিশ্চিত অবস্থা। সংক্ষেপে বলা যায়, খুব কম দৃশ্যমান বাধা নিয়ে পুতিন তার নতুন মেয়াদ শুরু করতে যাচ্ছেন, যার ফলে খুব শিগগিরই গুরুত্বপূর্ণ নতুন কর্ম তৎপরতা দেখা

যেতে পারে...রাশিয়ার নেতারা এখন তাদের 'প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে গোটা রুশ সমাজকে সংঘবদ্ধ করা'র কথা বলছেন। এই বাক্যাংশের সুনির্দিষ্ট অর্থটা পুরোপুরি পরিষ্কার নয়, তবে এতে বোঝানো হচ্ছে যে, রাশিয়ার নেতৃত্ব যেন এটা বোঝেন যে, পুতিনের এই যুদ্ধ দীর্ঘ সময় ধরে চলবে আর সে জন্যই সম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। অন্য কথায়, রুশ সমাজকে সব সময় যুদ্ধের জন্য সংগঠিত

থাকতে হবে...

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে