শব্দদূষণ এই সময়ের জন্য মারাত্মক একটি সমস্যা। এই সমস্যার প্রধান এবং অন্যতম কারণ হচ্ছে সড়কে অহেতুক হর্ন বাজানো। সড়কে চলাফেরা করার সময় দূরপালস্নার বাস-ট্রাকের হর্নে এখন কান পাতা দায়। আর সেই হর্ন যদি হাইড্রোলিক হর্ন হয়ে থাকে তাহলে তো ভয়ংকর যন্ত্রণা। সিএনজি, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস এমনকি মোটরচালিত রিকশায়ও এখন উচ্চমাত্রার হর্ন ব্যবহার করে। হর্ন ব্যবহারে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু অহেতুক হর্ন কেন বাজবে? সামনে পেছনে কোনো গাড়ি নেই, কিন্তু হর্ন বাজছে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ প্রয়োজন আমাদের।
বর্তমান সময়ে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অথবা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বাজিয়ে সড়কে ব্যক্তিগত গাড়িও চলাচল করে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, অ্যাম্বুলেন্সে কোনো রোগী নেই, কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সটির সাইরেন বাজছে অনবরত।
আজকাল ছোটোখাটো গাড়িতেও হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার হয়। যদিও মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩ অনুযায়ী কোনো গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন সংযোজিত পাওয়া গেলে জরিমানার বিধান আছে। তবে জরিমানার অঙ্ক মাত্র ১০০ টাকা! এই জরিমানা দিয়ে চালকরা এখন এই হর্ন ব্যবহার করতে পারছে। যার কারণে এই হর্ন ব্যবহারে চালকরা আরও উৎসাহী হচ্ছে। এছাড়াও বর্তমান সময়ে সড়কে অতিরিক্ত উচ্চমাত্রায় হর্ন বাজার কারণে চালকদের শাস্তি দিতে দেখা যায় না। ট্রাফিক পুলিশ এই বিষয়টা নিয়ে তেমন গুরুত্বই দেয় না।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, একজন সুস্থ মানুষ ২০ থেকে ২০,০০০ স্পন্দনের শব্দ শুনতে পারে। মানুষের শব্দ গ্রহণের স্বাভাবিক মাত্রা ৪০-৫০ ডিবি পর্যন্ত। এমন অনেক হর্ন রয়েছে, যে হর্নগুলো ৬০ ডিবি থেকে শুরু করে ১২০ ডিবি পর্যন্ত শব্দ উৎপন্ন করে। সাধারণত ৬০ ডিবি শব্দ মানুষকে সাময়িকভাবে এবং ১০০ ডিবি শব্দ সম্পূর্ণ বধিরতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই এ ধরনের হর্ন শব্দদূষণের এবং স্বাস্থ্যহানির অন্যতম কারণ।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মতে, বিকট শব্দ সুস্থ মানুষের জন্য তো বটেই, শিশু, শিক্ষার্থী এবং রোগীদের জন্য মারাত্মক ভয়ানক। এ কারণে মানুষ বধিরতার মতো রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ ছাড়া হঠাৎ হর্ন বাজানোর ফলে মানুষের মনে ভীতির সৃষ্টি হয়। এই ভীতি মানসিক রোগের কারণ হতে পারে। যা কোনো সুস্থ মানুষের জন্যই সুখকর নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্কুটার বা মোটরসাইকেলের হর্ন ৮৭ থেকে ৯২ ডিবি এবং ট্রাক-বাস ৯২ থেকে ৯৪ ডিবি শব্দ সৃষ্টি করে। শব্দের বাঞ্ছনীয় মাত্রা রয়েছে- যা ব্যক্তিগত কক্ষে ২৫ ডিবি, ড্রয়িং বা ডাইনিং কক্ষে ৪০ ডিবি, অফিসে ৩৫-৪০ ডিবি, শ্রেণিকক্ষে ৩০-৪০ ডিবি, গ্রন্থাগারে ৩৫-৪০ ডিবি, হাসপাতালে ২০-৩৫ ডিবি, রেস্তোরাঁয় ৪০-৬০ ডিবি এবং রাত্রিকালে শহর এলাকায় ৪৫ ডিবি। শব্দ এই সীমা অতিক্রম করলে শব্দদূষণের সৃষ্টি হয়। সীমার বাইরের শব্দদূষণ শ্রবণক্ষমতা নষ্ট করে। এর ফলে মানসিক ভারসাম্যও বিনষ্ট হতে পারে। শব্দদূষণ খিটখিটে মেজাজ সৃষ্টিরও কারণ। এর দ্বারা ফুসফুস আক্রান্ত হয়, শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বাধাগ্রস্ত হয় এবং তাদের লেখাপড়ায় উদাসীন করে তোলে।
মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতোমধ্যে দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ, ফুসফুসজনিত জটিলতা, মস্তিষ্কবিকৃতি, স্মরণশক্তি হ্রাস, মানসিক চাপসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা।
অযথা হর্ন বাজানোর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। 'হর্ন হুদাই...' নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পেজও রয়েছে। এভাবে মানুষ বিভিন্ন মাধ্যমে এই অহেতুক হর্ন বাজানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। তাই অনর্থক, অহেতুক হর্ন বাজানো বন্ধ করতে আমাদের সবার যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে এবং এর প্রতিবাদে সরব হতে হবে। এছাড়াও মানুষের ক্ষতি হয়, এমন হর্ন ব্যবহার বন্ধ হওয়া জরুরি। যে গাড়িতে যে হর্ন মানানসই, সে হর্ন ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গাড়ির চালকের পাশাপাশি গাড়ির মালিকদেরও সতর্ক হওয়া উচিত।
আসুন আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে এই মারাত্মক ব্যাধির বিরুদ্ধে সচেতন এবং প্রতিবাদে সরব হই। তবেই এই সমস্যার সমাধান কিছুটা হলেও হবে। অন্ততপক্ষে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এর সুফল ভোগ করবে।
আজহার মাহমুদ : কলাম লেখক