শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বঙ্গবন্ধু হত্যার কুশীলব কারা?

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তাক্ত লাশ সিঁড়িতে রেখেই তার দীর্ঘকালের সহচররা খন্দকার মোশতাক আহমেদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। তারা কেন যোগ দিয়েছিলেন? ভয়ে না অন্য বিশেষ কারণে, নতুনভাবে এটা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। যৌক্তিক কারণে একটি নিরপেক্ষ জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠন জরুরি। জাতি জানতে চায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রকৃত কুশীলব কারা ছিল? কজন তরুণ সেনা কর্মকর্তার পরিকল্পনায় এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হতে পারে না। এই হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী।
সালাম সালেহ উদদীন
  ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:৪২
বঙ্গবন্ধু হত্যার কুশীলব কারা?
বঙ্গবন্ধু হত্যার কুশীলব কারা?

একটি পুরনো প্রশ্ন ঘুরেফিরে বারবার সামনে আসছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার কুশীলব কারা? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪৫ বছরেও পাওয়া যায়নি। যেসব তরুণ সামরিক কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত এবং হত্যার দায়ে যাদের মৃতু্যদন্ড হয়েছে, এখনো বিভিন্ন দেশে বেশ কজন পালিয়ে আছেন, এর বাইরে কারা কারা জড়িত, মূল পরিকল্পনাকারী কারা, কারা রাষ্ট্রীয়ভাবে এর সুবিধাভোগী এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। প্রতি বছর ১৫ আগস্ট এলে পক্ষে-বিপক্ষে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়। এ পর্যন্তই। এবারের ১৫ আগস্টেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।

1

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের সঙ্গে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং দলটির প্রয়াত নেতা কর্নেল তাহেরও জড়িত বলে সরাসরি অভিযোগ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম সফিউলস্নাহ ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানও ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের এই জ্যেষ্ঠ নেতা। তবে শেখ সেলিমের বক্তব্যকে 'রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়' দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু।

তিনি বলেছেন, '১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আপন মামা বঙ্গবন্ধু ও আপন ভাই শেখ মনির লাশ ফেলে রেখে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের সঙ্গে যুক্ত তৎকালীন আমেরিকার দূতাবাসে গিয়ে শেখ সেলিম কী করছিলেন, তা জাতি জানতে চায়।' বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড নিয়ে শেখ সেলিম ও হাসানুল হক ইনু এমন বক্তব্য রাখলেও দুজনই এই হত্যাকান্ডের পূর্বাপর ঘটনা উদ্‌ঘাটনে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট হত্যাযজ্ঞের কুশীলবদের খুঁজে বের করে জাতির সামনে তুলে ধরার আহ্‌বান জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকও। এজন্য একটি কমিশন গঠন করে কঠিন বিচার করার কথা বলেন তিনি।

\হবঙ্গবন্ধু হত্যার কুশীলব কারা তা এখন জাতির কাছে স্পষ্ট উলেস্নখ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, কারা হত্যাকান্ডের বেনিফিশিয়ারি, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাক কাকে সেনাপ্রধান করেছিল, জিয়ার ভূমিকা কী ছিল, খুনিরা হত্যাকান্ড ঘটিয়ে কার কাছে রিপোর্ট করেছিল, তখন জিয়ার মন্তব্য কী ছিল? এসব ঐতিহাসিক সত্য বিএনপির নেতারা নতুন করে বাকপটুতায় ধামাচাপা দেওয়ার নির্লজ্জ ব্যর্থ চেষ্টা করছেন, যা করে কোনো লাভ নেই। বিএনপির শিবের গীত জনগণের কাছে এখন পরিষ্কার। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কারা নিরাপদে বিদেশে চলে যেতে সহযোগিতা করেছিল? কারা পুনর্বাসন ও পুরস্কৃত করেছিল, দূতাবাসে কে চাকরি দিয়েছিল এসব প্রশ্নের জবাব চেয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, তা না হলে জিয়াউর রহমানকে ধোয়া তুলসি পাতা বানানোর অপচেষ্টা জনগণ কখনো মেনে নেবে না।

জাসদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার এজাহার, এফআইআর, তদন্ত, চার্জশিট, সাক্ষীদের জেরা ও সওয়াল জবাব, চার্জের ওপর আদালতে যুক্তিতর্ক, আদালতের রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণের কোথাও জাসদ বা জাসদের কোনো নেতার নাম পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি। জাসদ গঠন ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্তি বঙ্গবন্ধুকে দুর্বল করে দিয়েছিল, একা করে দিয়েছিল, অসহায় করে দিয়েছিল এটা সত্য। কিন্তু যারা জাসদ গঠন করেছিলেন তারা জাসদ গঠনের আগে বঙ্গবন্ধুকে তার নেতৃত্বে বিপস্নবী জাতীয় সরকার গঠনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কাদের চাপে বঙ্গবন্ধু বিভক্তির পথে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকেও বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল তাও আজ জাতির সামনে প্রকাশিত। সুতরাং জাসদ গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্ত করার দায়ও জাসদের না, বরং ওই ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীরই। এই ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্ত করে বঙ্গবন্ধুকে একলা ও অসহায় করে চাটার দল, চোরের খনির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল।' বলা হয়ে থাকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপট তৈরিতে জাসদের তৎকালীন সরকারবিরোধী কর্মকান্ড বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। এটি জাসদ কীভাবে খন্ডন করবে।

এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মীর্জা ফখরুল বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সম্মানিত নেতা। তার হত্যাকান্ডের বিষয়ে বিএনপি সব সময় নিন্দা জানিয়েছে। এই হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে। অথচ এখনো আওয়ামী লীগ নতুন একটা গান গাইছে, জিয়াউর রহমান এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ এটি প্রমাণ করতে পারেননি। কেউ বলেননি, জিয়াউর রহমান সম্পৃক্ত ছিলেন।' জিয়াউর রহমান যখন হত্যাকান্ডের খবর শুনলেন শাফায়াত জামিলের কাছ থেকে যে, অ্যানাউন্স শুনলাম প্রেসিডেন্ট কিল হয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, 'সো হোয়াট? লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার। উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ পলিটিক্স।' তার এ কথার মানে কী। অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রিসভা গঠনের আগে মোশতাক যাদের নিয়ে মিটিং করেছিলেন, তাদের মধ্যে জিয়াউর রহমানও ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে শাস্তি এড়ানোর সুব্যবস্থা প্রদানের জন্য বাংলাদেশে 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। যেহেতু বাংলাদেশ সংসদ অধিবেশনে ছিল না, সে ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ কর্তৃক একটি অধ্যাদেশের আকারে ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫ সালে এ আইনটি প্রণীত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর তিনিই দেশটির রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫০ নামে অভিহিত ছিল। পরে ১৯৭৯ সালে সংসদ কর্তৃক এটি অনুমোদন করা হয়। যার ফলে এটি একটি আনুষ্ঠানিক আইন হিসেবে অনুমোদন পায়। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে এ আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জিয়াউর রহমান কেন এটাকে আইনে পরিণত করেছিলেন?

প্রশ্ন উঠতে পারে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের জন্য দায়ী কে, মোশতাক না জিয়া? যেহেতু মোশতাক সরকার ছিলেন সেনা সমর্থিত, জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাপ্রধান সেহেতু এর দায় তিনি এড়াতে পারেন না। খুনিদের জন্য পদোন্নতি, সুযোগ-সুবিধা সবসময়ই অবারিত ছিল। ১৯৭৬ সালের ৮ জুন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেন। শুধু তাই নয়- এসব খুনি এরশাদ ও খালেদা জিয়া সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রাজনীতিতে অংশ নেন এবং রাজনৈতিক দল গঠন করেন।

এখানে বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন তারই সরকারের অর্থমন্ত্রী ও বাকশালের কার্যকরী কমিটির ১৫ সদস্যের ৪ নম্বর সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ। কুমিলস্নার দাউদকান্দি উপজেলার সন্তান মোশতাক আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৪২ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম মহাসচিব এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কতিপয় সেনা সদস্যদের হাতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মোশতাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন।

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তাক্ত লাশ সিঁড়িতে রেখেই তার দীর্ঘকালের সহচররা খন্দকার মোশতাক আহমেদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। তারা কেন যোগ দিয়েছিলেন? ভয়ে না অন্য বিশেষ কারণে, নতুনভাবে এটা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। যৌক্তিক কারণে একটি নিরপেক্ষ জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠন জরুরি। জাতি জানতে চায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রকৃত কুশীলব কারা ছিল? কজন তরুণ সেনা কর্মকর্তার পরিকল্পনায় এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হতে পারে না। এই হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী।

প্রত্যক্ষ হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, একদিন পরোক্ষদেরও বিচার হবে। প্রমাণসহ জাতি তাদের নাম জানতে পারবে।

যারা মন্ত্রী না হয়ে হত্যার প্রতিবাদ করে কারাগারকে বেছে নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদসহ বেশ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের মাঝামাঝি সময়ে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। মোশতাকের মন্ত্রিসভা বহাল থাকা অবস্থাই ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে তারই ঘনিষ্ঠ সহচরদের মন্ত্রী হওয়ার ঘটনা খন্দকার মোশতাক সরকারের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল।

খন্দকার মোশতাকের ৮১ দিনের শাসনামলে সঙ্গী ছিলেন বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার ২১ সদস্য। মোশতাকের উপ-রাষ্ট্রপতি হলেন মোহাম্মদউলস্নাহ। আর মন্ত্রিসভার সদস্যরা হলেন- পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর, পরিকল্পনামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী, অর্থমন্ত্রী ড. আজিজুর রহমান মলিস্নক, শিক্ষামন্ত্রী ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল মান্নান, কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মোমিন, এলজিআরডি মন্ত্রী ফণিভূষণ মজুমদার, নৌপরিবহণ মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, গণপূর্ত ও গৃহায়ণ মন্ত্রী সোহরাব হোসেন। প্রতিমন্ত্রীরা হলেন- ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান, ভূমি ও বিমান প্রতিমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, রেল ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শিল্প প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম চৌধুরী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল, পশু ও মৎস্য প্রতিমন্ত্রী রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়া, যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আলতাফ হোসেন ও মোমিনউদ্দিন আহমদ (বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় ছিলেন না)। এ ছাড়া মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী রাষ্ট্রপতি মোশতাকের প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হয়েছিলেন মন্ত্রীর সমমর্যাদায়। মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যারা স্থান পেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন নতুন। বাকিরা সবাই ছিলেন বাকশাল সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য। মোশতাক ক্ষমতা গ্রহণের সময় প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করা হয়। ফলে তার সরকারে কোনো প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৮ সালের ২৯ জুন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত ছিল। ওই সময়ে বিদেশে থাকা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেননি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই বছরের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ অভু্যত্থান ঘটালে ৮১ দিনের মাথায় ৫ নভেম্বর ক্ষমতাচু্যত হয় মোশতাক সরকার। পরে ৭ নভেম্বর আরেকটি পাল্টা সামরিক অভু্যত্থানে ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান।

খন্দকার মোশতাক সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের পথ উন্মুক্ত করে দেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মহিউদ্দীন আহমদ বিশেষ দূত হয়ে। মোশতাক সামরিক শাসন কায়েম করলেও জাতীয় সংসদ বহাল রেখেছিলেন। স্পিকার ছিলেন আবদুল মালেক উকিল। স্পিকার হওয়ার আগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত নিলে এর প্রতিবাদ জানান মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা জেনারেল এম এ জি ওসমানী। প্রতিবাদে জাতীয় সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। কিন্তু সেই ওসমানীই আবার মোশতাকের নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন।

গণভবন থেকে ১৫ আগস্ট রোববার সকালে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ কৃষক লীগ আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্ত ও পস্নাজমা দান কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'বাংলাদেশ যেন কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেজন্যই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তবে আমার অবাক লাগে, এর সঙ্গে আমাদের যারা তারা কি করে জড়িত থাকল? হত্যার বিচার করেছি। তবে এই ষড়যন্ত্রের পেছনে কারা সেটা এখনো আবিষ্কার হয়নি। তবে সেটা একদিন না একদিন আবিষ্কার হবে এটা ঠিক।' তিনি বলেন, 'দুঃখজনক হলো, নিজের দলের ভেতরে খন্দকার মোশতাক যেমন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল আবার অনেকেরই তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল। আর এই ঘটনা ঘটাতে হলে সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্যকে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু উচ্চপর্যায়ে যদি তাদের পক্ষে কেউ না থাকে এটা কখনো সম্ভব ছিল না।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আক্রমণের সময় শেখ মুজিবুর রহমান তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিনকে ফোন করে তার বাড়িতে আক্রমণের কথা জানিয়েছিলেন। কর্নেল জামিল তখন সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়েছিলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির দিকে। কিন্তু সোবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌঁছলে তার গাড়ি রোধ করে অভু্যত্থানের সঙ্গে জড়িত সৈন্যরা। সে বাধা উপেক্ষা করে কর্নেল জামিল সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এটা সত্য কর্নেল জামিলই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত অনুরাগী। বাকিদের কথা ইতিহাস জানে। যার কারণে কোনো প্রতিবাদ হয়নি। হত্যার অনেকদিন পর বাংলা একাডেমিতে কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রতিবাদী কবিতা পাঠ করেন। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সব সদস্যকে হত্যার পর ঘাতকরা একে অন্যকে বলছিল, 'অল আর ফিনিশড (সবাই শেষ)'। তারাই এখন ফিনিশড হয়ে গেছে। ইতিহাসে তারা ঘৃণিত ধিকৃত।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। খুনিদের বিচারের মাধ্যমে সে কালো অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছে ঠিকই, তবে বিতর্ক এখনো শেষ হয়নি। তৎকালীন আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা জড়িত ছিলেন, জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন কিনা এবং জাসদের কেউ জড়িত ছিলেন কিনা, জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে তা উদ্‌ঘাটন করা হোক। তা না হলে আগস্ট মাস এলেই বিতর্ক ও কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হবে। এর অবসান ঘটাতে হবে বর্তমান সরকারকেই।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে