বাঙালির জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের একটি বড় অধ্যায়জুড়ে রয়েছে মহান একুশে ফেব্রম্নয়ারি। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার স্মৃতিচিহ্নিত এই দিনটি সংগ্রামের জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় উজ্জ্বল এবং রক্তাক্ত আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতার প্রথম পর্ব। এই প্রথম পর্বে আমাদের শিল্পী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদের অবদান চিরস্মরণীয়। তাদের অবদান কোনো দিন ভুলবার না। একুশের চেতনার জন্ম হয়েছিল এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল, তা পরবর্তী আন্দোলনগুলোর জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনে। একুশের চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনের আত্মত্যাগের বীজমন্ত্র। '৫২-র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই পূর্ব বাংলার অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রথম সংগঠিত সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। ভাষা আন্দোলনের চেতনাবাহী অমর একুশের বইমেলা। এই মেলা বাঙালির প্রাণের মেলা, আনন্দের মেলা এবং একইসঙ্গে মিলনমেলা। দেশের বইপ্রেমীরা সারা বছর এই মেলার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন।
বাংলা সংস্কৃতি-সাহিত্যকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বারবার উঠে এসেছে। তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। যে সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, ওই সব দেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশে উদ্যোগ নিতে পারেন। প্রবাসী অনেক প্রতিভাবান বাংলাদেশি রয়েছেন- যারা উৎকৃষ্টমানের গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখেন। প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী সংগীতশিল্পীও প্রবাসে রয়েছেন। সবার সম্মিলিত উদ্যোগই কেবল পারে বাংলাসাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে। এর পাশাপাশি আমাদের সাহিত্য বিদেশি ভাষায় অনুবাদ হওয়া জরুরি। এই উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। এ পর্যন্ত অনুবাদের কাজ যা হয়েছে তা সংখ্যায় খুবই অল্প। ব্যক্তি উদ্যোগেও কিছু কাজ হয়েছে- যা প্রশংসনীয়।
জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। মাতৃভাষার প্রতি তার ছিল গভীর মমত্ববোধ; একইভাবে গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও। দেশের শিল্পসাহিত্য বিকাশে তিনি বেশ মনোযোগী ও তৎপর। উলেস্নখ্য, স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে, ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি চত্বরে ব্যক্তি উদ্যোগে ৩২টি বই নিয়ে অতিক্ষুদ্র মেলা বসেছিল। এই মেলার উদ্যোগী প্রাণপুরুষ ছিলেন মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা। তারই স্বপ্ন ও ভাবনা থেকে বসেছিল এই বইয়ের মেলা। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন আজ বইয়ের মহামিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। মাসব্যাপী এক অনন্য উৎসবের সমারোহ হয়েছে। এবারের মেলায় বই বিক্রি ভালো হবে, পাঠকের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস রয়েছে।
উলেস্নখ্য, ১৯৭৬ সালে কয়েকটি প্রকাশনী সংস্থাসহ বাংলা একাডেমিও এই বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হয়। আর ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি এককভাবেই অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরু করে। ১৯৯০-এর দশকেই বইমেলা পরিণত হয় প্রাণের মেলায়, বাঙালির মহামিলন উৎসবে। এই মেলার সঙ্গে বাঙালির আবেগ, সংগ্রাম, ভালোবাসা ও ত্যাগ জড়িত। ২০১৪ সাল থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হয়েছে। ২০২১ সাল থেকে উদ্যানের মেলায় যুক্ত হয়েছে লিটল ম্যাগ চত্বর। মেলায় চালু করা হয়েছে শিশুপ্রহর, শিশুদের বইয়ের জন্য আলাদা চত্বর, লেখক বলছি মঞ্চ- যা আলাদা আবেদন তৈরি করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশে বইয়ের পাঠকসংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে না কমছে এ প্রশ্নও উঠে এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগে মানুষ ধীরে ধীরে বইবিমুখ হয়ে পড়ছে। এটা কোনো ইতিবাচক প্রবণতা নয়। কারণ বইমেলা ছাড়া সারা বছর ওইভাবে বই বিক্রি হয় না বলে প্রকাশকদের অভিযোগ। প্রকৃত অর্থে মৌসুমভিত্তিক বইয়ের পাঠক থাকা উচিত নয়। সারা বছর একই রকম আমেজ ও উৎসাহ নিয়ে বই প্রকাশিত হওয়া উচিত। সরকারের উচিত পাড়ায় মহলস্নায় পাঠাগার গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া। এ জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ থাকা উচিত। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র যে কাজ করছে তা খুবই সীমিত। সরকারি উদ্যোগ ছাড়া সফল পাঠাগার আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বইয়ের বিকল্প নেই। এ কথা বারবার উচ্চারিত হয়ে আসছে।
প্রতি বছর এই মেলাকে উপলক্ষ্য করে প্রকাশিত হয় কয়েক হাজার নতুন বই। এবার কাগজের উচ্চমূল্যের কারণে হয়তো বা আগের বছরগুলোর তুলনায় কম বই বের হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে মেলায় যেসব বই বের হয়, এর কতভাগ বই মানসম্মত।
যিনি প্রকৃত লেখক তার বইও বের হচ্ছে, আবার যিনি সৌখিন লেখক তিনিও টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করছেন। ফলে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। যে যেভাবে পারছে বই প্রকাশ করছে। বাইরের দেশগুলোতে এভাবে বই প্রকাশিত হয় না। উন্নত দেশে সম্পাদনার প্যানেল থাকে। সম্পাদনা পরিষদ কোনো পান্ডুলিপির অনুমোদন দিলেই কেবল তা বই আকারে প্রকাশ পাবে। বাংলাদেশে এর উল্টো চিত্র দেখতে পাচ্ছি। টাকা থাকলে বাংলাদেশে বই প্রকাশ করা কোনো কঠিন কাজ নয়।
স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেয়া হয়। বিভিন্ন সরকারের আমলে আইনও প্রণয়ন করা হয়। আইনের প্রয়োগ না থাকা অথবা মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞার কারণে দেশের বেশির ভাগ স্তরেই বাংলা বিমুখতা প্রকট আকার ধারণ করে। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। এত কিছুর পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা একদিন অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। তাই ভাষার সম্মান ও মর্যাদা অবিলম্বে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন ভাষাবিদরা। বাংলা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মাতৃভাষা, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা তথা সরকারি ভাষা। যে কোনো ভাষাই সচল প্রবহমান নদীর মতো। চর্চা ও গবেষণার মাধ্যমেই ভাষা সমৃদ্ধশালী হয়। পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয় নতুন আঙ্গিক ও অবয়বে।
হাজার বছরের বাংলা অনেক সমৃদ্ধ ভাষা। এর শব্দভান্ডার অফুরন্ত। এর রয়েছে নানা বৈচিত্র্য, সৌন্দর্য ও মাধুর্য। অথচ বাংলা ভাষার ঐতিহ্য হারিয়ে আমরা জগাখিচুড়ির মতো অবস্থায় উপনীত হয়েছি। এই ধরনের পরিস্থিতি সত্যিই দুঃখজনক। যে করেই হোক, এমন নাজুক অবস্থার উত্তোরণ ঘটাতে হবে।
ভাষা আন্দোলন, বাংলা একাডেমি আর একুশের বইমেলা মূলত একই সূত্রেগাঁথা। একুশে ফেব্রম্নয়ারির এই যে বইমেলা, এ শুধুই বইমেলা নয়, একুশের চেতনায় ভাস্বর বাঙালির আন্দোলনের প্রতিবাদের প্রতীক। তাই এ মেলার সঙ্গে মিশে আছে একুশের চেতনা, একুশের আদর্শ; নিহিত রয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির উৎসমূল। সঙ্গত কারণেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুসহ ভাষার বিকৃতি রোধ করতে হবে। রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের এই ভাষা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এরপরও আমরা কেন এই ভাষার সম্মান আর মর্যাদা রাখতে পারছি না। আমাদের ছেলেমেয়েরা বাংলিশ ভাষায় কথা বলছে। তারা বাংলাভাষার প্রতি উদাসীন। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ভুল বানানে বাংলা লেখা সাইন বোর্ড চোখে পড়ে, ইংরেজি সাইন বোর্ডেরও সর্বত্র ছড়াছড়ি। এটা মেনে নেয়া যায় না। ভাষার মাস এলে এ ব্যাপারে কিছু বিক্ষিপ্তি উদ্যোগ চোখে পড়ে মাত্র, তারপর যা তাই। মাতৃভাষার প্রতি দরদ ও ভালোবাসাই কেবল পারে জাতি হিসেবে আমাদের আরো সমৃদ্ধ, উন্নত ও বিকশিত করতে।
সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক