শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বাজেট হোক কৃষিবান্ধব

বাজেট বাড়িয়ে বা ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি করলেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে তা কিন্তু নয়। এর জন্য সরকারের অধিক তদারকির পাশাপাশি কৃষি মন্ত্রণালয়কে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
সাহাদাৎ রানা
  ০১ জুন ২০২৩, ০০:০০
বাজেট হোক কৃষিবান্ধব

আজ ১ জুন জাতীয় সংসদে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণার আগে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। কখনো অল্প আবার কখনো ব্যাপক হারে। বিশেষ করে কোন জিনিসের দাম বাড়বে কোন জিনিসের দাম কমবে এসব বিষয় নিয়ে পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে টিভি পর্দার টক শোতে আলোচনা বেশ জমে উঠে। সাধারণ জনগণের আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠে পণ্যের মূল্য ওঠানামার বিষয়গুলো নিয়ে। আর এখন তুমুল জনপ্রিয় ফেসবুকেও সেই আলোচনা যে হয় না, তা নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি লক্ষ্য করা যায়। এবার তেমন কিছু হবে না তা বলা যাচ্ছে না। তবে এবারের বাজেট নিয়ে সবার মধ্যে আগ্রহও বেশি। বিশেষ করে করোনার পরবর্তী সময়ে বাজেটকে ঘিরে মানুষের কিছু প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কৃষিতে বাড়তি মনোযোগ দেয়ার বিকল্প নেই।

কৃষিপ্রধান দেশ, বাংলাদেশ। আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তিও হলো কৃষি। কারণ এ দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশেষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। তাদের জীবিকার একমাত্র উৎসও এই কৃষি খাত। এবার একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ দেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এটা প্রাচীনকাল থেকে চলমান। কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত কারণ এখানকার মাটি। আমাদের দেশের মাটি পৃথিবীর যে কোনো দেশ থেকে অনেক বেশি উর্বর। যা ফসল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত জরুরি বিষয়। এ কারণে স্বাধীনতার পর থেকে দিন দিন এই কৃষি খাতে আমাদের সাফল্যও এসেছে ব্যাপক। প্রায় প্রতি বছরই আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রার অধিক উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি। এটা অবশ্যই আমাদের জন্য সাফল্যের খবর। বিশেষ করে কৃষকদের জন্য। কারণ এর ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন কৃষকরা। যারা কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করেন। পাশাপাশি দেশের মানুষের জন্যও আনন্দের খবর। দেশের অর্থনীতির জন্যও আনন্দের খবর।

এত কিছুর পরও বিপরীতে কিছু ব্যর্থতাও রয়েছে। কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে কৃষকরা ফসল উৎপাদন করেন বিপরীতে প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থমূল্য পান না তারা। এই আলোচনা দীর্ঘদিনের। তবে সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে ধানের মূল্য কমে যাওয়ায় আবারও নতুন করে বিষয়টি সবার সামনে এসেছে। তবে বাজেট ঘোষণার আগে এই বিষয়টি সামনে আসায় বাজেটে বেশি করে কৃষকদের দিকে দৃষ্টিপাত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কারণ এবারের বাজেটে কৃষকদের জন্য আলাদা করে ভাবা উচিত। কেননা, সবার মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে কৃষি খাতের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের অবস্থা এখন প্রত্যাশিত জায়গায় নেই। যার চূড়ান্ত ফলাফল ধানের মূল্য কমে যাওয়া। অথচ, কৃষকদের দিনরাত নিরলস পরিশ্রমের ফসল হলো ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধি। কৃষকরা প্রতি বছরই কষ্ট করে অর্জিত তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। বরং সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এক্ষেত্রে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো কৃষকরা তাদের সেরা পণ্যটা ফলাতে উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ, কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করছেন। বিনিময়ে উৎপাদনও করছেন প্রত্যাশিত। কিন্তু উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ, কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচ ব্যবস্থা ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পায় আনুপাতিক হারে প্রতি বছরই। কিন্তু বিপরীতে মূল্যবৃদ্ধি পায় না। বরং কমতে থাকে। যা হতাশার। কৃষি অর্থনীতিতে যদি বিরূপ প্রভাব পড়ে তবে সামগ্রিক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতির উপরও। কেননা, দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক কৃষি খাতের সঙ্গে জড়িত। আরও চিন্তার বিষয় হলো অনেক কৃষকই ফসল উৎপাদনের জন্য ঋণ নিয়ে থাকেন এবং ফসল বিক্রি করে সেই অর্থ পরিশোধ করার টার্গেট নির্ধারণ করেন। এখন যদি ফসলের যথাযথ দাম তারা না পান, তবে কীভাবে ঋণের অর্থ ফেরত দেবেন তারা। এতে করে কৃষকরা কৃষি পণ্য ফলানোর দিকে আগ্রহ হারাবেন। এটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সবার জন্যই শঙ্কার কারণ। সেই সঙ্গে, ফসল ওঠার মৌসুমে ফসলের দাম হিসেবে কৃষককে ঋণ দেয়া হলে অনেকাংশে লোকসান কমানো সম্ভব হবে। যা হবে কৃষি ও কৃষকদের জন্য ভালো খবর।

বাজেটে এবার কৃষি খাতকে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে। এর শুরুটা হতে পারে ধান চাল মজুতে সরকারি সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ দিয়ে। কেননা, গত এক দশকে অন্যান্য খাতের তুলনায় সেভাবে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। বরং কমেছে। সাম্প্রতিক কালের বাজেটগুলো হয়ে গেছে অনেকটা ব্যবসাবান্ধব বাজেট। অথচ, এক সময় সবেচেয়ে বেশি বরাদ্দ থাকত কৃষি খাতে। থাকত অনেক বেশি পরিমাণে ভূর্তকিও। এক্ষেত্রে কৃষকদের বিষয়টি আলাদাভাবে মাথায় রেখে এবার ভূর্তকির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া কৃষির গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি গবেষণা খাতেও রাখতে হবে পর্যাপ্ত বরাদ্দ। কৃষি কর্মকর্তাদের গবেষণায় আগ্রহী করতে হবে। ভালো লাগার খবর হলো আমাদের কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণায় অনেক সাফল্য রয়েছে।

বাজেট বাড়িয়ে বা ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধি করলেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে তা কিন্তু নয়। এর জন্য সরকারের অধিক তদারকির পাশাপাশি কৃষি মন্ত্রণালয়কে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

সরকারিভাবে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ফসল ক্রয় করার সুযোগ সৃষ্টিসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি এ বিষয়ে আরও কঠোরভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরি। এর পাশাপাশি নিয়মিত কৃষকদের সঙ্গে পরামর্শমূলক দিকনির্দেশনা বা আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। বিশেষ করে প্রান্তিক কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে সরকারের সেই বার্তা। এতে অন্তত কৃষকরা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবেন। তবে দীর্ঘ পথচলায় এখন কৃষিকে কেবল কৃষকের ব্যক্তি উদ্যোগ হিসেবে নয়, বরং শিল্প হিসেবে ভাবার সময় এসেছে। তাই এ ব্যাপারে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে কৃষি খাতকে। অগ্রাধিকার দিতে হবে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে। যাতে কৃষকরা তাদের ন্যায্যমূল্য পান। আর এসব বিষয়গুলো এবার বাজেটে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে তুলে আনতে হবে। অবশ্য শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না। অর্থ যেন প্রয়োজন অনুযায়ী খরচ করা হয় সেটিও দেখতে হবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এটা নিশ্চিত করতে হবে। তবে এর সুফল পাওয়া সম্ভব হবে।

সাহাদাৎ রানা :সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে