বুধবার, ১৪ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

ড. মনমোহন সিং :ভারতের 'অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার'

ড. মনমোহন সিং ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল এই ১০ বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এর আগে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। সেই সময়েই ভারতের অর্থনীতির উদারীকরণের যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও, সেটির বাস্তবায়ন করেছিলেন পেশা ও শিক্ষায় অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ড. মনমোহন সিং :ভারতের 'অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার'
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং। ডানে কংগ্রেসের প্রতীক পাঞ্জা

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বৃহস্পতিবার রাতে দিলিস্নর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। প্রধানমন্ত্রী পদে তারই উত্তরসূরি, দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাত ১০টা ৩৭ মিনিটে টুইট করে এ খবর জানিয়েছেন। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। তার স্ত্রী গুরচরণ সিং এবং তিন কন্যা আছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার কিছুক্ষণ আগেই দিলিস্নর এইমস হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে ড. সিং এদিন সন্ধ্যায় বাড়িতেই অজ্ঞান হয়ে যান। বাড়িতেই তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করা হয়। পরে এইমস হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয় মনমোহন সিংকে। "কিন্তু সব প্রচেষ্টা করা সত্ত্বেও তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা যায় নি এবং রাত নয়টা ৫১ মিনিটে তিনি মারা গেছেন," এইমস হাসপাতালের মিডিয়া সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. রিমা ডাডার সই করা এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে। ড. মনমোহন সিং ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল ু এই ১০ বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এর আগে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভারতের অর্থ মন্ত্রী। সেই সময়েই ভারতের অর্থনীতির উদারীকরণের যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও, সেটির বাস্তবায়ন করেছিলেন পেশা ও শিক্ষায় অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং।

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃতু্যতে ভারত সরকার সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। বাতিল করা হয়েছে সব ধরণের সরকারি অনুষ্ঠান। সরকার ঘোষণা করেছে যে ড. মনমোহন সিংয়ের অন্ত্যেষ্টি পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন করা হবে। শুক্রবার বেলা এগারোটায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা বৈঠকে বসে সরকারিভাবে রাষ্ট্রীয় শোকপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয় বলেও জানায় ভারতীয় গণমাধ্যমের একাংশ।

1

এদিকে তার মৃতু্যর খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের শোকবার্তা আসা শুরু হয়ে যায়। শোকবার্তা দিতে থাকেন সেলিব্রেটিরাও। প্রথম শোকবার্তাটি অবশ্য দেন মনমোহন সিংয়েরই উত্তরসূরি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এরপরেই সব দলের নেতা-নেত্রীরা টুইট করে শোকবার্তা দেওয়া শুরু করেন। এরপরেই কংগ্রেস সভাপতি মলিস্নকার্জুন খাড়ে্‌গ, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড় থেকে শুরু করে কংগ্রেস এবং তাদের বিরোধী দলগুলির অনেক রাজনৈতিক নেতা নেত্রীই শোক জ্ঞাপন করেছেন। শোকবার্তা দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জীও। কয়েক বছর ধরেই বার্ধক্য-জনিত রোগে ভুগছিলেন মনমোহন সিং। ড. মনমোহন সিং-ই ভারতের প্রথম শিখ প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। জওহরলাল নেহরুর পরে ড. মনমোহন সিংই প্রথম ভারতীয় নেতা, যিনি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর সম্পূর্ণ মেয়াদ পূর্ণ করার পরে দ্বিতীয়বার আবারও নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন।

আবার ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পরে যে শিখ-বিরোধী দাঙ্গায় প্রায় তিন হাজার শিখ নিধন হয়েছিল, যে দাঙ্গায় অভিযোগের আঙ্গুল ওঠে তারই দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, সেই ঘটনার জন্য প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনই ক্ষমা চেয়েছিলেন মনমোহন সিং। দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন অবশ্য বারেবারে তার সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে। কিছুটা সেইসব অভিযোগের কারণেই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তার দল কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

মনমোহন সিংয়ের জন্ম হয়েছিল ১৯৩২ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর অবিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশের এক ছোট্ট গ্রামে। সেই সময়ে ওই গ্রামে না ছিল বিদু্যৎ, না ছিল খাওয়ার জলের ব্যবস্থা। এরকমই একটা গ্রাম থেকে উঠে আসা মনমোহন সিং পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পরে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপরে ডি ফিল উপাধি পান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার কন্যা দমান সিং বাবার সম্বন্ধে একটি লেখায় জানিয়েছিলেন কেমব্রিজে পড়াশোনা করার সময়ে অর্থ সঙ্কটে দিন কাটত পরবর্তীতে ভারতের অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হওয়া মনমোহন সিংয়ের।।

পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি যে বৃত্তি পেতেন তা ছিল প্রায় ১৬০ পাউন্ড। বাকি খরচের জন্য তার বাবার ওপরে নির্ভর করতে হত তাকে। তিনি খুব সচেতনভাবে কিপটে হয়ে জীবনযাপন করতেন। "ডাইনিং হলে বেশ সস্তায়, দুই শিলিং ছয় পেন্সে খাবার পাওয়া যেত," জানিয়েছিলেন তার কন্যা। তার এটাও মনে আছে যে তার বাবা 'বাড়ির ব্যাপারে একদম অসহায় ছিলেন। না পারতেন একটা ডিম সেদ্ধ করতে, না চালাতে পারতেন টেলিভিশন।"

শিক্ষায় আর পেশায় অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং রাজনীতির ময়দানে পরিচিত হন ১৯৯১ সালে, ভারতের অর্থমন্ত্রী হিসাবে। সেইসময়ে ভারতের অর্থনীতির ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল। হঠাৎ করেই মন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি একসময়ে ছিলেন সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা আর ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নর। এখনও এমন ভারতীয় নোট দেখতে পাওয়া যায়, যদিও খুবই কম, যেখানে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নোটে তার সই থাকত গভর্নর হিসাবে। একটা সময়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আঞ্চলিক প্রধান হিসাবে কলকাতাতেও কাজ করেছেন মনমোহন সিং। নরসিমহা রাওয়ের মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার পরে তার প্রথম ভাষণে তিনি ভিক্টর হুগোর বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, "যদি একটি ভাবনার আসার সময় হয়ে গিয়ে থাকে, তাকে পৃথিবীর কোনও শক্তিই আটকাতে পারে না।" সেটিই ছিল ভারতের এক উচ্চাভিলাষী এবং অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংস্কারের শুরুর ইঙ্গিত।

এরপরেই শুরু হয় করের হার কমানো, ভারতীয় টাকার অবমূল্যায়ন, সরকারি সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ আর বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার মতো কর্মসূচীগুলি। তার সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থনীতি সত্যিই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব হয় আর গত শতাব্দীর ৯০এর দশকে প্রবৃদ্ধির হার লাগাতার উঁচুর দিকেই থাকে।

মনমোহন সিং খুব ভাল করেই জানতেন যে তিনি রাজনীতিবিদ নন। তার কথায়, "একজন রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা যায়, কিন্তু সেটা হতে হলে তো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটে জিততে হবে!"

ভারতের সংসদের নিম্ন-কক্ষ লোকসভার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন ১৯৯৯ সালে। কিন্তু হেরে যান তিনি। এরপরে উচ্চ-কক্ষ রাজ্যসভার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন আসাম থেকে।

এরপর এল ২০০৪ সালের নির্বাচন। কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল, কিন্তু কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদ নিতে অস্বীকার করলেন। সম্ভবত তিনি যেহেতু জন্মসূত্রে ইতালিয়, তাই প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হতে পারে, এটা ভেবেই সম্ভবত তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চান নি। সমালোচকরা এও বলে থাকেন যে মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়কালে সোনিয়া গান্ধীই ছিলেন আসল ক্ষমতার উৎস। ড. সিংয়ের নিজের কোনও ক্ষমতাই ছিল না বলে মনে করেন সমালোচকরা। সূত্র:বিবিসি বাংলা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে