শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
ইহুদি লবি

আইপ্যাকে কাত আমেরিকা

ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সরকারের সর্বাত্মক সমর্থনের বিষয় ও ঘনিষ্ঠতার মাঝে সেতুবন্ধের কাজ করে থাকে আইপ্যাক বা এ জাতীয় সংস্থা
যাযাদি ডেস্ক
  ৩১ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
আইপ্যাকের অনুষ্ঠানে জো বাইডেন

ইহুদি লবিগুলো মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক। ইহুদিরা মার্কিন জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ। কিন্তু তারা আমেরিকার ক্ষমতা-কাঠামোয় সবচেয়ে প্রভাবশালী সংখ্যালঘু গোষ্ঠী।

এই লবিগুলো আমেরিকায় বিচিত্র ধরনের বহু কর্মকান্ডে জড়িত। কিন্তু তাদের মূল দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে মার্কিন-ইসরাইল সম্পর্কের ওপর। ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সমর্থন ইহুদি লবিগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল। মার্কিন ইহুদি লবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হলো 'আইপ্যাক' তথা 'আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি'। এই সংস্থাটি আমেরিকায় বেশির ভাগ ইহুদি সংগঠন বা সংস্থার তৎপরতায় সমন্বয় সাধনের কাজ করে এবং পরিকল্পনা প্রণয়নেও জড়িত। মার্কিন নীতিগুলোকে ইহুদিবাদী স্বার্থের সঙ্গে সমন্বিত করতে প্রধান ভূমিকা রাখে এই আইপ্যাক।

মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা ও নির্বাহী বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গঠনমূলক যোগাযোগের মাধ্যমে আইপ্যাক ইসরাইলের স্বার্থকেন্দ্রিক মার্কিন আইন প্রণয়নে সক্রিয় থাকেন। এসব আইন ইসরাইলের টিকে থাকা, অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত। মার্কিন-ইসরাইল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ। ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সরকারের সর্বাত্মক সমর্থনের বিষয় ও এই ঘনিষ্ঠতার মাঝে সেতুবন্ধের কাজ করে আইপ্যাক বা এ জাতীয় সংস্থা। ওয়াশিংটন ও তেলআবিবের প্রতি যৌথ হুমকির বিষয়গুলো তুলে ধরে আইপ্যাক। এসব হুমকি মোকাবিলার জন্য কৌশলগত দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার প্রতি মার্কিন রাজনীতিবিদদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে এসব সংস্থা।

এসব কাজের জন্যই আইপ্যাক গড়ে তুলেছে বহু সংগঠন। এক্ষেত্রে ধর্মীয় ও জাতিগত বন্ধনগুলোকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হয়, যাতে মার্কিন সরকারের সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী কাঠামোগুলোতে প্রভাব রাখা সহজ হয় এবং মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারক যন্ত্রকে এসব লক্ষ্যের দিকে পরিচালনা করা যায়। আইপ্যাকের এসব গুরুত্বপূর্ণ কৌশল বাস্তবায়নে ব্যবহার করা হয় অর্থনৈতিক ও প্রচারণার ব্যাপক শক্তি-সামর্থ্য। মার্কিন কংগ্রেস ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সেইসব প্রার্থীকে আইপ্যাক এসব শক্তি দিয়ে সহায়তা করে, যেসব প্রার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি আইপ্যাকের দৃষ্টিভঙ্গির কাছাকাছি বা আইপ্যাকের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অভিন্ন।

কংগ্রেসে আইপ্যাকের এমন প্রভাব ও ক্ষমতার কারণেই ইসরাইল সেখানে সব ধরনের প্রতিবাদ বা সমালোচনা থেকে মুক্ত। কংগ্রেসে বিতর্কিত সব বিষয়ে আলোচনার সুযোগ থাকলেও ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় সামনে এলে সম্ভাব্য প্রতিবাদকারীরা সাধারণত নীরব হয়ে যান এবং খুব কমই এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। আইপাকের এমন অসাধারণ ক্ষমতা ও সাফল্যর কারণ হলো, সংস্থাটি তার কর্মসূচির পক্ষের আইন-প্রণেতা ও কংগ্রেসের প্রার্থীদের পুরস্কার দিতে সক্ষম ও বিপক্ষকে শাস্তি দিতে সক্ষম। অন্যদিকে মার্কিন নির্বাহী বিভাগে আইপ্যাকের প্রভাবের উৎস হলো, অনেকাংশেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জড়িত ইহুদি ভোটাররা। ইহুদিদের সংখ্যা যদিও খুব কম, তা সত্ত্বেও তারা মার্কিন নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলকেই বিপুল অর্থ সাহায্য দিয়ে থাকে।

মার্কিন নির্বাচনে ইহুদি ভোটারদের অংশগ্রহণের হার বেশ ব্যাপক। তবে তাদের উপস্থিতি ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, ইলিনয়েজ, নিউইয়র্ক ও প্যানসিলভানিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলোতে বেশি। আইপ্যাক ইসরাইল ও পশ্চিম এশিয়াসহ বিশ্বের সবচেয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় অঞ্চলগুলো সম্পর্কিত মার্কিন নীতিতে প্রভাব বিস্তারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

জন মার্শাইমার ও স্টিফেন ওয়াল্ট তাদের লেখা বই 'ইসরাইলের প্রেসার-গ্রম্নপ ও মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি' শীর্ষক বইয়ে এই মত তুলে ধরেছেন যে, ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সরকারের বর্তমান সমর্থনের যে উচ্চতা, তার কোনো নৈতিক ও কৌশলগত সাফাই থাকতে পারে না, তা সত্ত্বেও এই অস্বাভাবিক সমর্থনের কারণ হলো এই দেশটিতে ইহুদি লবির গভীর প্রভাব।

তারা মনে করেন, মূলত ইসরাইলি লবির প্রভাবের কারণেই মার্কিন সরকার ২০০৩ সালে ইরাকে মহাসংকট সৃষ্টিকারী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল এবং ইরান ও সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার মার্কিন প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। আর আইপ্যাক হচ্ছে ইসরাইলি লবিগুলোর প্রাণকেন্দ্র ও মধ্যপ্রাচ্য সংক্রান্ত মার্কিন নীতির মূল দিশারি।

এই আইপাকের প্রভাব এতই গভীর ও শক্তিশালী যে, মার্কিন কর্মকর্তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইসরাইলি নীতির সঙ্গে তাল মেলাতে বাধ্য হন। আর এর অন্যতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টরা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রম্নতি দেওয়ার পরও আইপাকের চাপ ও প্রচারণার ধূমজালের প্রভাবে ওই প্রতিশ্রম্নতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। বুশ ইরাক যুদ্ধের পর রোডম্যাপ নামক কর্মসূচির আওতায় ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাত সমাধানের লক্ষ্যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রতি সমর্থন জানানোর ওয়াদা দিয়েছিলেন, কিন্তু আইপাকের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখে তিনি ওই অবস্থান থেকে সরে আসেন। ফলে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ফাইল আবারও চাপা পড়ে যায়।

একইভাবে আইপাকের বার্ষিক ভাষণে ওবামার বক্তব্য মুসলিম জাতিগুলোকে ক্ষুব্ধ করে। তার ওই ভাষণ মধ্যপ্রাচ্য সংকট সমাধানের জন্য সহায়ক হওয়া তো দূরের কথা, বরং আরও হতাশ করে। ওবামা ওই ভাষণে পশ্চিম এশিয়ার জাতিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের পরিবর্তে ইহুদি লবিগুলোর সুনজর আদায়েরই চেষ্টা করেছিলেন।

ট্রাম্পও ইসরাইলের সবচেয়ে বড় 'সেবকে' পরিণত হন আইপাকেরই পাঁকে পড়ে। তিনি পশ্চিম তীরকে ইসরাইলের রাজধানী বলে স্বীকৃতি দেন এবং তেলআবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস সেখানে সরিয়ে আনেন এবং দুই রাষ্ট্রের সমাধান থেকে মার্কিন সরকারকে দূরে রাখেন ও ফিলিস্তিনে কেবল এক ইসরাইল রাষ্ট্র থাকার ইসরাইলি নীতির প্রতি সমর্থন দেন। তথ্যসূত্র : পার্স টুডে

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে