বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ডেঙ্গুজ্বর নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে

নতুনধারা
  ২৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

সাম্প্রতিক সময়ে যে রোগটি জাতীয় জীবনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে সেটি হলো ডেঙ্গুজ্বর। ডেঙ্গু নামক ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে ক্লাসিক্যাল বা হেমোরেজিক ধরনের তীব্র জ্বরকেই ডেঙ্গুজ্বর বলে। এটি রোগীর জন্য তীব্র কষ্টদায়ক এমনকি প্রাণঘাতীও হতে পারে। ২০০০ সালে এ জ্বরটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে মহামারি আকার ধারণ করে। এডিস নামক এক প্রকার মশা ডেঙ্গুভাইরাসের বাহক। ডেঙ্গুজ্বর (উবহমঁব) প্রধানত এশিয়ার গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকার একটি ভাইরাসঘটিত সংক্রামক ব্যাধি। ডেঙ্গুভাইরাস ঋষধারারৎরফধব গোত্রভুক্ত, যার প্রায় ৭০ ধরনের ভাইরাসের মধ্যে আছে ইয়োলো ফিভার (ুবষষড়ি ভবাবৎ) ও কয়েক প্রকার এনসেফালাইটিসের ভাইরাস। ডেঙ্গু উদ্ভব ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে তা বলা মুশকিল। তবে ধারণা করা হয় এটি এসেছে 'সোয়াহিলি' শব্দবন্ধ কা-ডিঙ্গা পেপো, যার অর্থ দুষ্ট আত্মার কারণে ঘটিত রোগ। সোয়াহিলি শব্দ ডিঙ্গা খুব সম্ভবত স্পেনীয় শব্দ 'ডেঙ্গু'র মূলে আছে যার অর্থ খুঁতখুঁতে বা সাবধানী, যা ডেঙ্গুজ্বরের হাড়ের ব্যথায় আক্রান্ত ব্যক্তির চলনকে বর্ণনা করে। ডেঙ্গুজ্বর কথাটির সর্বপ্রথম ব্যবহার হয় ১৮২৮ সালের পর। ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণু বহনকারী মশাটির নাম এডিস মশা। এটি দেখতে অন্যান্য মশার মতো হলেও সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্যই অন্যান্য মশা থেকে এডিস মশাকে আলাদা করে চেনা যায়। এডিস মশা দেখতে গাঢ় নীলাভ কালো রঙের। এ মশার সারা শরীরে সাদা-কালো ডোরাকাটা দাগ থাকে। এর পেছনের পা-গুলো সামনের পা-গুলো থেকে অপেক্ষাকৃত লম্বাটে ধরনের হয়ে থাকে। মূলত এই প্রজাতির স্ত্রী মশা ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণু বহন করে থাকে। এর একটি প্রজাতির নাম এডিস এজিপটাই ও অন্যটির নাম এডিস এবললাপিকটাস। ডেঙ্গুজ্বরের প্রথম বিবরণ পাওয়া যায় জিন বংশের (২৬৫-৪২০ খ্রিষ্টাব্দ) এক চীনা মেডিকেল এনসাইক্লোপিডিয়ায় (বিশ্বকোশ) যেখানে উড়ন্ত পুঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত 'জলীয় বিষ'-এর কথা বলা হয়েছে। তবে ডেঙ্গু মহামারি সম্পর্কিত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় ১৭৭৯ ও ১৭৮০। ওই সময়ে এশিয়ার অনেক দেশ, আফ্রিকা এবং উত্তর আমেরিকা এর কবলে পড়েছিল। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনিয়মিত হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর প্রাদুর্ভাব এতই বেড়ে যায় যে তা মহামারি আকার ধারণ করে। এরপর ১৯৫৩ সালে ফিলিপাইনে এর রূপ চরমে ওঠে। অন্যান্য ভাইরাসের মতোই ভেজা, পুঁতিগন্ধময় ও সঁ্যাতসেঁতে জায়গায় ডেঙ্গুভাইরাস জন্ম নেয়। বিশেষভাবে এডিস মশার আবাসস্থলে এ ভাইরাস দ্রম্নত ছড়ায়। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো- এডিস মশা অন্যান্য মশার মতো ময়লা পানি ও আবর্জনায় বাস করে না। এরা সাধারণত স্বচ্ছ পানিতে ও বাড়িঘরের কাছাকাছি গাছপালায় বসবাস করে। বিশেষ করে ঘরে ফুল বা গাছের টবে এরা ডিম পাড়ে। ডেঙ্গুভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসেবে সাধারণত বাড়িঘরের নিকটবর্তী পচনশীল লতাপাতা, পরিত্যক্ত টায়ার ও নারকেলের খোসায় জমে থাকা পানি, খাদ্য, ফ্রিজ, নালা, ডোবা, নর্দমা, টবের পানি, গোবর, টয়লেট প্রভৃতিকে চিহ্নিত করা যায়।

গরম এবং বর্ষার সময়ই আমাদের দেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বাড়ে। মূলত মে থেকে সেপ্টেম্বর এই পাঁচ মাস ডেঙ্গুজ্বরের মৌসুম বলা চলে। তবে শীতকালে সাধারণত ডেঙ্গুজ্বর হয় না। গ্রামাঞ্চলে যারা বসবাস করেন তাদের মধ্যে তুলনামূলক ডেঙ্গুজ্বর কমই হয়। ডেঙ্গুজ্বরে বেশি আক্রান্ত হন শহরাঞ্চলের মানুষ। সাধারণত বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় যেখানে বড় বড় দালানকোঠা আছে সেসব জায়গার মানুষই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ডেঙ্গুজ্বরে বেশি আক্রান্ত হন। ডেঙ্গু ভাইরাস মানুষের মানুষের শরীরে পরিবেশগতভাবেই সংক্রমিত হয়ে থাকে। তবে এডিস মশার দ্বারা এটি সহজে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। ভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরে স্বাভাবিক জ্বরের মতোই জ্বর দেখা যায়। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত শতকরা ৮০ ভাগ রোগী থাকেন উপসর্গবিহীন। সামান্য জ্বরের মতো উপসর্গ থাকে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে (৫%) তা জটিল হতে পারে। ডেঙ্গুজ্বর স্বল্প অনুপাতে প্রাণঘাতী। ইনকিউবিশন পিরিয়ড (উপসর্গগুলোর সূত্রপাত থেকে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের মধ্যবর্তী সময়) স্থায়ী হয় ৩-১৪ দিন, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা হয় ৪-৭ দিন।

ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর উপসর্গগুলো মারাত্মকভাবে প্রকাশ পায়। জ্বর আকস্মিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত ওঠে। খাদ্যে অরুচি ও বমি বমি ভাব দেখা দেয়। বমিও হতে পারে। সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা দেখা দেয়। বিশেষ করে মেরুদন্ড, হাড় ও মাথায় অসহ্য ব্যথা হয়। চামড়ার নিচে ও চোখের সাদা অংশে রক্ত জমাট বাঁধে। ঠোঁট, জিহ্বাসহ মুখমন্ডল রক্তিমাভ হয়ে ওঠে। শরীর ফ্যাকাশে হয়ে যায়। রক্তচাপ নেমে আসে এবং পিপাসা বৃদ্ধি পায়। শরীরের অভ্যন্তরে, নাক, মুখ ও মলদ্বারে রক্তক্ষরণ হয়। প্রচন্ড জ্বর ও রক্তক্ষরণে রোগী মারা পর্যন্ত যেতে পারে।

ডেঙ্গুজ্বর প্রধানত তিন ধরনের হয়। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু, হেমোরেজিক ডেঙ্গু ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রচন্ড জ্বর, মাথাব্যথা, মাংসপেশি ও জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে। সেই সঙ্গে বুকে এবং শরীরের নিম্নাঙ্গে উজ্জ্বল লাল ফুসকুুড়ি, পাকস্থলীর প্রদাহ অথবা পেটেব্যথা, বমিভাব বা বমি হওয়া এবং ডায়রিয়াও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে জ্বর সাধারণত ২-৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। জ্বরের তাপমাত্রা খুব সামান্য পরিমাণে ওঠা-নামা করে। অনেক ক্ষেত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জা অথবা অন্যান্য জ্বরের সঙ্গে এই জ্বর সাদৃশ্যপূর্ণ। ডেঙ্গুজ্বরের মধ্যে হেমোরেজিক ফিভার সবচেয়ে জটিল। এই জ্বরে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরও বেশকিছু সমস্যা দেখা দেয়। যেমন : রক্তবমি, পায়খানার সঙ্গে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা হতে পারে, চোখের মধ্যে ও চোখের বাইরে রক্ত পড়তে পারে ডেঙ্গুজ্বরের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রোগীর মৃতু্য পর্যন্তও হতে পারে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সঙ্গে সার্কুলেটরি ফেইলিওর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনন্ড্রোম হয়। ডেঙ্গুভাইরাস বহনকারী মশা যখন কাউকে কামরায় তখন, তখন মশার লালার সঙ্গে ভাইরাস ত্বকের ভিতর প্রবেশ করে। এরপর ভাইরাসটি তার বাসস্থান পাকা করে নেয় এবং রক্তকোষে প্রবেশ করে। রক্তের সঙ্গে এই ভাইরাস কোষের সর্বত্র বিচরণ করে এবং ভাইরাস প্রজননকার্য চালিয়ে যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় শ্বেত রক্তকোষগুলো বহুসংখ্যক সিগন্যালিং প্রোটিন তৈরি করে, যেমন ইন্টারফেরন, যা অনেক উপসর্গের জন্য দায়ী, যেমন- জ্বর, ফ্লু-এর মতো উপসর্গ এবং প্রচন্ড যন্ত্রণা। শরীরের ভিতরে ভাইরাসের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে শরীরের অনেক প্রত্যঙ্গ (যেমন যকৃত এবং অস্থিমজ্জা) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং রক্তস্রোত থেকে তরল ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলোর দেওয়াল থেকে শরীর গহ্বরে চুঁইয়ে পড়ে। ফলে রক্তনালিগুলোতে কম রক্ত সংবহিত হয় এবং রক্তচাপ এত বেশি কমে যায় যে প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোয় যথেষ্ট পরিমাণে রক্ত সরবরাহ হতে পারে না। অস্থিমজ্জা কাজ না করায় অনুচক্রিকা বা পেস্নটলেটসের সংখ্যা কমে এতে রক্তপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায় যা ডেঙ্গুজ্বরের অন্যতম বড় সমস্যা। ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধী টিকা কয়েকটি দেশে অনুমোদিত হয়েছে। তবে এই টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর। এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রথম ও প্রধান উপায় হলো এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ করা। এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে বংশবিস্তার করে। বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা বৃষ্টির পানি ও পরিষ্কার পানি, ৪-৫ দিন জমে থাকা পানি হলো এডিস মশার বংশবিস্তারের স্থান। লার্ভা বেশির ভাগই পরিত্যক্ত টায়ার, বালতি, ফেলে দেওয়া নারিকেলের খোল, ফুলদানি, ফুলের টবের নিচের থালায় জমে থাকা পানিতে, এমনকি জমে থাকা গাছের গর্তে এবং এ ধরনের অন্যান্য প্রাকৃতিক স্থানে বড় হয়। পূর্ণবয়স্ক মশা সাধারণত ঘরের ভিতর অন্ধকার জায়গায়- আলমারি, বিছানা বা খাটের তলায় থাকতে পারে। এডিস মশা দিনের বেলা সক্রিয় থাকে তাই এরা সকালে এবং বিকালের শেষ দিকে বেশি কামড়ায়। তাই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে দিনের বেলায় মশারি ব্যবহার করতে হবে। হাত-পা যেন ঢাকা থাকে খেয়াল রাখতে হবে। ঘরের চারদিক পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতে হবে। কোথাও যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেহেতু ডেঙ্গুজ্বরের কোনো প্রতিষেধক নেই সুতরাং নিজ শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাই পারে এ ভাইরাসকে মারতে। ডেঙ্গুজ্বর হলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে এবং বেশি করে তরল খাবার গ্রহণ করতে হবে। ভিটামিন সিজাতীয় খাবার খেতে হবে। রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন খাবার খেতে হবে। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল দেওয়া হয়। প্রায়ই রোগীর শিরায় স্যালাইন দিতে হতে পারে। মারাত্মক রূপ ধারণ করলে রোগীকে রক্ত দিতে হতে পারে। ডেঙ্গুজ্বর হলে কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ও ননস্টেরয়েডাল প্রদাহ প্রশমি ওষুধ সেবন করা যাবে না এতে রক্তপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে আমাদের করণীয় হলো- এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ করা। ডেঙ্গু মশা এবং তার বংশবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ- দুটোই আমাদের চারপাশে বিদ্যমান। তাই ডেঙ্গুজ্বরকে ঠেকিয়ে রাখা কঠিন। ডেঙ্গু আগেও ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই ডেঙ্গুজ্বরকে ভয় না পেয়ে এর সঙ্গে যুদ্ধ করেই এবং একই সঙ্গে প্রতিরোধ করেই আমাদের চলতে হবে।

অভিরাজ নাথ

ছড়াকার ও কলাম লেখক

চট্টগ্রাম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে