জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষ নিয়োজিত রয়েছেন নানা ধরনের পেশায়। তাই সমাজে বিভিন্ন সময় কিছু অভিনব পেশার লোক দেখা যায়। পেশার বৈচিত্র্যতার কারণে সমাজে রয়েছে নানা ধরনের মানুষ এবং তাদের ভিন্ন ভিন্ন আচরণ। অর্থ উপার্জনের নানা কৌশলের জন্য কখনো কখনো সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। মানুষের পেশাগত কারণ ও সামাজিক সংঘাত সৃষ্টি হয়। রাজনীতি এখন অর্থ উপার্জনের একটি উৎকৃষ্ট পন্থা। রাজনীতিতে জড়িত হয়ে অর্থ উপার্জন করতে কায়িক পরিশ্রমের তেমন একটা প্রয়োজন হয় না। রাজনীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করার কারণে সামাজিক সংঘাতের সৃষ্টি। রাজনীতির মাধ্যমে নেতাদের অর্থ উপার্জনের কারণে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনুশীলনটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের রাজনীতি করে জীবন-জীবিকা পরিচালনা করার কারণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা অনুশীলিত হয় না। বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৪৪টি। অনিবন্ধিত দলের সংখ্যাও অনেক। এত রাজনৈতিক দল থাকার পরও এ দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক ক্ষেত্র সৃষ্টি হচ্ছে না কেন? এর জন্য দায়ী কে, আমলা, জনগণ না রাজনৈতিক নেতারা এর কারণ উদঘাটন করাটা জরুরি। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে কতটা গণতন্ত্র অনুশীলিত হয় তা দেখার প্রয়োজন। দেশের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। দলীয় প্রধান এই তিন দলের মুখ্য নেতা। মুখ্য নেতার বাইরে অন্য নেতাদের জনগণের কাছে কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। তাই এই দলগুলোর রাজনৈতিক চর্চা বা অনুশীলন হয় শীর্ষ নেতাকে কেন্দ্র করে। তৃণমূলে এই তিন দলের যারা নেতৃত্ব দেন (জেলা, উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে) তারাও নিজেদের অনুগত্য মানুষ দিয়ে কমিটি তৈরি করেন থাকেন, যাতে তার নেতৃত্ব না হারাতে হয়। মাঠপর্যায়ে অনুগত বাহিনী তৈরি স্বেচ্চারিতা করার দায়ে অনেক সময়, এই প্রধান তিন দলের জেলা-উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের অনেক নেতাকে আবার নেতৃত্ব হারাতে হয়। তার কারণ হলো শীর্ষ নেতার দৃষ্টি তাদের স্বৈরাচারী আচরণ ধরা পড়লে তিনি তাদের বাদ দেন। যেহেতু দল তিনটি দলীয়প্রধান কেন্দ্রিক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের অবস্থা ছিল না পরাধীন অর্থাৎ ঔপনিবেশিক আমলে, তাই সাধারণ জনগণ রাজনৈতিক নেতাদের বিশ্বাস করতেন তাদের ডাকে সাড়া দিতেন। রাজনীতি এখন টাকা উপার্জনের একটি পথ। এই কারণে জনগণ রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে না। তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হচ্ছে। রাজনীতি অর্থ উপার্জনের বড় মাধ্যম এ কথা বললে কিছু মানুষ আঙুল উঁচিয়ে দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিকে। তারা মনে করেন এই দল তিনটি এরাই বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল। অনেকেই মনে করেন এই তিনটি দলের কারণে গণতান্ত্রিক রাজনীতি দেশে অনুশীলিত হচ্ছে না। এ কথাটা মোটেই সত্য না কারণ বাম দলগুলোর অভ্যন্তরেও কোনো গণতন্ত্র নেই। কথিত প্রগতিশীলদের এই কথাটি কতটা সঠিক তা যাচাই করা দরকার। দেশের কোনো বামপন্থি রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন স্তরে কাউন্সিল বা সম্মেলনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুশীলিত হয় না। বুর্জোয়া দল যাদের বলা হয়, এই দলগুলোর নেতারা নিজেদের পদ পদবি ব্যবহার করে অর্থ-উপার্জন করে। তাই তারা টিকে থাকার জন্য নিজেদের পছন্দসই মানুষকে রাজনৈতিক দলের সদস্য বানায়। দেশের কথিত মার্কসবাদী বামপন্থি দলগুলোর মধ্যে অনুরূপ বিষয়টি দেখা যায়। বামপন্থি দলগুলোর নেতারা ফুল টাইমার কর্মী হিসেবে কাজ করে থাকেন। ফুল টাইমার সংজ্ঞাটা যথাযথভাবে বোঝাও কষ্টকর। তবে যারা ফুল টাইমার হিসেবে কাজ করেন তারা মাসিকভাতা পান। বামপন্থিদের দলগুলোর ফুল টাইমার নেতারা নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য অনুগত মানে এমন লোকজনকে সদস্য বানায়, এই সদস্য দলগুলোর গণতন্ত্র বা রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে জানেও না। ফুল টাইমাররা নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য যাদের সদস্য পদ প্রদান করেন তাদের মার্কসবাদী রাজনীতি করার কতটা যোগ্যতা আছে তা যাচাই করা হয় না। বর্তমানে অনেক বামপন্থি দল নিজেদের নেতৃত্ব পদ-পদবি ও মাসিক দল থেকে প্রাপ্ত সম্মানিটা পাওয়ার জন্য এমন জঘন্য কাজ করে থাকেন যা এ দেশের প্রতিক্রিয়াশীল বা বুর্জোয়া দলগুলোর নেতারাও করে না। দেশের বামপন্থি দলগুলোর শৃঙ্খলা নিয়ম-নীতি কঠোরভাবে পালন না করলে সদস্যপদ থাকে না। তবে নেতার তল্পিবাহকদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয় না। সম্প্রতি দেশজুড়ে একটি বামপন্থি দলের জেলা এবং উপজেলাপর্যায়ে কাউন্সিল সমাপ্ত হওয়ার পথে। এই দলটি গঠনতন্ত্রের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্য রেখে কাউন্সিলর নির্বাচিত করছে, তা দেখার বিষয়। এখানে একটি জেলার কথা বিশেষ করে বলা যায়, এই জেলায় একজন নারীকে নগর কমিটির প্রধান করা হয়েছে, যিনি আপাদমস্তক মৌলবাদ অনুশীলন করেন। তিনি আবার একটি বিপস্নবী সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এই জেলাই দেখা যায়, একজন দশ বছর ধরে লেভি দিচ্ছেন না। পার্টির মুখপত্রের বিল বকেয়া রেখেছেন বারো বছর ধরে। পার্টির শৃঙ্খলাবোধ মানে না তারপরও তিনি তার সদস্য পদ হারান না। কারণ তিনি এই জেলার যিনি প্রধান তার বাধ্যগত। জেলার প্রধান পার্টির তহবিল তছরুপ, অন্যের টাকা মেরে দেওয়াসহ নানা অপকর্ম করে আসছেন। যারা এই নেতার অপকর্মের বিরোধিতা করেন তাদের পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। বামপন্থি দলগুলোর কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশন আছে। কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনে এই নেতার বিষয়গুলো জানানোর পর কোনো প্রতিকার পায়নি ভুক্তভোগীরা। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে এ রকম বামদলে চরম স্বৈরাচারী কাজকর্ম চলে। বামেরা নিজেদের সবসময় তুলসী ধোয়া হিসেবে জাহির করেন। সাধারণ মানুষ কিন্তু তা মানে না। এই কারণে দেখা যায়, শতবর্ষ বয়সি বামদল থেকে একজন ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে পারেন না। বুর্জোয়া দলগুলোতে ব্যবসায়ীরা ও সুবিধাভোগীরা নিয়ন্ত্রণ করে, ঠিক অনুরূপভাবে বামদলগুলোও লুম্পেন গোষ্ঠীর হাতে নিয়ন্ত্রিত। সার্বিক পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, দেশের কোনো রাজনৈতিক দলেই গণতন্ত্র নেই। তাই এরকম রাজনৈতিক দলগুলো দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলের বিষয়টি সাধারণ জনগণ তা স্পষ্টভাবে বুঝে গেছে ফলে দেশের সাধারণ মানুষ এখন আর রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে না। দেশের বড় বড় জনসভা হয় ভাড়া করা লোক দিয়ে। রাজনীতি করে যারা আর্থিক সুবিধা ভোগ করে তারাই বামদল করছে। এদের আয় বড় দলের নেতাদের চেয়ে কম। কারণ এদের রাজনৈতিক যোগ্যতাও কম। তাই তারা আর ভাড়া করে লোক আনতে পারে না, যার কারণে বামদের সমাবেশে হাতেগোনা লোকজন উপস্থিত থাকে।
ডান-বাম-দক্ষিণ বা মৌলবাদী যে কোনো আদর্শিক রাজনৈতিক দলের ভিতরকার চিত্রটা এরশাদ, জিয়া, ইয়াহিয়া, আয়ুবের স্বৈরাচারী আমলকে হার মানায়। এই কারণেই স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে দেশের গণতন্ত্রের এই বেহাল অবস্থা।
গণতন্ত্রের বিকাশের পথে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোই বড় বাধা। এর জন্যই দেশের বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনিক কাঠামোতে আমলাতন্ত্র জেঁকে বসেছে।
সুতরাং দেশের বাম-ডান সব রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে গণতন্ত্রচর্চা না হলে বর্তমানে প্রশাসনে জেঁকে বসা আমলাতন্ত্র থেকে দেশ রক্ষা পাবে না আর রাজনৈতিক অঙ্গনেও গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে না।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক