সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো কতটা অপরিহার্য?

বস্তুতপক্ষে, গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দলপ্রথার অস্তিত্ব ব্যতীত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যায় না। আর গণতান্ত্রিক শাসন বলতে বর্তমানে দলীয় শাসনকেই বোঝায়। গণতন্ত্রে দলব্যবস্থার অপরিহার্যতা দলব্যবস্থার গুণাবলির মধ্যেই নিহিত। বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দলপ্রথার গুরুত্ব উপলব্ধি এবং প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করেছে। বর্তমানে গণতন্ত্র ও দলপ্রথা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। দলপ্রথাকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের কথা ভাবা যায় না। আধুনিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলই প্রাণসঞ্চার করে।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ধাপে ধাপে গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা বিকশিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই বাংলাদেশ এক ধরনের নামমাত্র গণতন্ত্রের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করে তা হলো কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র। ব্রিটিশ শাসনামলে সীমিত আকারে গণতান্ত্রিক অধিকারবোধের জ্ঞান পরবর্তী সময়ে জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছিল। এ গণতান্ত্রিক চেতনা ভারতবর্ষে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে প্ররোচিত করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। গণতন্ত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিকগুলো সংজ্ঞাগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে গণতন্ত্রের এ মাত্রাগুলো সব সময় গণতন্ত্র চর্চায় ফোকাস করে না। যদিও গণতন্ত্রকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তথাপি গণতন্ত্রের মূল বিষয়টি হলো জনগণের দ্বারা শাসন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রচর্চা সমস্যার সম্মুখীন হয়। কেননা, তৎকালীন পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রায় অনুপস্থিত ছিল। ফলশ্রম্নতিতে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ পাকিস্তানি শাসকদের ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়ারই ফলাফল।

স্বাধীনতার পর থেকে মূলত তিনটি রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি দেশ শাসন করে আসছে। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সময় প্রায় ২৩ বছর দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ। দলটি বর্তমানেও ক্ষমতায় রয়েছে। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিএনপি চার মেয়াদে ১৪ বছরের বেশি সময় দেশ শাসন করেছে। তবে জিয়াউর রহমান দলটি প্রতিষ্ঠার আগে সামরিক পোশাকে প্রায় দু'বছর দেশ শাসন করেছেন। ১৯৮৬ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় পার্টি দেশ শাসন করেছে পাঁচ বছর। তবে এইচএম এরশাদ দলটি প্রতিষ্ঠার আগে সামরিক পোশাকে চার বছর দেশ শাসন করেছেন। দেশ শাসনকারী এ তিনটি রাজনৈতিক দলের কোনোটিই দেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে আন্তরিক হয়নি। একটানা দীর্ঘ ১৪ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি যখন বলেন, 'গণতন্ত্র একটি বিকাশমান প্রক্রিয়া, এটি কোনো ম্যাজিক্যাল ট্রান্সফরমেশন নয় যে, রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যাবে', তখন জনমনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- এ প্রক্রিয়া সম্পন্নে তথা গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে আর কত সময় প্রয়োজন? গত ১৪ বছরে ক্ষমতাসীন দলটির কার্যক্রম গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে কতটা সহায়ক ছিল?

নব্বইপরবর্তী সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল জনগণকে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসা। সেজন্য তাদের দলীয় নীতি ও কর্মসূচিতে উন্নয়নমুখী অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদির গণতন্ত্রায়ণ, জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিতকরণ বহির্বিশ্বের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে গৃহীত হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা ফ্যাক্টর প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি নির্ধারণের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র হচ্ছে রাজনৈতিক দল। দলগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া, ক্ষমতা চর্চা, ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রিয়াশীল থাকে। গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে জনগণের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হয়।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে মুক্ত, ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে এবং আমাদের সংবিধানেও এর ওপর প্রচুর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাস্তবতা এর থেকে যোজন যোজন দূর। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান লক্ষ্য বর্তমানে গণতন্ত্রের ধারণাকে পুঁজি করে ক্ষমতায় টিকে থাকা অথবা ক্ষমতা লাভ করা। গত কয়েক দশক ধরে জনগণের ভালোমন্দের বিষয়গুলো ও নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণের বিষয়টি তারা প্রায় ভুলেই গিয়েছে। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলো আরো অনেক কাজ করে থাকে। যেমন, সংসদীয় সরকারকে সচল রাখা, সরকারতন্ত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করা, গণনীতি নির্ধারণ করা, জনমত প্রচার করা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং নেতৃত্ব সংগ্রহে সহায়তা করা ইত্যাদি। এ সব কাজ করার জন্য প্রথমে একটি শক্ত দুর্নীতিমুক্ত এবং অদম্য রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোকে মনোনয়ন প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্তভাবে পরিচালনা করতে হবে। দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজে জড়িত থাকা ব্যক্তি যাদের যথাযথ শিক্ষা রয়েছে ও কোনো দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ নেই, শুধু সেই প্রার্থী হতে পারবে। রাজনৈতিক দলগুলোর বাংলাদেশের নাগরিকদের উন্নততর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে যে দায়িত্ব, সেটা অনুধাবন করা উচিত। আর এর জন্য প্রার্থীর পেশিশক্তি ও টাকাকে বিবেচনা না করে শুধু যোগ্য নেতাদেরই সামনের কাতারে নিয়ে আসা আবশ্যক।

বাংলাদেশের রাজনীতি প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব ভয়াবহ। প্রাথমিকভাবে তাদের মধ্যকার দূরত্ব গড়ে উঠেছে নেতৃত্বের প্রশ্ন ঘিরে। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো কার্যকলাপ বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার অব্যাহত বিরোধ ও মতানৈক্য ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক পরিবেশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। রাজনৈতিক দলে যদি গণতন্ত্রের চর্চা না থাকে তাহলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে প্রতিটি রাজনৈতিক নেতা কিংবা দল, জনপ্রিয় কিংবা অজনপ্রিয়, বৃহৎ কিংবা ক্ষুদ্র, ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতার বাইরের দল গণতন্ত্র সম্পর্কে অনবরত বক্তৃতা দেন। বাস্তবে গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণের জন্য ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দলগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ উৎসাহিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের গুরুত্বের বিষয়টি অনুধাবন করে। কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে, দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার ঘাটতি দেখা যায়। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে জন্য রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পরিচালিত কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে টিকে থাকে। রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী রাজনৈতিক এলিটদের বৃহৎ জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাংবিধানিক উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে ও বিভিন্নভাবে কার্যসম্পাদন ক্ষমতার চর্চা করে নিজেকে বিকশিত করে থাকে- যা তাকে অন্যান্য সংগঠন থেকে আলাদা করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তি/মানুষের ভূমিকা, নেতৃত্বের ভূমিকা আর্থসামাজিক পূর্বশর্তের চেয়ে কম নয়। একই সঙ্গে জনগণ ও ব্যক্তিকে সংগঠিত করে যে রাজনৈতিক দল তার ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রে অনেক সময় এলিট শ্রেণি ও জনগণের মধ্যে এক ধরনের ঠান্ডা লড়াই দেখা যায়- যাকে টাগ অব ওয়ার বলা যায়।

আধুনিক গণতন্ত্রে রাজনীতিক দল অপরিহার্য : প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থায় জনসাধারণ সরাসরি শাসনকার্য পরিচালনা করে না। জনগণ তাদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে প্রতিনিধি নির্বাচন করে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই শাসনকার্য পরিচালনা করে। তাই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচন অত্যাবশ্যক। আর নির্বাচন বর্তমান কালের দলপ্রথার ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনীতিক দলগুলো নির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে তাদের মনোনীত প্রার্থীদের অনুকূলে জনসমর্থন লাভের জন্য প্রচারকার্য পরিচালনা করেন। যে দলের প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন, সেই দলই সরকার গঠন করে। অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলতে বর্তমানে দলগত শাসনকেই বোঝায়। সেই জন্য আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য।

শুধু জাতীয় রাজনীতিতেই নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও গণতন্ত্র থাকা প্রয়োজন। দলগুলোকে তাদের কর্মীদের চিন্তাভাবনাকে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে এমন সুযোগ তৈরি করতে হবে- যেন মাঠ পর্যায় থেকেও ভালো নেতা উপরে উঠে আসতে পারে। আমাদের দেশে বেশির ভাগ দলই তাদের গঠনে একটি স্বৈরাচারী ধারা অনুসরণ করে। যার ফলে মাঠপর্যায় থেকে উপরে উঠে আসার সুযোগ খুব কম থাকে। কিন্তু এ দলগুলোর সংবিধান ও গঠনতন্ত্র এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন দলের ভেতরেও গণতান্ত্রিক চর্চা গড়ে উঠে। গণতান্ত্রিক পন্থায় নেতৃত্ব নির্বাচন করার জন্য এই দলগুলোর মুক্ত, ন্যায্য এবং গ্রহণযোগ্য কাউন্সিল নিয়মিত হওয়া আবশ্যক। সব রাজনৈতিক দলের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণ। যদি তারা নির্বাচনে জনগণের সমর্থন চায়, তবে তাদের জনগণের প্রতিটি সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হবে। যদি তারা জনগণের স্বার্থরক্ষায় কাজ না করে তবে জনগণ তাদের শুধু সরকারের ক্ষমতায় আনার জন্য ভোট দেবে না। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তের গণতান্ত্রিক সমালোচনা করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। শুধু যদি তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে তাহলে বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। তাই, আমরা জনগণ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলো যেন তাদের দায়িত্বগুলো অনুধাবন করে এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে জনগণের কল্যাণে কাজ করে সেটাই আশা করি। টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই বাংলাদেশ স্বপ্নের সোনার বাংলা হয়ে উঠবে এটাই আমাদের বিশ্বাস।

জনকল্যাণ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন বিবেচনায় গণতন্ত্রে যেমন সফলতা আছে তেমনি অনেক ক্ষেত্রে বৈরিতা বা তার বিপরীত চিত্রও পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। তবে গণতন্ত্রের ভালো দিকগুলো গ্রহণ করে রাষ্ট্র পরিচালনায় যদি সেগুলোকে কার্যকর ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে গণতন্ত্র সফল হবে। তবে সেটাকে অনেকেই গণতন্ত্রের পুঁথিগত সফলতা বলে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করবেন বা আত্মতৃপ্তি লাভে প্রবৃত্ত হবেন। কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রভাব থেকেই এ ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই গণতন্ত্রের শাসন ব্যবস্থার উপস্থিতি না থাকলে তাদের শাসন ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বা রীতিনীতিগুলোকে আপদমস্তক অনুসরণ করা হয়ে থাকে। আর আমাদের দেশে সরকার ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে অনেক ক্ষেত্রেই গলাটুটে মারতে লক্ষ্য করা যায়। যে বিএনপি নিজেদের গণতান্ত্রিক প্রতিভূ বা প্রতিনিধি বলে সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জন করে কয়েক দফায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল সে দলই ক্ষমতার দম্ভে লুটপাট, দুর্নীতি, রাহাজানি, গুম, খুন, হাওয়া ভবন ইত্যাকার নানা প্রকার জনস্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ডে জনগণের আস্থার জায়গাটিকে নষ্ট করে দিয়েছে। একই অবস্থায় আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও। কাগজের উন্নয়নের যে বড় উন্নয়ন নয়, সেটা সব রাজনৈতিক দলের প্রতিভূই জানেন। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আমাদের জানামতে মাত্র দুশ' লোক জিডিপি'র দুই তৃতীয়াংশ মালিকবনে আছেন। আর এক তৃতীয়াংশ জিডিপির মালিক হচ্ছে বাকি শত সহস্র কোটি জনগণ। একটি সরকার যখন বারবার অনিয়ম ও অনৈতিকতার আশ্রয় নিয়ে গণতন্ত্রকে জিম্মি করে ফ্যাসিস কায়দায় ক্ষমতাকে আড়তে ধরে রাখতে চায় তারা কখনই জনগণের হিতৈষী নয়- রাষ্ট্র কোনোভাবে তাদের কাছে নিরাপদ নয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কি উপায় আছে- তা আমার জানা নেই। এর উপায় তাদের হাতেই। যথাসময়ে তারা আসল কাজটি করতে পারেন। তারা যখন মনে করবেন শোষণের হাতিয়ার দুর্বল হয়ে পড়েছে, তখনই তাদের সুবুদ্ধি ও সুচিন্তার উদয় হবে এবং গণতান্ত্রিক নীতি ও পদ্ধতি বুলি আউড়িয়ে জনগণের কাছে সাধুশান্ত ভাব ধরবেন। তারা পূর্বেই তাদের কর্তৃত্ববাদী আচরণ দিয়ে জনগণের ওপর জগদ্দল পাথর চাপিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা আর জুলুমের নিষ্ঠুরতায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে সুশাসন ও ন্যায়ের শাসনকে আঁড়াল করে শ্রেণি স্বার্থের বীজবপন করেছিলেন। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য তখন কুমিরের কান্না শুরু করে দেন। এ অবস্থা থেকে জাতি পরিত্রাণ চায়।

বস্তুতপক্ষে, গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দলপ্রথার অস্তিত্ব ব্যতীত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যায় না। আর গণতান্ত্রিক শাসন বলতে বর্তমানে দলীয় শাসনকেই বোঝায়। গণতন্ত্রে দলব্যবস্থার অপরিহার্যতা দলব্যবস্থার গুণাবলির মধ্যেই নিহিত। বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দলপ্রথার গুরুত্ব উপলব্ধি এবং প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করেছে। বর্তমানে গণতন্ত্র ও দলপ্রথা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। দলপ্রথাকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের কথা ভাবা যায় না। আধুনিক গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলই প্রাণসঞ্চার করে।

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি, কলামিস্ট ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে