নদীর স্রোতের মতোই বয়ে চলে ভাষা। এ স্রোতের মাধ্যমেই ঘটে ভাষার রূপের পালাবদল। এ পালাবদলে ভাষা যেমন উন্নত হচ্ছে ঠিক তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘটছে ভাষার বিকৃতি। এটি বড় উদ্বেগের বিষয় আমাদের জন্য। এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের মধ্যে বৃদ্ধি করতে হবে সচেতনতা। ভাষার ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামে বাঙালিদের বিজয় লাভের পর ভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বেড়েছে ব্যাপকভাবে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে রফিক, শফিক, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে। যা ইতিহাসের বিরল ঘটনা। যার ফলে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলার সুযোগ লাভ করেছি। সারাবিশ্বে বাংলাভাষী মানুষ ২৬ লক্ষাধিক। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এদেশে শতকরা ৯৫ জনের কথ্য ও লেখ্য ভাষা বাংলা। ভাষা ব্যবহারে জনগোষ্ঠীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় নানা প্রবণতা, ফলে সৃষ্টি হয়েছে নানা সমস্যার। মুখের কথা যেভাবেই চয়ন করা হোক না কেন লেখ্য ভাষায় চাই শুদ্ধতা, পরিশীলনের চাপ, থাকা চাই লাবণ্য ও ব্যাকরণিত সমর্থন। বাংলা ভাষার বয়স প্রায় ১৪০০ বছর। এ দীর্ঘ সময়ে বাংলা সংযুক্ত হয়েছে নতুন নতুন উপাদান। আমাদের ভাষাভান্ডারে যুক্ত হয়েছে নানা বিদেশি ভাষা। আরবি, ফার্সি, পুর্তগিজ, ইংরেজি ইত্যাদি ভাষা থেকে আমরা গ্রহণ করেছি বিপুল শব্দ। বাংলা ভাষায় আছে সংস্কৃত শব্দের অনেক ব্যবহার। বিভিন্ন শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে বাংলা ভাষা। তাই এ ভাষাজুড়ে আছে বানান, উচ্চারণের বিভিন্নতা। এই বিভিন্নতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আছে নানা বিতর্ক। সে বিতর্ক এমন যে কখনো কখনো প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ নিয়ে কথা বলাও রীতিমতো ভাবনার বিষয়। বাংলা ভাষায় অনেক ভুল শব্দ দীর্ঘকাল ধরে ব্যবহার করার ফলে এখন শুদ্ধ বাংলা শব্দ হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে একটি অপপ্রয়োগ ভাষা ব্যবহারকারীর চেতনায় এমনভাবে গেঁথে যায় পরে শুদ্ধ উচ্চারণকেই অশুদ্ধ মনে হয়। তাই, আমাদের ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অলম্বন করতে হবে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও বিশ্বের উলেস্নখযোগ্য জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষায় কথা বলে। ফলে বলাই যায় বাংলা ভাষার সূর্য এখন আর অস্তমিত হবে না। এ কথা যেমন আমাদের আশান্বিত করে, একই সঙ্গে উদ্বেগের প্রবণতাও নজরে পড়ে। বর্তমানে বানান, উচ্চারণ প্রয়োগে চলছে চরম অসঙ্গতি। এ অসঙ্গতির কারণে বাংলা ভাষা হারাতে পারে নিজস্বতা। বর্তমানে এফএম রেডিও, টেলিভিশন, নাটক-সিনেমা, বিজ্ঞাপনে বাংলা ভাষার প্রতি চরম উদাসীনতা ও অবহেলা প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলা ভাষার অপ্রয়োগের যে নৈরাজ্য চলছে তার ফলে বাংলা ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতাও প্রকট হচ্ছে। বলা বাহুল্য, অনেক ক্ষেত্রে ভাষা ব্যবহারকারীদের মধ্যেই ঘটে অপপ্রয়োগের ঘটনা। এক্ষেত্রে যারা লেখক তাদের সচেতন হওয়া খুব জরুরি। কারণ তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাধারণ মানুষ অনেক সময় অনেক শব্দ ব্যবহার করে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি। এ ভাষার আছে এক সোনালি ইতিহাস। নানা উত্থান-পতনের পর বাংলা ভাষা আজকের পর্যায়ে এসেছে। এ ভাষাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের বীজ। এ ভাষার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারি জীবন দিয়েছে রফিক, শফিক, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকে। ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া একমাত্র বাঙালি জাতি জীবন উৎসর্গ করেছে। আর এই আত্মত্যাগকে সম্মান করে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রম্নয়ারিকে ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। পরিশেষে বলা যায়, আমাদের বাংলা ভাষা ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বাংলা ভাষায় আমরা যেন কোনো বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ না করি সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমরা যেন ভাষার নিজস্বতা বজায় রাখি এবং সর্বত্রে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট থাকি। না হলে একসময় বাংলা ভাষা নিজের প্রকৃত রূপ ভুলে স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিকৃত হয়ে যাবে। তাই আসুন মাতৃভাষার মর্যাদা দিতে শিখি, নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করি।
হাসনাত জাহান সিফাত
ফেনী সদর, ফেনী
আত্মশক্তি অর্জনই
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য
একটি দেশ, একটি জাতির অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হলো শিক্ষা। এই বিবেচনায় বলা হয়, 'শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড'। শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। অর্থাৎ মানুষের নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ্যকে বাড়ানোই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। প্রকৃত মানুষ হতে হলে আমাদের আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে হবে। আর আত্মশক্তি অর্জনের একমাত্র উপায় হচ্ছে শিক্ষা। প্রতিটি মানুষই চায় মর্যাদাবান হতে। এজন্য প্রয়োজন আত্মশক্তি। আর আত্মশক্তি অর্জনের জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়, বিবেক-বুদ্ধিকে জাগ্রত করে ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে। আত্মশ বলীয়ান মানুষ স্বনির্ভর হয়, স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ এবং কাজকর্ম করতে পারে। আত্মশক্তি না থাকলে মানুষ নিজের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। আত্মশক্তিহীন মানুষের পক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকতে হয়। আত্মশক্তি এমন একটি অদৃশ্য শক্তি যা মানুষের মধ্যে সুপ্তভাবে বিদ্যমান থাকে। এটিকে সঠিকভাবে সঠিক সময়ে আবিষ্কার করে নিতে হয়। যারা উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত কেবল তারাই তা আবিষ্কার করতে পারে। আর যারা মূর্খ, তারা এর সঠিক সন্ধান পায় না। এজন্যই মানুষ পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করার মানসে শিক্ষার্জন করে থাকে। শিক্ষাই একজন মানুষকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে যোগ্য করে তোলে যোগ্যতার বলেই মানুষ সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং দৃঢ় মনোবলের অধিকারী হয়। হাদিসে আছে, 'যে ব্যক্তি প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করে, তার মৃতু্য নেই।' আমরা পুঁথিগত বিদ্যার্জনের মধ্যদিয়ে সনদপত্র লাভকেই শিক্ষা মনে করি। আমাদের এ ধারণা নিতান্তই ভুল। এ ভুল ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। শুধু সনদপত্র লাভ বা ডিগ্রি অর্জনের মধ্যদিয়ে শিক্ষা পরিপূর্ণ হয় না।
পরিপূর্ণ শিক্ষার জন্য ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি প্রকৃতি তথা বাস্তবতা থেকে শিক্ষালাভ করতে হবে। এমনকি ডিগ্রি অর্জন ছাড়াও কেউ প্রকৃত শিক্ষিত হতে পারে ইতিহাসে এর নজির রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে শিক্ষার উদ্দেশ্য সনদপত্র লাভ নয়, বরং আত্মশক্তি অর্জন। তাই শিক্ষার সকল ক্ষেত্রে আমাদের আত্মশক্তি অর্জনে ব্রতী হতে হবে। তবেই শিক্ষা সার্থক হবে। শিক্ষা মানুষের আত্মশক্তিকে বিকশিত করে দৃঢ় মনোবলের অধিকারী করে এবং জাতীয় অগ্রগতি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। তাই আত্মশক্তি অর্জনে শিক্ষাকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে। আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, 'শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন করতে সুদূর চীন দেশে হলেও যাও'। প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মানুষের মন-মানসিকতার উৎকর্ষ সাধন সম্ভব হয়। একটি কুপিবাতি যেমন তার পার্শ্ববর্তী এলাকাকে আলোকিত করে তোলে, ঠিক একজন মানুষ যখন সমাজে বিকশিত হয়ে ওঠেন তখন তার সঙ্গে তার পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রও আলোকিত হয়ে ওঠে।
সিনথিয়া সুমি
শিক্ষার্থী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়