রোববার, ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা :প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিন

আমরা কোনোমতেই এমন অনিরাপদ সড়ক চাই না। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সড়কে নজরদারি জোরদার করতে হবে। অনিয়ম কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। দুর্ঘটনা নামের হত্যাকান্ড রোধে সরকার দ্রম্নত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
দয়াল কুমার বড়ুয়া
  ১৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা :প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিন

সড়ক দুর্ঘটনা কোনোভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। ৯টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টেলিভিশনে প্রচারিত খবরের ভিত্তিতে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, দেশে ২০২২ সালে ৬ হাজার ৮২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৭১৩ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১২ হাজার ৬১৫ জন। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হয়েছে মোটর সাইকেলে। ২ হাজার ৯৭৩ দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৯১ জন নিহত হয়, যা মোট নিহতের ৪০.০৭ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান বলছে, গত চার বছরের মধ্যে ২০২২ সালে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মাত্রা সর্বোচ্চ।

সড়ক দুর্ঘটনা কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। বরং প্রতি বছর দুর্ঘটনার হার ও সংখ্যা বাড়ছে। একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ০.৮৯ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ৪.২২ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ৩.৮৮ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩.৪৩ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ১৫.৭০ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ১.২০ শতাংশ। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ২৭.১৪ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ২২.৭৪ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ৬৮.৯২ শতাংশ।

গত এক বছরের সড়ক দুর্ঘটনার খবর বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সড়কে দুর্ঘটনায় যানবাহনের সংখ্যার বিচারেও মোটর সাইকেল রয়েছে শীর্ষে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সড়কে দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যানবাহন হিসাব করলে এর মধ্যে গড়ে ২৬ শতাংশের ওপরে ছিল মোটর সাইকেল। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গত জানুয়ারি ও ফেব্রম্নয়ারি মাসে ৮৪৮টি সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসব দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৩৯.৮২ শতাংশ মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। জুন মাসে দেশে ৪৬৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫২৪ জনের মৃতু্য হয়েছে, আহত হয়েছে ৮২১ জন। এর মধ্যে ১৯৭টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় ২০৪ জনের মৃতু্য হয়েছে। এই হিসাবে মোট দুর্ঘটনার ৪২.১৮ শতাংশ মোটর সাইকেলের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়া ও বর্তমানে তা মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠার পেছনে আছে নীতিগত দুর্বলতা। সরকার এখন মোটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পন্থার কথা বললেও এটি সহজে সম্ভব নয়।

সরকার মোটর সাইকেলকে সহজলভ্য করেছে। কিন্তু মোটরসাইকেল চলার উপযুক্ত সড়ক করেনি, আলাদা লেন করেনি। মোটরসাইকেল এখন যাতায়াত ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হয়েছে ও জীবিকার পথ তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দক্ষ চালক ও মোটর সাইকেলের চলাচল উপযোগী সড়ক আগে করতে হবে।

প্রশ্ন হলো-প্রতিদিন যদি আমাদের এমন দুঃসংবাদের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে নিরাপদ সড়কের দাবিতে এত আন্দোলন, এত সুপারিশ-পরামর্শ ও নতুন প্রবর্তিত আইন কী কাজে লাগছে? বস্তুত জনবহুল এই দেশে যান চলাচলে শৃঙ্খলার অভাব এবং সড়ক ও পরিবহণ ব্যবস্থা যথেষ্ট উপযুক্ত না হওয়ার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। মূলত অশিক্ষিত চালক, ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, রাস্তা নির্মাণে ত্রম্নটি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং আইন প্রয়োগের দুর্বলতা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশে ৮৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ চালক কর্তৃক বেপরোয়া গতিতে যান চালানো।

সড়কে দুর্ঘটনা হ্রাসে ইতিপূর্বে পেশাদার চালকদের লাইসেন্স পেতে ও নবায়নের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা ছাড়াও তাদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১১১টি সুপারিশ করা হলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে পুলিশ কর্তৃক চার্জশিট দাখিল এবং দ্রম্নত ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির পথ সুগম করা হলে তা দুর্ঘটনা হ্রাসে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যেভাবেই হোক, সড়ক-মহসড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সচেতন হতে হবে পথচারীদেরও। একই সঙ্গে আইনের যথাযথ প্রয়োগ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চালক এবং সড়কে চলাচল উপযোগী ভালো মানের যানবাহন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পাশাপাশি পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত বলে মনে করি আমরা।

আমাদের দেশে কী কী কারণে এত বেশি সড়ক দুঘটনা ঘটে, কী কী পদক্ষেপ নিতে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভব- এসবও বহুল আলোচিত বিষয়। অনেক গবেষণা হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আছে। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণা অনুযায়ী, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ।

ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহন, ভুয়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো বন্ধ করা হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেই। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সমস্যা, জরুরি ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনাহীনতাও দুর্ঘটনা বাড়ার পেছনে দায়ী।

সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসের লক্ষ্যে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের শাস্তি নিশ্চিত করা প্রথম কাজ। ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স, হেলপারদের গাড়ি চালানো, ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল- এসব বন্ধ করতে হবে। শুধু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালককেই যেন লাইসেন্স দেওয়া হয়, সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিআরটিএর অসাধু কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। সরকারকে এটা উপলব্ধি করতে হবে যে এটা একটা গুরুতর জাতীয় সমস্যা। সরকারের পাশাপাশি পরিবহণ মালিক, শ্রমিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সচেষ্ট হতে হবে, যাত্রী সাধারণের সচেতনতাও বাড়াতে হবে।

আমরা কোনোমতেই এমন অনিরাপদ সড়ক চাই না। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। সড়কে নজরদারি জোরদার করতে হবে। অনিয়ম কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। দুর্ঘটনা নামের হত্যাকান্ড রোধে সরকার দ্রম্নত কার্যকর পদক্ষেপ নেবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ, কো-চেয়ারম্যান জাতীয়পার্টি

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে