বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২
আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

ছোট হয়ে আসছে নেতানিয়াহুর পৃথিবী

আইসিসির সদস্যভুক্ত দেশগুলো যে সবসময়ই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়টি কার্যকর করে, তেমনও না। যেমন, ইউক্রেনে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভস্নাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি। অথচ গত সেপ্টেম্বরে আইসিসির সদস্যভুক্ত দেশ মঙ্গোলিয়ায় রাষ্ট্রীয় সফরে গেলেও সেখানে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বরং সফরের সময় দেশটিতে তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা পান...
যাযাদি ডেস্ক
  ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ছোট হয়ে আসছে নেতানিয়াহুর পৃথিবী
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ইসরায়েলি সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। গত বৃহস্পতিবার এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এটিই পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদলে তৈরি কোনো দেশের নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রথম ঘটনা। আইসিসি বলছে, 'ক্ষুধাকে ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য এই দুইজনকে দায়ী করার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে।' দুইজনের প্রত্যেকের অন্যদের সঙ্গে মিলে যৌথভাবে সহ-অপরাধী হিসেবে নিম্নলিখিত অপরাধের জন্য ফৌজদারি দায়বদ্ধতা রয়েছে : যুদ্ধের পদ্ধতি হিসেবে ক্ষুধার ব্যবহার এবং হত্যা, নিপীড়ন এবং অন্যান্য অমানবিক কাজের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।'

তবে আন্তর্জাতিক আদালতের এই পদক্ষেপকে 'ইহুদিবিদ্বেষী' বলে মন্তব্য করেছেন নেতানিয়াহু। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগকে 'অযৌক্তিক' এবং 'মিথ্যা' উলেস্নখ করে তা প্রত্যাখ্যানও করেছেন তিনি। নেতানিয়াহু দাবি করেন, গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে চালানো হামলার জবাবেই হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইসরায়েল।

1

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন, 'আইসিসি ইহুদি রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে চায় আর ইহুদিবিদ্বেষী এই পদক্ষেপ নেওয়াই হয়েছে আমাদের ধ্বংস করতে উদ্যত শত্রম্নদের বিরুদ্ধে আমার এবং আমাদের আত্মরক্ষার স্বাভাবিক অধিকার প্রয়োগ থেকে বিরত রাখতে এবং বাধা দিতে।'

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছাড়াও হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। যদিও গত জুলাইয়ে তাদের এক বিমান হামলায় দেইফের মৃতু্য হয়েছে বলে দাবি করেছিল ইসরায়েল। তবে হামাস আজও এই তথ্য নিশ্চিত করেনি।

ইসরায়েল ও গাজার প্রতিক্রিয়া

দেইফের মৃতু্য নিয়ে দোলাচল থাকায় স্বাভাবিকভাবেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি কেবল ইসরায়েলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে জানান বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্রাঙ্ক গার্ডনার। শুক্রবার বিবিসির গেস্নাবাল নিউজ পডকাস্টে যুক্ত হয়ে গার্ডনার বলেন, 'আর আংশিকভাবে সে কারণেই ইসরায়েলি জনতা এবং নেতারা এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। অন্যদিকে, গাজায় কেবল হামাস এবং ইসলামিক জিহাদী গোষ্ঠীই না, সাধারণ ফিলিস্তিনিরাও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।'

ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জগ বলেছেন, 'ন্যায়বিচার ও মানবতার জন্য এটি একটি অন্ধকার দিন হয়ে থাকবে।' আইসিসির বিরুদ্ধে 'ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের' অভিযোগও আনেন তিনি।

সম্ভবত সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত। কিছুদিন আগেই নেতানিয়াহু তাকে পদচু্যত করেন। 'কারো ভয়ে ইসরায়েল নত হবে না' উলেস্নখ করে নিজের ব্যক্তিগত এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে তিনি লিখেছেন, ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী 'এই যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনে লড়াই চালিয়ে যাবে'। একইসঙ্গে সবচেয়ে কঠিন সময়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সংস্থার নেতৃত্ব দেওয়ার অসাধারণ সুযোগ পেয়ে নিজেকে গর্বিত এবং 'ইসরায়েল রাষ্ট্র রক্ষায় নিয়োজিত সর্বোচ্চ পেশাদার এবং নৈতিক সেনাদের পাশে রয়েছেন' বলেও লেখেন তিনি।

গ্যালান্ত বলেন, 'হেগের আদালতের এই বিচার স্মৃতিতে থেকে যাবে। ইসরায়েল রাষ্ট্র এবং হত্যাকারী হামাস নেতাদের এই রায় একই আসনে বসিয়েছে। এই রায় হামাসের সহিংসতাকে সমর্থন করেছে। তারা যেভাবে শিশুদের হত্যা করেছে, নারীদের নির্যাতন করেছে, বৃদ্ধদের বিছানা থেকে তুলে নিয়ে গেছে, তা সমর্থন পেল এই রায়ে।' গ্যালান্তের বক্তব্য, এই রায় আত্মরক্ষার অধিকারকে মর্যাদা দেয়নি।

এদিকে, গাজাবাসী এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, অবশেষে পৃথিবী তাদের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। তবে চলমান এসব ঘটনার মধ্যেই গাজায় চালানো ইসরায়েলি বিমান হামলায় গত ৩৬ ঘণ্টায় আরও শতাধিক মৃতু্যর কথা জানান গার্ডনার। একইসঙ্গে গাজার উত্তরাঞ্চলে খাবার আর ওষুধের অভাবে মানবেতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানান তিনি।

নেতানিয়াহু কি গ্রেপ্তার হবেন?

নেতানিয়াহু, গ্যালান্ত এবং দেইফের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত এই আন্তর্জাতিক আদালতের উদ্দেশ্য ছিল, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের মতো নৃশংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা। তবে এটি জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) থেকে আলাদা। আইসিসির নিজস্ব কোনো পুলিশ বাহিনী নেই। ফলে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার জন্য তারা তাদের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর ওপর নির্ভর করে।

এই আদালত প্রতিষ্ঠার জন্য মোট ১২৪টি দেশ 'রোম স্ট্যাটিউট' নামে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এর মধ্যে ৩৩টি আফ্রিকান, ১৯টি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয়, ১৯টি পূর্ব-ইউরোপীয়, ২৮টি ল্যাতিন অ্যামেরিকান এবং ক্যারিবীয় এবং ২৫টি পশ্চিম ইউরোপীয় ও অন্যান্য রাষ্ট্র রয়েছে। তবে এটিকে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়নি আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও ইসরায়েল। ইসরায়েল আইসিসির সদস্য দেশ না হওয়ায় এর ওপর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কোনো এখতিয়ার নেই বলে দাবি করে তারা। তবে বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঘোষণা করার সময় আইসিসি জানায়, এর সদস্য রাষ্ট্র 'ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক বিচারিক এখতিয়ারের ভিত্তিতে' ইসরায়েলের ওপর বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। যদিও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আইসিসি সাধারণত অনুপস্থিত আসামিদের বিচার করে না। যার অর্থ দাঁড়ায়, সম্ভবত নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্ত আইসিসির কোনো সদস্য রাষ্ট্রে ভ্রমণ করা বা গ্রেপ্তার না হওয়া কিংবা দুজনকে হেগে না আনা পর্যন্ত তাদের বিচারের মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা নেই। ফলে পরোয়ানা জারি হলেও নেতানিয়াহু কিংবা গ্যালান্তকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হতে হবে না। তবে এরপর থেকে তাদের জন্য যে কোনো দেশে ভ্রমণ করা জটিল হবে, একইসঙ্গে এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইসরায়েলকে আরও বিচ্ছিন্ন করার হুমকি তৈরি হলো।

অন্য দেশগুলো যা বলছে

স্বাভাবিকভাবে নেতানিয়াহু আর গ্যালান্ত যদি আইসিসি সদস্যভুক্ত কোনো দেশে পা রাখেন তাহলে তাদের গ্রেপ্তার করে আদালতের কাছে তুলে দেওয়ার কথা। নেতানিয়াহু সবশেষ জুলাইয়ে আমেরিকায় যান, যা কি না আইসিসির সদস্যভুক্ত না।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে 'আপত্তিজনক' বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেছেন, 'আইসিসি যা-ই বোঝাক না কেন, ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে তুলনার জায়গা নেই'। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, 'ইসরায়েলের নিরাপত্তার হুমকির মুখে পড়লে আমরা সবসময় তাদের পাশে দাঁড়াবো।'

তবে গত বছর নেতানিয়াহু বেশ কয়েকটি দেশে গেছেন, যার একটি যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যে গেলে কি তাকে গ্রেপ্তার করা হবে? এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে দেশটির সরকারি মুখপাত্র বলেন, 'আমরা কোনো পূর্বানুমানে যাব না।' তবে শুক্রবার দেশটি জানিয়েছে, নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করা হবে। এর আগে অপর এক ব্রিটিশ মুখপাত্র আরও কঠোর ভাষায় এই বলেছেন, 'আমরা আন্তর্জাতিক আদালতের স্বাধীনতাকে সম্মান করি। কারণ, এই আদালত পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি নিয়ে তদন্ত ও বিচার করার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান।'

শুধু যুক্তরাজ্যই নয়, গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আমলে নিয়ে নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে ইউরোপের দেশগুলোর জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সাত সদস্য রাষ্ট্র। এই সদস্য রাষ্ট্রগুলো হলো নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, সুইডেন, বেলজিয়াম ও নরওয়ে। ইইউর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, ইইউর সব সদস্য রাষ্ট্রের জন্য আইসিসির সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার 'বাধ্যবাধকতা' রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের ঘোষণার পর ছোট হয়ে আসছে নেতানিয়াহুর পৃথিবী।

আগের পরোয়ানাগুলো কীভাবে কার্যকর হয়েছে?

আইসিসির সদস্যভুক্ত দেশগুলো যে সবসময়ই গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়টি কার্যকর করে, তেমনও না। যেমন, ইউক্রেনে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভস্নাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি। অথচ গত সেপ্টেম্বরে আইসিসির সদস্যভুক্ত দেশ মঙ্গোলিয়ায় রাষ্ট্রীয় সফরে গেলেও সেখানে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বরং সফরের সময় দেশটিতে তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা পান। তবে ২০২৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে যাননি পুতিন। সে সময় দেশটির আদালত বলেছিল, পুতিনকে গ্রেপ্তার করা সরকারের দায়িত্ব।

এর আগে দারফুর অঞ্চলে যুদ্ধাপরাধের জন্য ২০০৯ সালে সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আইসিসি। তবে ২০১৫ সালে বশির দক্ষিণ আফ্রিকা গেলেও তাকে গ্রেপ্তার করেনি দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এদিকে, আমেরিকার প্রতিনিধি পরিষদে এরই মধ্যে পাস হওয়া একটি বিল সিনেটে পাস করার আহ্বান জানিয়েছেন রিপাবলিকান নেতা জন থুন। এই বিলের মাধ্যমে আমেরিকা ও তার মিত্রদের দ্বারা 'সুরক্ষিত ব্যক্তিদের তদন্ত, গ্রেপ্তার, আটক বা বিচারের প্রচেষ্টায় জড়িত ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলা হয়েছে।' তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে