ছয় ইসরাইলি জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে ৬ শতাধিক ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। আর এরমধ্য দিয়ে তিনি আবারও যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করলেন বলে অভিযোগ হামাসের। ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থেকে নেতানিয়াহু সরে আসার ফলে হুমকির মুখে পড়েছে গাজা যুদ্ধ বিরতি চুক্তি। যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী, শনিবার ৬ ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস। বিনিময়ে প্রায় ৬২০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে ইসরাইলি কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন নেতানিয়াহু। রোববার নেতানিয়াহুর কার্যালয় এক বিবৃতিতে এ কথা জানায়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, পরবর্তী পর্যায়ের জিম্মি হস্তান্তর নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি স্থগিত থাকবে। এছাড়া নেতানিয়াহু অভিযোগ করেছেন যে, হামাস প্রতিবার জিম্মি মুক্তির অনুষ্ঠানকে 'অসম্মানজনক প্রচারণার' অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে। সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া জিম্মিদেরও ওই 'অপমানজনক অনুষ্ঠানের' মাধ্যমে ইসরাইলের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ প্রায় ১৬ মাস রক্তাক্ত সংঘাতের পর গত ১৯ জানুয়ারি থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হয় এর পর থেকে যুদ্ধবিরতির চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইতোমধ্যে ২৫ জন জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। চলমান যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ ৪২ দিনের। আর এই সময়ে মোট ৩৩ ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস। বিনিময়ে ইসরাইলি কারাগার থেকে ১ হাজার ৯০০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়ার কথা রয়েছে। তারপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ শুরুর কথা রয়েছে। আর সেটি বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে মধ্যস্থতাকারীরা। তবে বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতিতে যেতে আগ্রহী নন নেতানিয়াহু। বেশির ভাগ জীবিত জিম্মি মুক্তি পাওয়ায় গাজায় আবারও যুদ্ধ শুরু করতে পারে নেতানিয়াহু সরকার। হামাস শনিবার ছয় ইসরাইলি বন্দিকে ছেড়ে দিলেও ছয় শতাধিক ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিলেও তেলআবিব মুক্তি প্রক্রিয়া স্থগিত করায় হামাস ও ইসরাইলের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়ায় বড় ধরণের সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। খবর বিবিসি ও আল জাজিরা।
১৯ জানুয়ারি কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের সপ্তম বন্দি বিনিময়ের অংশ হিসেবে শনিবার ছয় ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। বন্দি বিনিময়ের অংশ হিসেবে শনিবার ৬২০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল ইসরাইলের। তবে বিস্ময়করভাবে এ প্রক্রিয়া আটকে দিয়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, হামাস পরবর্তী জিম্মি মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি 'বিলম্বিত' হবে। ইসরাইলের এই সিদ্ধান্ত গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর এই পদক্ষেপকে 'প্রতারণামূলক বিলম্ব' এবং 'যুদ্ধবিরতি চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন' বলে অভিহিত করেছে হামাস। যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম পর্যায়ে হামাসের পক্ষ থেকে ছয় জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার পর বাকি সব বন্দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে তেলআবিবে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে ইসরাইলিরা। যুদ্ধবিরতি ব্যর্থ করতে নেতানিয়াহু নেতানিয়াহু 'নোংরা খেলা' খেলছেন: বলে মন্তব্য করেছে হামাস। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গাজা শান্তিচুক্তি ব্যর্থ করার দায়ে অভিযুক্ত করেছে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন-হামাস। শনিবার আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হামাসের রাজনৈতিক শাখার সিনিয়র সদস্য বাসেম নাঈম এ অভিযোগ করেন। তাদের দাবি, গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তি নস্যাৎ করতে নেতানিয়াহু 'নোংরা খেলা' খেলছেন।
হামাসের অভিযোগ, ইসরাইলি সরকার দ্বিতীয় পর্যায়ের যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী নয়। আগামী ১ মার্চ যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম পর্যায়ের মেয়াদ শেষ হবে। এর আগেই আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী পর্যায় নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর কথা হামাস ও ইসরাইলের। বাসেম নাঈম জানান, আমরা বিশ্বাস করি, আবারও এই চুক্তিকে ভন্ডুল ও গুরুত্বহীন করার নোংরা খেলা চলছে। আর এই খেলার মাধ্যমে আবার নতুন করে যুদ্ধে ফিরে যাওয়ার বার্তা দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হামাস এবং চুক্তির অধীনে তাদের দায়িত্ব তারা পালন করেছে। তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ে ১০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী মানবিক সহায়তা গাজায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি এবং নেতজারিম করিডর (গাজাকে উত্তর ও দক্ষিণে সংযোগকারী সরু পথ) থেকে সেনা প্রত্যাহার স্থগিত রাখা হয়েছে। গত মাসের শুরুর দিকে, ইসরাইলি কর্মকর্তারা নিউ ইয়র্ক টাইমসকে নিশ্চিত করেছেন যে, হামাসের অভিযোগগুলো সঠিক।তবে ইসরাইলি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
\হএদিকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখন্ডে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে আরও সাত জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর ফলে অবরুদ্ধ এই উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা প্রায় ৪৮ হাজার ৩৩০ জনে পৌঁছেছে। দীর্ঘ ১৫ মাসের বেশি সময় পর গত মাসেই ফিলিস্তিনের গাজায় কার্যকর হয়েছে যুদ্ধবিরতি চুক্তি। তবে এরপর থেকেই সেখানে ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে একের পর এক উদ্ধার হচ্ছে নিহতদের লাশ। আর এতে করে বেড়েই চলেছে প্রাণহানির সংখ্যা। শনিবার রাতে এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু। বার্তাসংস্থাটি বলছে, ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্যকর্মী ও উদ্ধারকর্মীরা গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে আরও ৭ জনের লাশ উদ্ধার করেছেন। এর ফলে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের গণহত্যামূলক যুদ্ধে নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ৪৮ হাজার ৩২৯ জনে পৌঁছেছে বলে শনিবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি গোলাবর্ষণে গত ৪৮ ঘণ্টায় দুজন ফিলিস্তিনি মারা গেছেন এবং তারাও প্রাণহানির এই সংখ্যার মধ্যে রয়েছেন।