শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কোটা নামক ধূম্রজালে আবদ্ধ মেধাবীরা

নতুনধারা
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

শিক্ষাই শক্তি, শিক্ষাই মুক্তি- অর্থাৎ দেশের অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে শিক্ষা। আর উচ্চ শিক্ষার সুতিকাগার বলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। এখানে গবেষণা ও নতুন নতুন আবিষ্কার হবে, হবে মেধাবীদের মিলনমেলা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মেধাবীদের উচ্চ শিক্ষার এক স্বপ্নের জায়গা। কারণ এখানে পড়াশোনার মান ভালো এবং পড়াশোর খরচ তুলনামূলকভাবে কম। হাজারো স্বপ্ন, কঠোর পরিশ্রম এবং অর্থ ব্যয় করে ভালো পরীক্ষা দিয়েও এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া অনিশ্চিত। এর প্রধান কারণ ভর্তিতে কোটাপদ্ধতি। প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় একজন শিক্ষার্থী অন্যদের চেয়ে শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য এক নম্বর কম পাওয়ার কারণে যেখানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না; সেখানে কোটার কারণে অনেক কম নম্বর পেয়েও বহু শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ নিচ্ছে। এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করেও কোটার ভিত্তিতে চান্স পেয়েছে।

এর অকাট্য উদাহরণ হলো, ২৭ জানুয়ারি ২০২২ সালে 'দৈনিক ইত্তেফাক' পত্রিকায় প্রকাশিত, পাস করলেই পোষ্য কোটায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু শিক্ষার্থীর ভর্তির সুযোগের কথা। ৮ নভেম্বর ২০২২, 'কালের কণ্ঠ' পত্রিকায় প্রকাশিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক ভর্তি পরীক্ষায় পোষ্য কোটায় ৭১ জন প্রার্থী অকৃতকার্য হয়েও ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। সংবিধানে যেখানে বলা আছে কোটা অনগ্রসর ব্যক্তিদের জন্য রাখা হয়। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে পোষ্য কোটা রাখা হয়েছে; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোন দিক দিয়ে অনগ্রসর, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়।

অথচ কোটাপদ্ধতি ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলের। কিন্তু তা ছিল সীমিত পর্যায়ে উচ্চতর পদেই আর সীমিত আকারে। বাংলাদেশে কোটাপদ্ধতি চালু হয়েছিল ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের সাময়িক সুবিধার জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের নাতি-নাতনিদের এর আওতায় নিয়ে আসা হয়। পর্যায়ক্রমে চাকরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও কোটার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। সরকারি চাকরিতে যেমন- পোষ্য, মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, নারী, উপজাতিসহ নানা কোটা পরিলক্ষিত হতো। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে 'বাংলাদেশ ছাত্র সংরক্ষণ পরিষদ' কোটাবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে। সরকার এই জোরালো আন্দোলনের ফলে কোটা সংস্কার করতে বাধ্য হয়; কিন্তু অধিকাংশ সরকারি চাকরিতে কোটায় নিয়োগ এখনো বহাল রয়েই গেছে।

সম্প্রতি 'প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ' ২০২০ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৩৭৫৭৪ জন প্রার্থীকে ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। এ পরীক্ষার নিয়োগে ৬০ শতাংশ নারী কোটা, ২০ শতাংশ পোষ্য কোটা, ২০ শতাংশ পুরুষ কোটা প্রয়োগ করে যেখানে এই কোটার ওপর ২০ শতাংশ বিজ্ঞান কোটা রাখা হয়। সে হিসাবে নারী ও পোষ্য নারী ২৬৩০২, পোষ্য পুরুষ ৩৭৫৭ এবং পুরুষ মেধায় ৫৭১৫ জন নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এমনকি কোটায় নিয়োগের ফলে ভিন্ন ভিন্ন কার্ট মার্কে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ফলে কোটার পরিপ্রেক্ষিতে মেধায় তুলনামূলক অল্পসংখ্যক পুরুষই নিয়োগ পায়। এভাবে কোটা ব্যবস্থার বেড়াজালে পড়ে বাংলাদেশের সরকারি নিয়োগের একটা বড় খাত সহকারী শিক্ষক নিয়োগে বৈষম্যের কারণে বঞ্চিত হচ্ছে যোগ্য জনরা।

অদৃশ্যমান এই কোটা ব্যবস্থায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রাজনীতির ধূম্রজাল বুনে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অযোগ্যদের চাকরির সুযোগ করে দেন। ফলে যোগ্যরা হারাচ্ছে তাদের কর্মসংস্থান এবং তৈরি হচ্ছে অযোগ্যদের এক বিশাল বলয়। এই দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান কোটা ব্যবস্থার রোশানলে পড়ে প্রতি বছর কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা এবং চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে লক্ষাধিক মেধাবী শিক্ষার্থী। যে রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে গরিব মেহনতি মানুষের অধিকার প্রদানের জন্য আজ তা হয়েছে দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ। গরিব, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা তাদের অনেক স্বপ্ন থাকে তারা ভালো একটা চাকরি পেয়ে বাবা-মার মুখে হাসি ফোটাবে; কিন্তু তাদের এ স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় কোটানামক বৈষম্যের কাছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগের জন্য সবার সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে। তবে উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কোন অনগ্রসর অংশের (প্রতিবন্ধী ও উপজাতি) জন্য বিশেষ বিধান রাখার কথা; কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি চাকরির বাজারে অধিকাংশ প্রার্থী পোষ্য কোটার সুবিধাভোগী। তাহলে প্রশাসন সবার সমান অধিকারের যে ফিরিস্তি দিচ্ছে, তা কতটুকু বাস্তব তাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।

সম্প্রীতি, পোষ্য কোটা বাতিলে ডিসিদের সুপারিশ নজরকাড়ার মতো। কিন্তু অধিকাংশ কোটা ব্যবস্থা এখনো রয়েই গেছে। আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে। স্বাধীন দেশে আজও আমরা স্বাধীন হতে পারিনি। কোটা ব্যবস্থা একটা জাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। যেটা অনগ্রসর জাতির জন্য দেওয়া হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ সুবিধা ভোগ করে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এই অযৌক্তিক কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা এখন সময়ের দাবি। এতে মেধাবীরা অর্জন করবে তাদের যোগ্য স্থান। আলোর মশালবাহী অগ্রদূতের মতো তারাই বিশ্ব দরবারে এগিয়ে নেবে দেশকে। তাই দেশের কল্যাণার্থে কোটাপদ্ধতি বাতিলের জন্য প্রয়োজনীয় তদন্ত ও কঠোর ব্যবস্থা নিতে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

মো. আনোয়ার হোসেন

শিক্ষার্থী

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

রংপুর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে