সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বন্যা-নদীভাঙন :জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

পৃথিবী যখন পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন, জলবায়ু যখন উত্তাল হয়ে উঠেছে; সেই সময়টাতেই আমরা সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বেষ্টনকারী বন ধ্বংস করে চলেছি। ধ্বংস করে চলেছি চট্টগ্রামে সিআরবি এলাকার বনজ প্রকৃতি। মধুপুর এবং পার্বত্য বনের গাছ নিয়মিত চুরি হয়ে যাচ্ছে বনদসু্যদের মাধ্যমে।
সজীব ওয়াফি
  ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
বন্যা-নদীভাঙন :জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুরো পৃথিবীজুড়ে জোরেশোরে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। কোথাও বন্যা, কোথাও ঘূর্ণিঝড়, আবার কোথাও দাবানলে দাউ দাউ করে পুড়েছে বিস্তীর্ণ বনভূমি। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, পাহাড় ধস, মরুকরণ, খরার ব্যাপকতা বেড়েছে বহুগুণে। জলবায়ুর এই পরিবর্তন প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশেও। ছয় ঋতুর দেশে গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত বাদে বাকিগুলো বিলুপ্ত হয়েছে চোখের অগোচরে। সিডর, আইলা, ইয়াসের মতো প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত দক্ষিণাঞ্চল। সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে লবণ পানিতে বিপর্যস্ত উপকূল। প্রতি বছর ঢলের পানিতে বারবার তলিয়ে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চল। বন্যার কবলে পড়ে ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে হাজার হাজার কিলোমিটার ভূমি, বসতবাড়ি, ক্ষেত-খামার।

জলবায়ুর পরিবর্তনের একমাত্র কারণ বাতাসে অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড। অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নিতে পর্যাপ্ত গাছের অনুপস্থিতি। একটি দেশে ২৫ ভাগ বনভূমি প্রয়োজন। আমাদের আছে মাত্র ১৭ ভাগেরও অনেক কম। যা আছে সেগুলোও আবার চলে নির্বিচারে কর্তন। অন্যদিকে কলকারখানা ধোঁয়া, রান্নাবান্না, গাড়ির ধোঁয়া, এয়ারকন্ডিশন, ফ্রিজ, ইত্যাদি নিয়মিত কার্বন ছেড়ে পরিবেশ দূষিত করছে হরহামেশাই। বিপরীতে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণে ভুটানের মতো সবুজায়ন করতে উদাসীনতা লক্ষণীয়। বাতাসে আরও অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড ছাড়ছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো। কিন্তু নিঃসরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা তারা করছে না। শীতপ্রধান রাষ্ট্রগুলো ব্যবহার করে গ্রিনহাউস প্রক্রিয়া। গ্রিনহাউস প্রক্রিয়া বলতে- কাচের তৈরি ঘর। অতিরিক্ত শীতে গাছপালা মারা যায়; যার কারণে কাচের তৈরি ঘর ব্যবহার করা। এ পদ্ধতি দিনের সূর্যের আলোর গরম রাতেও ধরে রাখতে সক্ষম হয়। পরিণামে পৃথিবী উষ্ণ হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। গলতে শুরু করেছে হিমালয় পর্বতসহ বেশকিছু পর্বতের বরফখন্ড। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায়- বর্ষায় ভারতের অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং হিমালয়ের গলিত বরফ পানি তুফান হয়ে ভেসে আসে সমুদ্রপোকূলের দিকে।

1

গত কয়েকদিন ধরে উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। শুধু অবনতি বললে ভুল হয়। কারণ এবারের বন্যায় ভাঙন পরিস্থিতি আগের তুলনায় উৎকণ্ঠার, উদ্বেগজনক। তিস্তার বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে শতাধিক ঘরবাড়ি। যমুনার ভাঙনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি, মসজিদ, ক্লিনিক। বিপন্ন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে উঁচু জায়গায়, বাঁধের উপর এবং আশ্রয় কেন্দ্রে। ঘরবাড়ি-গরু-ছাগল স্রোতের পানিতে একাকার। আঘাত এসেছে জীবন-জীবিকায়। বন্যার পানিতে রাস্তা-ঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, ভরে উঠেছে খানাখন্দে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখোমুখি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হঠাৎ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত; বৃষ্টিপাতের সেই পানি উজানের ঢলেই কাল হয়েছে নদীপাড়ের মানুষের। শেষ সম্বল ভিটেটুকু হারিয়ে কপালে হাত দিয়ে বসে পড়েছেন কেউ কেউ।

আমাদের প্রধান প্রধান নদীগুলো প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য হয়ে নেমে এসেছে। নদীর উপর তারা নির্মাণ করেছে বাঁধ। বিশেষ করে পদ্মার উপরে ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তায় তিস্তা বাঁধ এবং টিপাইমুখী বাঁধ নির্মাণ করেছে ব্রহ্মপুত্রের উজানে। অন্যান্য সময়ে আটকে রাখা হয় এই বাঁধগুলো। কেবলমাত্র বর্ষার সময়ে যখন ঢলের পানিতে চাপ পড়ে, তখনই ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলাফলে হঠাৎ করে ব্যাপক পানির তোড়ে ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম। পস্নাবিত হয় অধিকাংশ অঞ্চল। পানির স্রোতের সঙ্গে ভেঙে ভেসে যায় বসতবাড়ি। বাঁধের কারণে নদীগুলোতে নাব্য নেই। দীর্ঘদিন পানি না থাকায় মরে গেছে অনেক নদীর তলদেশ। শুকিয়ে যাওয়ায় ছোট-বড় নদী, এমনকি খালের অধিকাংশ জায়গা দখল হয়েছে দখলদার কর্তৃক। পানি ধারণক্ষমতার মাধ্যম যদি মরে যায় বা দখল হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঢলের পানি নামবে কোথা থেকে? নদীর মুমূর্ষু সংকটে লোকালয় থেকেই তো নামবে। শুকিয়ে যাওয়া নদী হঠাৎ বিপদসীমার উপরে নাব্য পেলে ভাঙন তৈরি হবে স্বাভাবিক। বাঁধগুলো যদি না থাকত অথবা পানির নির্দিষ্ট চাপ পড়ার আগেই খুলে দেওয়া সম্ভব হতো; তবে কিন্তু দরিদ্র মানুষকে প্রতি বছর এভাবে দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয় না।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে- বিগত চার দশকে প্রায় এক লাখ হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বেসরকারি হিসাবে এর পরিমাণ আরও ঢের বেশি। মোটকথা ভাঙনের কবলে পড়ে প্রায় ছোটখাটো একটা জেলা পরিমাণ ভূমি হারিয়েছে বাংলাদেশ। ভাঙতে ভাঙতে মনপুরার মতো দ্বীপগুলো ছোট হয়ে গেছে। মানুষ হয়েছে উদ্বাস্তু। হয়েছে দিশাহারা। ভাঙনে ভুক্তভোগী অনেক পরিবার এনজিওর ঋণে হয়েছে ন্যস্তনাবুদ। সব হারিয়ে সামাজিক কলহ যেমন বেড়েছে তেমন বেড়েছে নারী নির্যাতন। বন্যা কবলিত এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা তো আছেই। অথচ এই নদীকে আমরা গলাটিপে হত্যা করেছি কখনো ব্যক্তি মালিকানায়, কখনো রাষ্ট্রীয় পর্যায়।

নদী হচ্ছে জাতীয় জীবন্ত সত্তা। নদী বাঁচলেই নগর বাঁচবে, বাঁচবে সভ্যতা। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে নগর-বন্দর; নচেৎ নয়। নদী না বাঁচলে সেখানে তেলাপোকাও টেকে না। বরঞ্চ রূপান্তরিত ঘটে মরুপ্রান্তরে। অথচ আমাদের যৎসামান্য কোনো ভ্রম্নক্ষেপ নেই। দীর্ঘদিন থেকে নদীর তলদেশে ড্রেজিং হচ্ছে না। শুকিয়ে যাওয়ায় যে যেরকম পারছে দখল করে ব্যবহার করেছে। ভাঙন রোধে উপর্যুক্ত সময়ে নেওয়া হয়নি কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা। তাৎক্ষণিক ফেলা হচ্ছে জিও ব্যাগ। বর্তমান প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের যুগে একটু সচেতনভাবে কাজ করা যেত। নদীর পাশাপাশি রক্ষা করা যেত নদীভাঙা হাজারো মানুষের পোড়া কপাল। গালিচার মতো আচ্ছাদন বা কভার নদী তীরবর্তী ভূমিকে প্রবল ঢেউ থেকে রক্ষায় বিশ্ব স্বীকৃত পন্থা। কিন্তু আমরা সে পথে কখনোই হাঁটিনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি এবং ভাঙন রোধে বাজেট পাস হতে হতে ভাঙন আরও বিস্তৃত হয়। আমরা হেঁটেছি অসংখ্য ক্ষুদ্র বস্তুর আচ্ছাদনের দিকে, যেমন- প্রচুর পাথর, কংক্রিটের বস্নক ও বালিভর্তি জিও ব্যাগ। টাকা খরচ হয়েছে বিপুল অঙ্কের, কিন্তু কাজের কাজ হয়নি মোটেই। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক কূটনীতিক ব্যর্থতা ছিল সব সরকারের আমলেই। ১৯৭৪ সালের ১৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশ ভারত যৌথ নদী কমিশন গঠন করলেও বিগত সরকারগুলোর আমলে এ কমিশনের গতিশীলতা হারায়। মাঝি-মালস্নারা হারিয়েছে মনের সুখ, হারিয়েছে নিদারুণ প্রাণচাঞ্চল্য ভাটিয়ালি গান।

আমাদের সক্ষমতায় ঘাটতি আছে এটা সত্য। তবে যতটুকু আছে ততটুকুও যথাযথ প্রয়োগ অনুপস্থিত। ভাঙনের পর নদীতে জমি জেগে উঠলে শুরু হয় প্রতিযোগিতার অসম দৌড়। ইদানীং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও এই কোন্দলে জড়িয়েছে। নদীর পাড় ভাঙলেই জমি খাস, তবে কি এই আইনের জন্যই নদীভাঙন রোধের অবহেলা? নাকি পানি উন্নয়ন বোর্ডের লাগামহীন দুর্নীতি? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন ধারণা নয়, এখন বাস্তব। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন ভাইরাসে। আক্রান্ত হচ্ছে পঙ্গপালের মতো বিধ্বস্তকারী কীট-পতঙ্গে। পৃথিবীর দিকে বিপদের চরম মাত্রা ধেয়ে আসছে ক্রমাগত। অথচ পরিবেশ বিপর্যয় আমরা ঠেকাতে পারছি না। জলবায়ু পরিবর্তনের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে বাঁধের কারণে শুকিয়ে যাওয়া পলি মাটি হঠাৎ পানি পেলে নরম হবে স্বাভাবিক। তখন তীব্র স্রোতে ভাঙবে না তো ভাঙবে কি? নদীর গতিপথে আমরা কেন হুমকি হয়ে উঠেছি!

করোনাকালে প্রকৃতি পৃথিবীকে তার দখল নিতে মানুষকে ঘরবন্দি করেছে। অতঃপর আমরা দেখলাম তরতর করে পরিবেশ কীভাবে সতেজ হলো। কি দাপট দেখালো ঢাকার শহরের ঝিমিয়ে পড়া মৃত প্রায় গাছগুলোও! শুশুক থেকে শুরু করে তিমি পর্যন্ত উপকূলের তৈরি করেছিল তাদের চলাচলের অভয়ারণ্য। এর অর্থ দাঁড়াল- মানুষ যখন পরিবেশের উপর আগ্রাসী ভূমিকা বলবৎ রাখবে, তখন প্রকৃতি মারমুখী হয়ে প্রয়োজনে মানুষের মৃতু্য ঘটিয়ে তার আপন পরিবেশে ফিরবেই। কিন্তু আমাদের সব কাজ, সব উন্নয়ন প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়েই। পরিবেশ-প্রতিবেশের বিপক্ষে কেন আমরা যুদ্ধে নামছি? বরং পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে সারা পৃথিবীতে মানব সভ্যতার উন্নয়নে তো কোনো বাঁধা নেই।

পৃথিবী যখন পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন, জলবায়ু যখন উত্তাল হয়ে উঠেছে; সেই সময়টাতেই আমরা সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বেষ্টনকারী বন ধ্বংস করে চলেছি। ধ্বংস করে চলেছি চট্টগ্রামে সিআরবি এলাকার বনজ প্রকৃতি। মধুপুর এবং পার্বত্য বনের গাছ নিয়মিত চুরি হয়ে যাচ্ছে বনদসু্যদের মাধ্যমে।

\হনদী, বায়ু, পানি তার চিরাচরিত প্রবাহে বহমান। বাঁধ দিয়ে তাকে আটকানো অসম্ভব; দরকার হলে সে তার গতিপথ পরিবর্তন করে হলেও সামনের দিকে ধাবিত হবে। জলবায়ুর এই পরিবর্তন ঠেকানো এখনই সময়ের দাবি। নতুবা বন্যা-ভাঙনের চেয়েও বৃহৎ কোনো বিপর্যয় আমাদের ভাগ্যে অপেক্ষা করছে।

সজীব ওয়াফি : প্রাবন্ধিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে