জাতির জনকের জন্মদিন সূত্রে জাতীয় শিশু দিবস আজ। জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক শিশু দিবস (২০ নভেম্বর) এর বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তারিখে জাতীয় শিশু দিবস পালনের চর্চা রয়েছে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাতীয় শিশু দিবস পালনের প্রথম সূচনা হয় তুরস্কে ১৯২০ সালের ২৩ এপ্রিল। প্রতিবেশী ভারতে শিশু দিবস পালন হয় তাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর জন্মদিন ১৪ নভেম্বরে (পালন হচ্ছে ১৯৬৭ সাল থেকে)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় শিশু দিবস পালন করে জুনের দ্বিতীয় রবিবারে। থাইল্যান্ডে জানুয়ারির দ্বিতীয় শনিবার, হংকংয়ে ৪ এপ্রিল, নিউজিল্যান্ডে মার্চের প্রথম রোববার, জাপানে ৫ মে, মালদ্বীপে ১০ মে, নরওয়েতে ১৭ মে, স্পেনে মে'র দ্বিতীয় রোববার, চীন-রাশিয়াসহ বেশ ক'টি দেশে ১ জুন, ইন্দোনেশিয়ায় ২৩ জুলাই, নেপালে ১৪ সেপ্টেম্বর, জার্মানিতে ২০ সেপ্টেম্বর, সিঙ্গাপুরে অক্টোবরের প্রথম শুক্রবার, ইরানে ৮ অক্টোবর, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় অক্টোবরের চতুর্থ শনিবার। সৌদিসহ আরব বিশ্বের কয়েকটি দেশে জাতীয় শিশু দিবস পালন হয় ২০ নভেম্বর। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বা বিশ্ব শিশু দিবস পালন হলেও জাতীয় শিশু দিবস ছিল না। বাংলাদেশকে এ চর্চায় যুক্ত করা হয়েছে অনেক দেরিতে।
জাতীয় শিশু দিবসের তাৎপর্য সব দেশে একই। মূল উদ্দেশ্য দেশটির শিশুদের উদ্দীপ্ত করা। গৌরবময় ও অনুকরণীয় কাউকে সামনে রেখে শিশুদের মাঝে চারিত্রিক দৃঢ়তা তৈরি করা। বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের শিশুদের জন্য গৌরব ও শিক্ষণীয় চরিত্র হিসেবে বাছাই করা হয় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। সরকারের এ সিদ্ধান্তে আসার পূর্বাপরে রয়েছে অনেক পরিপ্রেক্ষিত। গণমাধ্যমে কাজের সুবাদে এর নেপথ্য কিছু তথ্য পাঠকদের শেয়ার করার অবকাশ রয়েছে। শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ, নিজের জন্মদিনে শিশুসঙ্গে তার নিজেরও শিশুতোষ হয়ে যাওয়াসহ ঘটনাগুলো বিবেচনায় শিক্ষাবিদ ড. নীলিমা ইব্রাহিম দিনটিকে 'জাতীয় শিশু দিবস' হিসেবে পালনের প্রস্তাব করেছিলেন ১৯৯৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর শিশু সংগঠন বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলার জাতীয় সম্মেলনে। ওই সম্মেলনটিতে প্রধান অতিথি ছিলেন তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ড. নীলিমা ইব্রাহিমের প্রস্তাবে সমর্থন জানান।
পরের বছর ১৯৯৪ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা প্রথমবারের মতো বেসরকারিভাবে ১৭ মার্চ 'জাতীয় শিশু দিবস' পালন করে। প্রথম জাতীয় শিশু দিবস উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানা। এর পর ৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রীয় 'খ' শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস ঘোষণা করে ওই সময়ের মন্ত্রিসভা। রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালন শুরু ১৯৯৭ সাল থেকে। পরবর্তী দিনটিতে সাধারণ ছুটিও ঘোষণা করা হয়। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত সরকার শিশু দিবস এবং সরকারি ছুটি বাতিল করে। ফলে ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দিবসটি পালন হয়নি। নবম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে আবারও প্রতি বছর জাতীয় পর্যায়ে আরো বড় আয়োজনে পালন করে আসছে দিনটি। জাতির জনকের জন্মদিনকে শিশুদের জন্য উৎসর্গ করে জাতীয় শিশু দিবস পালনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে শিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসভূমিতে পরিণত করার স্পষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে সরকারের।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিবসের কিছু বিস্ময়কর ঐতিহাসিক মাত্রাও রয়েছে। রোমানদের পরাজয়ের পর মুসলমানদের বায়তুল মোকাদ্দাস জয়ের তারিখও ১৭ মার্চ (৬৩৬)। ৭৬৩-এর এ দিনে আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদেরও জন্ম। ইসলামের ইতিহাসে বড় পীর খ্যাত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ত্ব আব্দুল কাদের জিলানীরও জন্ম এ দিনে (১০৭৮)। ইউরোপীয় ইতিহাসের আলোচিত স্কটল্যান্ডের রাজা- চতুর্থ জেমসের জন্মও ১৭ মার্চ, ১৪৭৩। আর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এক অজপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুন দম্পতির ঘরে ১৯২০ সালের ওই তারিখেই জন্ম শেখ মুজিবুর রহমানের।
ইতিহাসমন্ডিত ওই তারিখে তিনি জন্মেছিলেন, দেশের কর্ণধার হয়েছিলেন বা শিশুদের ভীষণ ভালোবাসতেন বা জন্মদিনে শিুশুবেষ্টিত থাকতেন বলেই দিনটিকে জাতীয় শিশু দিবস করতে হবে- বিষয়টি শুধু এমনই? আর কোনো যোগসূত্র বা বিষয়-আসয় নেই? আছে তার মধ্যে শিশুদের উদ্দীপ্ত করার অনেক উপাদান। গৌরব বোধ ও অনুকরণ করে শিশুদের চারিত্রিক দৃঢ়তা তৈরির শিক্ষা ভান্ডার তিনি। গল্পের মতো বিস্ময়ভরা তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। মা-বাবা আদর করে ডাকতেন খোকা নামে। স্থানীয় বন্ধুবান্ধব সমবয়সি ও গ্রামের মানুষের কাছে মজিবর। স্কুলের খাতায় শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনীতিতে শেখ মুজিব, মুজিব বা শেখ সাহেব। মওলানা ভাসানীসহ সিনিয়রদের কাছে মজিবর। আর ইতিহাসের পাতায় বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক। যার শৈশবের প্রতিটি পরতে পরতেই জানার-বোঝার অনেক খোরাক। বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারি বানের মতো তার দূরন্তপনা ও নেতৃত্বের ঝলক শৈশব থেকেই। ওই শৈশবেই অসুস্থ হয়ে পড়ালেখা বন্ধ, অন্ধ হওয়ার উপক্রম। সেরে ওঠে কয়েক বছর গ্যাপ দিয়ে আবার পড়াশোনা। এসবের কয়েক লাইন বর্ণনা রয়েছে তার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে। যার কয়েকটি লাইন এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
১৯৩৪ সালে যখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি তখন ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম এবং খুব ভালো ব্রতচারী করতে পারতাম। হঠাৎ বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার হার্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। আব্বা আমাকে নিয়ে কলকাতা চিকিৎসা করাতে যান। কলকাতার বড় বড় ডাক্তার শিরপদ ভট্টাচার্য, এ কে রায় চৌধুরী আরও অনেককেই দেখান এবং চিকিৎসা করাতে থাকেন। প্রায় দুই বছর আমার এভাবে চলল। ...১৯৩৬ সালে আব্বা মাদারীপুর মহকুমায় সেরেস্তাদার হয়ে বদলি হয়ে যান। আমার অসুস্থতার জন্য মাকেও সেখানে নিয়ে আসেন। ১৯৩৬ সালে আবার আমার চক্ষু খারাপ হয়ে পড়ে। গস্নুকোমা নামে একটা রোগ হয়। ডাক্তারদের পরামর্শে আব্বা আমাকে নিয়ে আবার কলকাতায় রওনা হলেন চিকিৎসার জন্য। এ সময় আমি মাদারীপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম লেখাপড়া করার জন্য। কলকাতা যেয়ে ডাক্তার টি আহমেদ সাহেবকে দেখালাম। ... ডাক্তার সাহেব আমার চক্ষু অপারেশন করতে বললেন। দেরি করলে আমি অন্ধ হয়ে যেতে পারি। আমাকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। ভোর ৯টায় অপারেশন হবে। আমি ভয় পেয়ে পালাতে চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু পারলাম না। আমাকে অপারেশন ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ১০ দিনের মধ্যে দুইটি চক্ষুই অপারেশন করা হলো। আমি ভালো হলাম। তবে কিছুদিন লেখাপড়া বন্ধ রাখতে হবে, চশমা পরতে হবে। তাই ১৯৩৬ সাল থেকেই চশমা পরছি। চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুরে ফিরে এলাম, কোনো কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। ...পনেরো-ষোলো বছরের ছেলেদের স্বদেশিরা দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার ওপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ... এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া-আসা করতাম।... ১৯৩৭ সালে আবার আমি লেখাপড়া শুরু করলাম। এবার আর পুরনো স্কুলে পড়ব না, কারণ আমার সহপাঠীরা আমাকে পেছনে ফেলে গেছে। আব্বা আমাকে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র উপরোক্ত কয়েক লাইনে হাজার-লাখ তথ্য, বিশ্লেষণ ও উপলব্ধির রসদ। শিশুদের বেড়ে ওঠা, প্রত্যয়ী হওয়ার পাঠ। স্কুল জীবনেই প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পথরোধ করে বিনয়ের সঙ্গে হোস্টেলের ছাদ মেরামতের দাবি আদায়ের শিক্ষা। শৈশবের পরই না কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে বড়দের বঙ্গবন্ধু হয়ে 'জুলিও কুরি' শান্তিপদক পাওয়া। প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের ভাষায় বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব হওয়া। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ইয়াসির আরাফাতের কাছে 'কুসুমকোমল হৃদয়ের আপসহীন সংগ্রামী নেতার মূল্যায়ন লাভ। এসবের আগে তো সম্ভাবনার শৈশব। যেখান থেকেই বর্তমান ও ভবিষ্যতের শিশুদের প্রেরণার আইকন খোঁজা।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলামিস্ট