বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২
পাঠক মত

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কৃষকদের নিয়ে আগে ভাবতে হবে

  ৩০ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কৃষকদের নিয়ে আগে ভাবতে হবে
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কৃষকদের নিয়ে আগে ভাবতে হবে

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের শতকরা ৮০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। দেশের অর্থনীতি সরাসরি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আমাদের জিডিপিতে শিল্প এবং অন্যান্য খাতের অবদান থাকলেও উলেস্নখযোগ্য অবদান হিসেবে কৃষিই তালিকার শীর্ষে রয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য খাতের কাঁচামাল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি থেকেই আসে? দেশের ক্রান্তিকালীন অন্যান্য খাত যেখানে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত সেখানে কৃষি খাত এককভাবে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখে চলেছে। গত প্রায় দুই বছর ধরে বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর তান্ডবে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও দারুণ ধাক্কার মধ্যে পড়েছে। দফায় দফায় লকডাউন, বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপ, বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় দেশের অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। দেশের সব কলকারখানা, অফিস-মার্কেট বন্ধ থাকলেও কৃষকরা ঘরে বসে থাকেনি? তারা সব ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে নিরলসভাবে উৎপাদন করে চলেছে। ৭১-এ মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করে সমৃদ্ধির পথ সুগম করে দিয়েছিল। সেই পথ ধরে বাংলাদেশের কৃষকশ্রেণি স্বাধীনতা-উত্তর বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে আজকের উন্নয়নশীল দেশের সারণিতে স্থান করে দিয়েছে। দেশের শাসকশ্রেণি, চাকরীজীবী, প্রকৌশলী ইত্যাদি সুশীল সমাজের উন্নতি ও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটলেও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় এ দেশের মূল চালিকাশক্তি, উৎপাদকশ্রেণির অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। দেশের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত কৃষকদের অবস্থা অনেকাংশে অপরিবর্তিত রয়েছে। শুধু তাই নয়- সমাজ বা রাষ্ট্রের যে কোনো নেতিবাচক প্রভাবটা আগে খেটে-খাওয়া এই কৃষকদের ওপরে এসে পড়ে। তারা বিনা বেতনে রাষ্ট্রের জন্য উৎপাদন করে আসল পাওনা থেকেও বঞ্চিত হয়? এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো দুর্নীতিগ্রস্ত বাজার সিন্ডিকেট। বাজারে একদিকে যেমন কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চড়া মূল্য, অন্যদিকে উৎপাদিত দ্রব্যের দাম তুলনামূলক অনেক কম হওয়ায় কৃষকরা দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই পণ্যই যখন অন্য কৃষক বাজারে কিনতে যাচ্ছে তখন তাকে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। এখানে স্পষ্টতই একটি চক্র বাজার অস্থিতিশীল করে নিজেদের ফায়দা লুটছে। বাংলাদেশে এটা নতুন নয়। এ দেশে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয় সে হিসেবে দেশে চালের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করার কথা। কিন্তু নিজেদের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করে থাকে। আর দেশের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্তের খাতায় থেকে যায়। এদিকে সরকার আশার বাণী শুনিয়ে যায়। কিন্তু কাজের কাজ শূন্য। চলতি মৌসুম শীতকালের উপাদেয় একটি সবজি হচ্ছে আলু। এ দেশের আবহাওয়া ও মাটি আলু চাষের জন্য উপযুক্ত। উৎপাদিত হয়। আলু আমাদের প্রধান খাদ্যের মধ্যে একটি। প্রতিদিন কোনো না কোনো সন্ধ্যায় ভাতের থালায় অন্যান্য তরকারির সঙ্গে আলু থাকেই? প্রতি বছর শীতকালে বিপুল পরিমাণ আলু উৎপাদন করা হয় যা সারা বছর দেশের চাহিদা মিটিয়ে থাকে। আলু পচনশীল সবজি হওয়ায় এটি হিমাগারে অতিনিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। এছাড়া অনেকে নিত্যপ্রয়োজন মেটাতে জমি থেকে তুলেই বাজারজাত করে? এবার নতুন আলু বাজারে আসতেই দাম যেন পাতাল ছুঁয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একই অবস্থা। এক কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয় আনুমানিক ১২ থেকে ১৪ টাকা। কিন্তু বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি করতে হচ্ছে ৬ থেকে ৮ টাকায়? এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে মোটামুটি ৩০ থেকে চলিস্নশ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতি বিঘায় গড়ে ৫০ থেকে ৬০ মণ আলু হয় এবং বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী হিসাব করলে দেখা যায় খরচের টাকাও উঠছে না। করোনার এমন দুর্দশার মধ্যে ফসলের এমন দামে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে তলিয়ে যাচ্ছে। এদিকে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। তেলের কথাই যদি বলি তাহলে দেখা যায় তেল ছাড়া কোনো তরকারিই রান্না করা সম্ভব নয়? এমনকি খালি আলু ভর্তা করতে গেলেও কয়েক ফোঁটা তেল লাগেই। আর বাজারে এক লিটার তেলের দাম ১৫০ থেকে শুরু করে ২০০-র কাছাকাছি। সেই হিসাবে এক লিটার তেল কিনতে হলে একজন কৃষককে প্রায় ২০ কেজি আলু বিক্রি করতে হচ্ছে। অন্যান্য সামগ্রী তো আছেই? তাহলে এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যাচ্ছে দেশে কৃষকদের পরিণতি কতটা ভয়াবহ। সরাসরি তরকারি ছাড়াও দেশে আলু থেকে বাণিজ্যিকভাবে চিপস, আলুর পাকোড়া, ফিঙ্গার চিপস, আলুর পরোটা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ইত্যাদি ফাস্টফুড তৈরি হচ্ছে। যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। খোদ আলুও বিদেশে রপ্তানি করে বাংলদেশ প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা লাভ করছে যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু যারা দিন-রাত পরিশ্রম করে উৎপাদন করছে দিনশেষে তাদের লাভের ঘরা শূন্য। দেশে একের পর এক মেগা প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। শহরাঞ্চল বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। অথচ এই অর্থনীতির মূল চালকরা কোনো মতে খেয়ে-পরে নিজেদের জীবনটা ধরে রেখেছে। তাই দেশের হর্তাকর্তাদের কাছে উদাত্ত আহ্বান, কৃষকদের দুরবস্থা অতিক্রম করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। উৎপাদন যন্ত্রকে অবহেলিত রেখে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি কোনোভাবেই সম্ভব না? এক্ষেত্রে নতুন নিয়ম করা যেতে পারে। প্রথমত বিদেশ থেকে আমদানি বন্ধ করতে হবে। এরপর যেসব কোম্পানি আলু থেকে খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে তারা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কিনবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি টিম থাকবে যারা পুরো বিষয়টা যেন সঠিকভাবে হয় সেদিকে তদারকি করবে। আলু জমি থেকে তোলার পর উৎপাদন খরচ হিসাব করে, লাভের একটা অংশ রেখে আলুর দাম ঠিক করতে হবে। বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি খাতকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার সচেষ্ট হলেও অনেকাংশেই তা যথেষ্ট নয়। কৃষিপণ্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন- সার, কীটনাশকের দাম নাগালের মধ্যে রাখতে হবে। জাতীয় বাজেটে অন্যান্য খাতের চেয়ে কৃষি খাতে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। আর এই বরাদ্দকৃত অর্থ যেন কৃষকদের কাজে লাগে সে বিষয়ে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। কারণ এ দেশে পরিকল্পনা যথাযথভাবে গ্রহণ করা হলেও শুধু দুর্নীতির জন্য তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না? কৃষক সমাজকে আলাদা রেখে দেশ কখনোই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে তারা শিল্প, প্রযুক্তির পাশাপাশি কৃষিকেও যথেষ্ট গুরুত্বের মধ্যে রেখেছে। তাই এ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে কৃষকদের নিয়ে আগে ভাবতে হবে।

শাকিবুল হাসান

শিক্ষার্থী

বরেন্দ্র কলেজ রাজশাহী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে