মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২

ঝরা পাতার জীবন সালাম সালেহ উদদীন

তোমার জীবনের লক্ষ্য কী- এ রচনা স্কুলজীবনে অনেকেই লিখলে ও পাঠ করলেও সবাই জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে পারে না। আবার পারলেও সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। এই না পারার কারণে বেশির ভাগ মানুষই জীবন সংগ্রামে পরাজিত হয়। পরাজয় মেনে নিয়ে কেউ কেউ ঝিম মেরে বসে থাকে। আবার কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আসলে জীবনের মীমাংসা জীবনকে বলিদানের মাধ্যমে হয় না। পরাজয় স্বীকার করার নামও জীবন নয়। ধৈর্য ও সাহসিকতার সঙ্গেই জীবনকে মোকাবিলা করতে হয়- সে জীবন যত তুচ্ছ অবহেলিত ও বঞ্চনাপূর্ণ হোক না কেন।
  ০৪ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
ঝরা পাতার জীবন সালাম সালেহ উদদীন

জীবন সংগ্রামশীল স্বপ্নময় স্মৃতিকাতর ভয়াবহ এক নরককুন্ড অথবা সুখের হাতছানি। জীবন জীবন নয় কিংবা জীবন ক্ষণিকের। জীবন সম্পর্কে যত কথাই বলা হোক না কেন- জীবনের সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। কোনো কবি, সাহিত্যিক, মনীষী, পন্ডিত, দার্শনিক এ পর্যন্ত জীবনের সঠিক সংজ্ঞা দিতে পারেননি। জীবনকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না বলেই জীবন এত তাৎপর্যপূর্ণ বৈচিত্র্যময়, নানা রং ও রেখার দ্বারা জীবনের প্রতিটি পরত ও বাঁক আঁকা। তাই খুব সহজে কেউ জীবনের মায়া ত্যাগ করতে চায় না। সবাই আত্মপ্রেমে মশগুল থাকে। খ্রিষ্টের জন্মেরও বহু আগে তাই গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন- 'নিজেকে চেনো'। তাই কোনো মানুষ এক জীবনেও নিজেকে চিনতে পারে না। অথবা এভাবে বলা যায় যে নিজেকে চেনা সহজ নয়। নিজেকে চিনতে পারলে মানুষ ও জগৎ চেনা যায়। জীবনকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভাগ করা যায়। এ সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের জীবন সম্পর্কে কোনো গভীর উপলব্ধি নেই। তারা মনে করেন জীবন একভাবে কেটে গেলেই হলো।

জীবন, সংসার, স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন বেঁচে থাকা কিংবা না থাকা এসব নিয়ে যত আক্ষেপই করি না কেন সবাই চায় জীবনকে অর্থবহ করতে কিংবা জীবনের সফলতা দেখতে। জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান হতে চান অনেকেই। অনেকেই আবার সারা জীবন অর্থ ও নারীবেষ্টিত থাকতে চায়।

তোমার জীবনের লক্ষ্য কী- এ রচনা স্কুলজীবনে অনেকেই লিখলে ও পাঠ করলেও সবাই জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে পারে না। আবার পারলেও সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। এই না পারার কারণে বেশির ভাগ মানুষই জীবন সংগ্রামে পরাজিত হয়। পরাজয় মেনে নিয়ে কেউ কেউ ঝিম মেরে বসে থাকে। আবার কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আসলে জীবনের মীমাংসা জীবনকে বলিদানের মাধ্যমে হয় না। পরাজয় স্বীকার করার নামও জীবন নয়। ধৈর্য ও সাহসিকতার সঙ্গেই জীবনকে মোকাবিলা করতে হয়- সে জীবন যত তুচ্ছ অবহেলিত ও বঞ্চনাপূর্ণ হোক না কেন।

আজ ৫৭ বছরে পা দিয়ে অনেক কথাই মনে পড়ে। বয়সের বিচারে যারা আমার উত্তরসূরি তারা অনেকেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। এই নগরে ৪০ বছর আগে এসে যে সব কবি-সাহিত্যিক, বৃদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, অধ্যাপকের সাহচার্য পেয়েছিলাম, তাদের অনেকেই পরপারে চলে গেছেন। এক বছর হলো চলে গেছেন আমার বাবাও। আজ মনে পড়ছে বাবার সঙ্গে রাতের বেলা পদ্মায় মাছ ধরার স্মৃতি। কখনো রাতের আকাশে থাকত পূর্ণ চাঁদ আবার কখনো অন্ধকার- এমন পরিবেশে বাবার সঙ্গে পদ্মায় মাছ ধরতে যেতাম। অন্ধকার থাকলে হারিকেন নিয়ে যেতাম। আর পূর্ণিমা থাকলে তো কথাই নেই। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ত নদীতীরবর্তী বালুতে পানিতে। সে এক মোহনীয় পরিবেশ। এমন দৃশ্য যে দেখেনি, সে কল্পনাও করতে পারবে না। আমি কিছুটা ভয়ার্ত হয়ে একবার নদীর দিকে আর একবার আকাশের দিকে তাকাতাম। তাকাতাম বাবার দিকেও।

বাবার গভীর মনোযোগ নদী ও মাছের দিকে। শরৎ কিংবা হেমন্তে রাতের বেলা পদ্মার পরিবেশ ছিল অনেকটা নিরাক পড়া ধান ক্ষেতের মতো। তবে রাতের নীরবতা ভেঙে কখনো কখনো মাছেরা জল কাঁপিয়ে শব্দ করত। সে শব্দের মধ্যে এক ধরনের মনহরণ করা ছন্দও ছিল। কোনো কোনো দিন প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। খালুই (মাছ রাখার বিশেষ ধরনের বাঁশের চাঁই) উঁচু করে আনতে পারতাম না। বাবা আমার দুরবস্থা দেখে মাছ ধরা শেষে তিনিই জাল আর খালুই বহন করে আনতেন।

আশির দশকের শুরুর দিকে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। এরপর ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের বাংলা বিভাগে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সাহিত্যের আদি উৎস কবিতা। প্রায় প্রত্যেক লেখকের জীবনই শুরু হয় কবিতা দিয়ে। শেষ পর্যন্ত কবিতায় থিতু হতে না পেরে অনেকেই সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় বিচরণ করেন। আবার কেউ কাব্যক্ষেত্রে টিকে থেকে সব্যসাচী লেখক হওয়ারও চেষ্টা চালান। কোনোটাই দোষের নয়। বাংলা সাহিত্যের এমন অনেক খ্যাতিমান লেখক রয়েছেন যাদের সফল পদচারণা সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই। দুর্জনেরা বলেন- কবিতা লিখে ব্যর্থ হয়েই গদ্য চর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েন লেখকরা। এর বিপরীতে অন্যরা বলেন- কবিতা লেখা সহজ কাজ, শব্দের পর শব্দ সাজালেই হয়। এ সব ছাপিয়ে যা বলতে চাই, তা হলো, আমিও কবিতা উপন্যাস দিয়েই লেখালেখির জীবন শুরু করেছিলাম। সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে এবং একপর্যায়ে জীবন সংগ্রাম তীব্র হওয়ার কারণে মনে হলো লেখালেখির মাধ্যমে আমি যা বলতে চাই কিংবা যে সংবাদটি পাঠককে দিতে চাই- তার মাধ্যমে পদ্য নয়-গদ্য। তারপরও কবিতার সূত্র ধরেই দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পাই। আশির দশকের শুরুর দিকে তিনি তখন দৈনিক বাংলার সম্পাদক। আমি ও আরেফিন ঢাকা কলেজের ছাত্র। আমরা দুজন কবিতা নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলাম। তার হাতে কবিতা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃদকম্পন শুরু হলো। কবি মৃদু হেসে বললেন, ভালো লাগলে ছেপে দেবো। আমরা দুজন সপ্তার পর সপ্তা দৈনিক বাংলার সাহিত্যের পাতা উল্টাতাম। আমাদের কবিতা ছাপার অক্ষরে দেখিনি। এই ঘটনার দিনকয়েক আগে আমি এক সন্ধ্যায় একা আহসান হাবীবের সঙ্গে দৈনিক বাংলায় দেখা করেছিলাম। তিনি আমার কবিতা পড়ে বললেন- ছন্দ ঠিকমতো হয়নি। আবার লিখে নিয়ে আসেন। শামসুর রাহমান আমাদের কবিতা না ছাপলেও তার প্রতি আমি বিরক্ত হইনি। কিংবা বৈরী মনোভাবও আমার ভেতরে তৈরি হয়নি। বরং তার সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব আমাকে আকর্ষণ করেছিল- যা প্রায়ই আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে বসে তরুণ-তরুণীরা গল্প করছে। তারুণ্যদীপ্ত এই অপরাজেয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী এক জীবন্ত ভাস্কর্য। আমি বাংলা বিভাগের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি অপরাজেয় বাংলার দিকে। একদিন ঢাকা কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যেভাবে অস্থির মন নিয়ে অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছিলাম, আজ এখানে দাঁড়িয়ে যেন নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছি। আজ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। সংগ্রামশীল স্মৃতিকাতর ভয়াবহ জীবনকে পেছনে ফেলে এসেছি আমি। যদিও এখনো পুরোপুরি মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারিনি। কিন্তু ভিত্তি যখন পেয়েছি তখন উপায় একটা হবেই, এই আত্মবিশ্বাস আমার রয়েছে। তাই আমার মনটা অজানা আনন্দে নেচে উঠল।

বাংলা বিভাগের অনেক বদনাম। যারা অন্য কোনো বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় না, তারাই কেবল বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়। এ মন্তব্য সর্বাংশে সত্য নয়। কারণ অনেক বোর্ড স্ট্যান্ট করা ছাত্রও বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করেছে। দেশের খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকদের অনেকেই বাংলা বিভাগের ছাত্র। বাংলা বিভাগ যে প্রতি বছর ডজন ডজন কবি-সাহিত্যিক জন্ম দেয় ঠিক তা নয়, এই বিভাগের সংস্পর্শে এলে কারও কারও লেখক সত্তা, কবি সত্তা বিকশিত হয়- এই যা। আমারও বিশ্বাস, আমিও এই বিভাগে ভর্তি হওয়ার মাধমে আমার লেখকসত্তার পুরোপুরি বিকাশ ঘটাতে পারব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই বিভাগের খ্যাতিমান শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় আমার। যেমন- সন্‌জীদা খাতুন, রফিকুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ওয়াকিল আহমদ, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, আবুল কাসেম ফজলুল হক, হুমায়ুন আজাদ, নরেন বিশ্বাস, মোহাম্মদ আবু জাফর, বেগম আকতার কামাল, ভীষ্মদেব চৌধুরী, বিশ্বজিৎ ঘোষ, রফিকউলস্নাহ খান প্রমুখ। বিভাগে নরেন বিশ্বাস খুব জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি কাব্যতত্ত্ব অলংকার অনুপ্রাস পড়াতেন। দরাজকণ্ঠে তিনি যখন পাঠদান করতেন তখন প্রথম বর্ষ সম্মানের ছাত্রছাত্রীরা বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে পারতেন না। তিনি উদ্দীপনামূলক কবিতার লাইন বলতেন- 'অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে।' আর আদ্যানুপ্রাস পড়াতে গিয়ে বলতেন, 'কাক কালো কোকিল কালো কালো কন্যার কেশ।' নরেন স্যারের এসব বচন আমরা সুযোগ পেলেই আওড়াতাম। খদ্দরের পাঞ্জাবি, জিন্সের প্যান্ট, চটি জুতোই তখন আমার একমাত্র পোশাক। কাঁধে কখনো কখনো ব্যাগ ঝুলাই আবার কখনো ঝুলাই না। ভেতরে লেখক প্রতিভা যাই থাকুক না কেন আমার বেশভূষাই আলাদা। যেন পুরো বাংলা বিভাগ ও বাংলা সাহিত্য শাসন করছি আমি। বাংলা বিভাগে একঝাঁক তরুণ তখন লেখক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। আমার সম্পাদনায় বাংলা বিভাগ থেকে অরুণিমা চার সংখ্যা দেয়াল পত্রিকা আকারে প্রকাশ পায়। বিভাগের সাহিত্যামোদীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় অরুণিমার প্রতি। অল্প সময়ের মধ্যে বিভাগে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এরপর অরুণিমা মুদ্রিত অক্ষরে লিটল ম্যাগাজিন আকারে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কবি-বন্ধু শামসুল আরেফিন। সম্ভবত বাংলা বিভাগ থেকে কম্পিউটার কম্পোজে অরুণিমাই প্রথম মুদ্রিত পত্রিকা।

আশির দশকের শেষের দিকে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছিল। যদিও ওই সময় সাহিত্য পত্রিকা লোকায়ত, একবিংশ, সাহিত্য সাময়িকী, সাহিত্যপত্র, অনিন্দ্য, রূপম, সুন্দরম, অর্চি, প্রেস, বিসুভিয়াস, কিছুধ্বনি বের হতো। লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে গান্ডিব বেরিয়েছে, তারও কিছু আগে। ঢাকার বাইরে থেকে বের হতো নান্দীপাঠ, বিপ্রতীপ, লিরিক, চালচিত্র, নিসর্গসহ বেশকটি লিটল ম্যাগাজিন। রাজধানীর বাইরে এই আন্দোলন তখনও ভাটা পড়েনি। তখন আরও কিছু পত্রিকা বের হতো যার নাম আমি এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না।

অরুণিমার প্রথম সংখ্যা যখন বের হয় তখন জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে বাংলা বিভাগের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান হয়। এর মধ্যে পদ্মা নদীতে আমাদের বাড়ি বিলীন হয়ে যায় ১৯৮৮ সালে। আমরা আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়ে যাই।

কথাসাহিত্যিক সুশান্ত মজুমদারের সহযোগিতায় সাপ্তাহিক মূলধারায় চাকরি নিই। এই পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন কবি শামসুর রাহমান। শামসুর রাহমান যখন অফিসে আসতেন তখন অফিসে সাজসাজ রব পড়ে যেত। প্রতিদিনই সাত-আটজন কবি-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তি তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা জমে উঠত। আসতেন জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকী, রশীদ করিম, সৈয়দ শামসুল হক, সিকদার আমিনুল হক, হুমায়ুন আজাদ, আবু কায়সার, শিহাব সরকার, নাসরিন জাহান, বাশিরা ইসলাম প্রমুখ। পত্রিকার সম্পাদকীয় লিখতেন কবি নিজে। মূলধারা প্রকাশিত হতো ম্যাগাজিন আকারে। অনেকটা ভারতীয় দেশ পত্রিকার আদলে। নানা বিষয়ের সন্নিবেশ ঘটত মূলধারায়। পত্রিকাটি উন্নতমানের হওয়া সত্ত্বেও তেমন পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করতে পারল না। পরে সিদ্ধান্ত হলো বিনোদন ট্যাবলয়েড হিসেবে প্রকাশ করার। তারপরেও পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৯২ সালের শেষের দিকে প্রগতিশীল দৈনিক আজকের কাগজে যোগ দিই। টানা ১৭ বছর তিনি প্রগতিশীল দৈনিক আজকের কাগজের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান ও সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এরপর ২০০৭ সালে ১৯ সেপ্টের পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর যোগ দিই দৈনিক যায়যায়দিনে। ১৩ বছর ধরে সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান ও সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।

লেখালেখির হাতে খড়ি কবিতা দিয়ে, অনেকের মতো আমারও। ৪৪ বছর আগের কথা, তখন আমি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। বনভোজন নিয়ে প্রথম কবিতা লিখি। এরপর নজরুলের অভিশাপ কবিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ১২০ চরণের দীর্ঘ কবিতা লিখি। স্কুল ও কলেজজীবনে ৮২টি কবিতা লিখেছি। নবম-দশম শ্রেণিতে লিখেছি তিনটি উপন্যাস। আমার প্রথম উপন্যাস আঁধার যখন নামে আঞ্চলিক সাহিত্যামোদীদের জন্য ছিল হটকেক। এরপর লিখি এখন অমাবস্যায় প্রহর ও অন্তর্ধান। এ সব কবিতা-উপন্যাস কোনোটিই বই আকারে বের হয়নি। মাঝেমধ্যে কবিতা লিখলেও সাড়ে তিন বছর আগে থেকে নিয়মিত লিখতে শুরু করি, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া পড়ে। গত তিন বছরে প্রকাশিত হয়েছে নির্বাচিত কবিতা ও শ্রেষ্ঠ কবিতা, ১০০০ কবিতা। প্রায় প্রতিদিনই লিখেছি, এখনো লিখছি দিনে দুটো থেকে পাঁচটি কবিতা। এ পর্যন্ত ১৮০০ কবিতা, ২০০ অনুকবিতা লিখেছি। বেঁচে থাকলে ২০২২ সালের বইমেলায় ১২০০ নতুন কবিতা নিয়ে বই বের হবে।

৩৩ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে অনেক খ্যাতিমান মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। শওকত ওসমান, জাহানারা ইমাম, আহমদ শরীফ, নীলিমা ইব্রাহিম, কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকী, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, আহমদ রফিক, রোকনুজ্জামান খান, রশীদ করীম, মূর্তজা বশীর, কামাল লোহানী, আনিসুজ্জামান, অন্নদাশঙ্কর রায়, সমরেশ মজুমদার, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা, আবুল হোসেন, আবু রুশদ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, বেলাল চৌধুরী, রাহাত খান, মমতাজউদদীন আহমদ, বশীর আল হেলাল, আবদুশ শাকুর, এম ওয়াজেদ মিয়া, সিদ্দিকুর রহমান, আবদুল মতিন খান, সৈয়দ শামসুল হক, আবুবকর সিদ্দিক, সন্তোষ গুপ্ত, বিনোদ দাশগুপ্ত, নূরজাহান বেগম, মনজুরে মওলা, হাসনাত আবদুল হাই, দেবু ভট্টাচার্য, আবুল হাসানাত, রিজিয়া রহমান, আহমদ ছফা, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, সেলিনা হোসেন, হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, আবুল হাসনাত (সম্পাদক কালি ও কলম), সৈয়দ হায়দার প্রমুখ। এদের মধ্যে বেঁচে আছেন কেবল আহমদ রফিক, আবুবকর সিদ্দিক, হাসনাত আবদুল হাই, আবদুল মতিন খান, সেলিনা হোসেন, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা। যে কোনো সময় পরপারের ডাক আসবে। চলে যেতে হবে। একরোখা জেদি ও নাক উঁচু স্বভাবের কারণে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারিনা। আমার উত্থানও (সাহিত্য সংস্কৃতি সামাজিক পেশাগত) অনেকেই সহ্য করতে পারেন না। আমি তলানিতে পড়ে থাকি, সবার করুণা ও সাহায্যপ্রার্থী হই এটা এক শ্রেণির মানুষ চায়। সে জন্য তারা নানা ক্ষেত্রে প্রতিরোধ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। আমি তো ফিনিক্স পাখি ভস্ম হই আবার জেগে উঠি। আমাকে দাবিয়ে দমিয়ে রাখা কঠিন। সৃষ্টিকর্তার বিশেষ সহবতে রয়েছি। সবই তার ইচ্ছা ও কৃপা।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে