সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্ম

নজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারের অধিক। তিনি ইসলামী গজলও রচনা করেছেন। নজরুলের প্রথম গদ্য রচনা ছিল 'বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী'। ১৯১৯ সালের মে মাসে এটি সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচি সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেছিলেন। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়। এছাড়া একই বছর প্রবন্ধ সংকলন যুগবাণী প্রকাশিত হয়। নজরুল 'ধূপছায়া' নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এটিতে তিনি একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপস্নব তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। লাঙ্গল ও গণবাণী পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেন সাম্যবাদী ও সর্বহারা কবিতাগুচ্ছ।
আরাফাত রহমান
  ২৫ মে ২০২৩, ০০:০০

২৫ মে বাংলা সাহিত্যের মহিরুহ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ছিলেন প্রগতিশীলতা ও মানবতার কবি। বাঙালির নিজস্ব জাতিসত্তা বিকাশের ক্ষেত্রে এই প্রবাদ পুরুষ ছিলেন শক্তির প্রধান উৎস। বাংলা সাহিত্যে তার সৃষ্টিকর্ম অনন্য ভাস্বর। তার রচিত সাহিত্যে চিন্তার প্রতিফলন আমাদের ঋদ্ধ করে। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী নজরুল বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে উচ্চ আসনে তুলে ধরেছেন। কবি নজরুলের অসাধারণ লেখনী, কবিতা ও গান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালি জাতিকে জুগিয়েছে অনুপ্রেরণা। যুগ-যুগ ধরে এই কবির সৃষ্টিশীল কর্ম সবাইকে চলার পথে প্রেরণা জুগিয়েছে নিয়মিত। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তার কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে।

কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৫ মে, বাংলা ১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাজারের খাদেম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল 'দুখু মিয়া'। নজরুল গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। এছাড়া মক্তবে কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে তার পিতার মৃতু্য হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পিতার মৃতু্যর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাত্র ১০ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাকে। এ সময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ওই মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন।

একই সঙ্গে হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ শুরু করেন। এসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান- যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো নাট্যদলে যোগ দেন। লেটো দলেই তার সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সঙ্গে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সঙ্গে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশ কিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন।

১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। আর্থিক সমস্যা তাকে বেশ দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবি দলে। এর পর আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউলস্নাহর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউলস্নাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুকে ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন।

১৯১৭ সালের শেষ দিকে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই সময় সহ-সৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সঙ্গে। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েছে, বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী, মুক্তি, হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক।

এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ওই বছরই এই পত্রিকায় 'মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের ওপর পুলিশের নজরদারি শুরু হয়। সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। একইসঙ্গে মুজাফ্‌ফর আহমদের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা ও সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিতা ও সঙ্গীতের চর্চাও চলছিল একাধারে।

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিলস্না থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপস্নবিক সাহিত্য কর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে- বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে- কামাল পাশা যাতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা- সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা। খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ।

দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নজরুলের এ সময়কার কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশিত হয়। এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বিদ্রোহী নামক কবিতাটি। বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে। ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৪ নভেম্বর পত্রিকার ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।

একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিলস্না থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দি প্রদান করেন। তার এই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যে রাজবন্দির জবানবন্দি নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করে। নজরুল যখন আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন ১৯২৩ সালের ২২ জানুয়ারি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উলস্নাসে কবিতাটি রচনা করেন।

নজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারের অধিক। তিনি ইসলামী গজলও রচনা করেছেন। নজরুলের প্রথম গদ্য রচনা ছিল 'বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী'। ১৯১৯ সালের মে মাসে এটি সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচি সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেছিলেন। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়। এছাড়া একই বছর প্রবন্ধ সংকলন যুগবাণী প্রকাশিত হয়। নজরুল 'ধূপছায়া' নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এটিতে তিনি একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপস্নব তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। লাঙ্গল ও গণবাণী পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেন সাম্যবাদী ও সর্বহারা কবিতাগুচ্ছ।

১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকেন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় এবং জাতীয় কবির মর্যাদা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের জাতির জনক ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি। ১৯৭৬ সালে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি আদেশ জারি করা হয়। তার রচিত 'চল্‌ চল্‌ চল্‌, ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল' বাংলাদেশের রণসঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি'লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়।

১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রম্নয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃতু্যবরণ করেন। বাংলাদেশে তার মৃতু্য উপলক্ষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয়। তার জানাজায় ১০ হাজারেরও অধিক মানুষ অংশ নেয়। নজরুল তার একটি গানে লিখেছিলেন, 'মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাইচ্:- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তার সমাধি রচিত হয়।

আরাফাত রহমান : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে