বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ করতে হবে

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করাটা হলো সমষ্টিক মানুষের অনুভূতিতে আঘাত। আর নানা সময় দেখা যায়, দুর্বল ব্যক্তিকে তার বা বাপ তুলে সবলরা গালাগাল করেন, এটা হলো ব্যক্তির অনুভূতির ওপর আঘাত। সামষ্টিক আঘাত হজম করাটা অনেক সময় সহজ আর যখন দুর্বল ব্যক্তিটির মাকে তুলে গাল দেওয়া হয় তখন তার পক্ষে এটা হজম করাটা সহজ হয় না, তখন গালাগাল শোনা ব্যক্তিটি মানসিক পীড়নে ভোগেন।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ২৮ জুলাই ২০২২, ০০:০০
সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ করতে হবে

বাংলাদেশে সারা বছরেই দেখা যায়, সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধের দাবিতে মিছিল সমাবেশ ও মানববন্ধনসহ নানা প্রতিবাদী আয়োজন। সংখ্যালঘু শব্দটির অর্থ হলো সংখ্যায় কম যে সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করা সংখ্যাটি, এটা গণিতের হিসাব থেকে এসেছে। বাংলাদেশের সংবিধানানুসারে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা আছে। মূলত দেশটি স্বাধীন হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। তাই এই ভূখন্ডে বসবাসরত সবাই বাংলাদেশের নাগরিক; তারা রাষ্ট্রের সমান অধিকার ভোগ করবেন। সুতরাং, এখানে কোন মানুষ কি ধর্ম পালন করল তার অনুপাতিক হারের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু নিরূপণ করাটা যুক্তিযুক্ত নয়। এভাবে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু নির্ণয় করার পদ্ধতিটি দেশের নাগরিককে শ্রেণিগতভাবে ভাগ করে ফেলে। এতে সংখ্যাগুরু হিসেবে যারা বিবেচিত হয় তারা নিজেদের উচ্চ মার্গের মানুষ মনে করে। আর এর ফলে বৈষম্যটাই বাড়ে। বাংলাদেশের কথিত বুদ্ধিজীবী, সুশীলসহ দেশের শাসনযন্ত্র নিয়ন্ত্রণকারীরা ধর্মপালন মানুষের সংখ্যার নিরিখে সংখ্যালঘু হিসেবে আখ্যায়িত করে। আর যখন কম সংখ্যার ধর্ম পালনকারী মানুষ নির্যাতিত হয় তখন বলা হয় সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে। কেউ বলে না মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ম আগে না মানুষ আগে? বাংলাদেশে বসবাসরত মানুষ কী জাতি হিসেবে পরিচিত? সে যে ধর্ম পালন করে সেই ধর্মীয় জাতি না জাতিতে তারা বাংলাদেশি। যদি প্রতিটি নাগরিকের জাতীয়তা বাংলাদেশি হয় তাহলে কেন ধর্মপালনের অনুপাতে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। এটাও তো এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টির প্রয়াস। কারণ সংখ্যালঘু আখ্যা দিয়েই দেশের কিছু মানুষকে মানসিকভাবে ছোট করে ফেলা হয়। সংখ্যালঘু তকমা পাওয়া পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুটি বেড়ে ওঠে এক ধরনের হীনম্মন্যতা নিয়ে। বাংলার জাতীয় কবি কাজী নজরুলের একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে যায়। কবি নজরুল বলেছিলেন, 'ওরা কারা কোরআন, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি, ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে, যাহারা আনিল গ্রন্থ- কেতাব সেই মানুষেরে মেরে, পুজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল!- মুখরা সব শোন মানুষ এনেছে গ্রন্থ : গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোখনো'। আজ থেকে বহু বছর আগে ব্রিটিশ শাসনামলে জাতীয় কবি এই উক্তিটি করেছিলেন। বর্তমানে সেই মানুষকে মারা হচ্ছে ধর্মীয় অনুপাতে সংখ্যালঘু বানিয়ে। সম্প্রতি নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলায় ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে হিন্দু ধর্মপালনকারী মানুষের ওপর হামলা চালানো হয়। ওই এলকায় যারা হিন্দু ধর্ম পালন করে তাদের বসতবাড়ি ভাঙচোর করা হয়। হিন্দু ধর্মপালনকারী নারী-পুরুষকে শারীরিক নির্যাতন করে হামলাকারীরা। হামলাকারী ব্যাপক লুটতরাজ করে বলে জানা গেছে। তাছাড়া, হামলাকারীরা সাহাপাড়ায় দুটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং মন্দির ভেঙে দেয়। ওই ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং নেতারা আশ্বাস দেন- তারা সংখালঘুদের সঙ্গে আছেন। সারাদেশে বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ আর্দশিক সংগঠনগুলো এর প্রতিবাদ জানায়। তবে প্রতিবাদ জানানোর সময় ওই সংগঠনগুলো হিন্দু ধর্ম পালনকারীদের সংখ্যালঘু হিসেবে আখ্যায়িত করে। বিষয়টি কি দাঁড়ালো, সবাই সংখ্যালঘু শব্দটি ব্যবহার করলেন জাতীয়তা বাঙলাদেশি শব্দটির পরির্বতে, এর ফলে ধর্মকেই প্রধান্য দিল সবাই। কারণ দেশের সাধারণ মানুষকে ধর্মের বিভাজনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু বানানো হয়েছে আর ধর্ম নিরপেক্ষরাও নানা কৌশলে সেই বৃষবৃক্ষটিকে জল দিয়ে লালনপালন করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রের কাছে কোনটি বড় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ না ধর্ম পালনানুসারে জাতীয়তা। ১৯৭৫ সালের পটপরির্বতনের পর থেকে ধর্মকে জাতীয়তা নির্ণয়ের মাপকাঠিতে পরিণত করে সেনা শাসকরা। এর ফলে বাঙালি সংস্কৃতির ধারাটির ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে, আর এই হ্রাস পেতে পেতে আজকের দিনে এসে ধর্ম হয়ে গেল বাঙালি জাতির পরিচয়ের মূল সূচক। এর ফলে বাড়ছে সহিংসতা ও সামাজিক অস্থিরতা। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থাৎ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সরকারি কর্মকান্ডে ধর্মের ব্যবহারটা কমাতে হবে, নইলে সংখ্যালঘু বলে ওদের জন্য যতই করুণা দেখানো হোক না কেন, নির্যাতন বন্ধ হবে না। আসলে রাষ্ট্রকেই হতে হবে ধর্ম নিরপেক্ষ, তাহলে নাগরিকরা ধর্মনিরপেক্ষতার নিয়মকানুন পালন করবে। নড়াইলে এ ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে একজন ছাত্রের পোস্টকে কেন্দ্র করে কলেজ অধ্যক্ষ স্বপন বিশ্বাসকে জুতার মালা পরিয়ে ঘোরানো হয়। আর এই ঘটনাটি ঘটেছে পুলিশের সামনে। অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, জনৈক শিক্ষার্থী ধর্ম অবমাননাকর ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিল, তিনি সেই পোস্টটি নাকি সমর্থন করেছেন, এই অপরাধে তাকে অভিযুক্ত করে জুতার মালা পরানো হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারণ করা উচিত। স্বপন বিশ্বাসকে যখন জুতার মালা পরিয়ে ঘুরানো হয় তখন তার অনুভূতির অবস্থাটা কি ছিল? তার সেই অনুভূতিকে কেউ কি পরিমাপ করেছেন। স্বপন বিশ্বাস কোন পোস্টকে সমর্থন দিলেন সেই অপরাধে তার আইনি বিচার হতে পারে। কিন্তু ব্যক্তি স্বপন কুমারকে এভাবে অপদস্ত যারা করল তারা তো রাষ্ট্রীয় আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন- তাদের কি ধরনের বিচার হওয়া দরকার। কারণ তারা দুটো অপরাধ করল- এক, তারা স্বপন বিশ্বাসের অনুভূতিতে আঘাত করল, দুই, তারা রাষ্ট্রীয় আইনকে অবমাননা করল। নূপুর শর্মা নামে ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদী নেত্রী নবীজীকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। নূপুর শর্মাকে কেন্দ্র করে এ দেশের ইসলাম ধর্মপালনকারী মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিক্ষুব্ধ জনতা এ দেশের হিন্দু ধর্ম পালনকারী বাঙালিদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। তবে নূপুর শর্মা কি বলেছেন, তা অনেকেই জানেই না। কিছুদিন আগে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দাউল ব্যারাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আমোদিনী পালকে সাম্প্রদায়িক বির্তকে জড়ানো হয়। তিনি স্কুল ইউনিফর্ম পরে আসার জন্য শিক্ষার্থীদের বলেছিলেন, তার এই কথাকে বানানো হয়, তিনি নাকি হিজাব পড়তে নিষেধ করেছেন। আর এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক বির্তকের ঝড় ওঠে। মূল বিষয়টি কি, তা যাচাই না করে, অনেকেই তা ধর্মীয় মোড়কে আচ্ছাদন করে সাম্প্রদায়িকতার তান্ডবের দিকে রূপ দেয়। ধর্মীয় অনুভূতির নামে ভারত এবং বাংলাদেশে চলছে এক ধরনের ব্যবসা। দুটি দেশের রাজনীতিতে এখন বড় তুরুপের কার্ড হলো ধর্ম। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ধর্মকে সুনিপুণভাবে ব্যবহার করা হয় দুই দেশে। তাই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের নামে দুই দেশেই কথিত সংখ্যলঘু সাধারণ মানুষ হচ্ছে নানা ধরনের নিপীড়নের শিকার। ধর্মটা হলো মানুষের বিমূর্ত বিশ্বাস। বংশপরম্পরায় মানুষ ধর্মকে লালন করে আসছে। তাই ধর্ম সম্পর্কে কোনো কথা বললে সেই ধর্ম পালনকারীদের অনুভূতিতে আঘাত লাগাটা স্বাভাবিক। আর অন্য কোনো ব্যক্তির অপরাধের জন্য ওই ব্যক্তির যে ধর্মের সেই ধর্মপালনকারীদের ওপর যদি শারীরিকভাবে আঘাত করা হয়, তখন তাদের অনুভূতিতে কত বড় চোট লাগে, এই বিষয়টি মৌলবাদী ধার্মিকরা কি কখনো উপলব্ধি করেছেন।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করাটা হলো সমষ্টিক মানুষের অনুভূতিতে আঘাত। আর নানা সময় দেখা যায়, দুর্বল ব্যক্তিকে তার বা বাপ তুলে সবলরা গালাগাল করেন, এটা হলো ব্যক্তির অনুভূতির ওপর আঘাত। সামষ্টিক আঘাত হজম করাটা অনেক সময় সহজ আর যখন দুর্বল ব্যক্তিটির মাকে তুলে গাল দেওয়া হয় তখন তার পক্ষে এটা হজম করাটা সহজ হয় না, তখন গালাগাল শোনা ব্যক্তিটি মানসিক পীড়নে ভোগেন।

উলিস্নখিত বিষয়গুলো রাষ্ট্রের বিবেচনায় নেয়া দরকার।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে