রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র প্রার্থী

দেশের মানুষ এখন আর বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তাই এর পরিবর্তন আনা জরুরি। দলীয় রোষানলে পড়ার ভয়ে সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যে এখন নিরপেক্ষ হতে পারছে না। তাই মানুষের অবাধ গণতন্ত্র চর্চার জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে গোপনীয়তার বিষয়টি সঠিকভাবে বজায় রাখতে হবে। সুতরাং, এক শতাংশ স্বাক্ষরের বিষয়টি বাদ দেওয়াটা জরুরি।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র প্রার্থী

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের বিপরীতে মোট ২৯টি দলের ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে ১৯৮৫ জন প্রার্থীকে বৈধ এবং ৭৩১ জন প্রার্থীকে বাতিল ঘোষণা করেছে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এর মধ্যে অবশ্য ৫৬ জন প্রার্থী ফিরে পেয়েছেন প্রার্থিতা। এবারের নির্বাচনে নিবন্ধিত ২৯টি দলের ১ হাজার ৯৬৬ জন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। তবে এবারের নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোয়নপত্র জমা পড়ে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৭৪৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জমা দিয়েছেন মনোনয়নপত্র।

\হ৭৩১ জন প্রার্থীর মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণা করেছে রিটার্নিং কর্মকর্তারা। এই বাতিল হওয়া প্রার্থীর মধ্যে দু'একজন বাদে বাকিরা স্বতন্ত্র। বাদ বা বাতিল হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার মূল কারণ হলো, এর সঙ্গে ১ (এক) শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর না থাকা। এই নিয়মটা কতটা যৌক্তিক। তা একটু ভেবে দেখা প্রয়োজন। কারণ এবারের নির্বাচনে নিবন্ধিত ২৯টি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। দল অনুসারে প্রার্থীর সংখ্যা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি মোট ৩০০ আসনে ৩০৪ জন করে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। জাকের পার্টি ২১৮ জন এবং তৃণমূল বিএনপি ১৫১ প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে। অন্য দল থেকে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১৪২ প্রার্থী এবং বাংলাদেশ কংগ্রেস থেকে ১১৬ প্রার্থী মনোনয়ন পেয়েছেন। জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) থেকে ২০ জন, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল থেকে ৬ জন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ থেকে ৩৪ জন, গণতন্ত্রী পার্টি থেকে ১২ জন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি থেকে ৬ জন, ওয়ার্কার্স পার্টি অব বাংলাদেশ থেকে ৩৩ জন, বিকল্পধারা বাংলাদেশ থেকে ১৪ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (ইনু) থেকে ৯১ জন, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন থেকে ৪৭ জন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন থেকে ১৪ জন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ থেকে ২ জন, গণফোরাম থেকে ৯ জন, গণফ্রন্ট থেকে ২৫ জন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মুকিত) থেকে ১৩ জন, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ থেকে ৩৯ জন, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি থেকে ১৮ জন, ইসলামী ঐক্যজোট থেকে ৪৫ জন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট থেকে ৩৭ জন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (পাঞ্জা) থেকে ৫ জন, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট থেকে ৭৪ জন, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট থেকে ৫৫ জন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে ৪৯ জন। স্বতন্ত্র ৭৪৭ জনের মধ্যে ৫৭ শতাংশের মনোয়নপত্র বাতিল হয়েছে। কারণ তাদের দাখিলকৃত নির্বাচনী এলাকার এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর না থাকা। উপরোলিস্নখিত যে দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এবং দলগুলোর যে যে এলাকায় প্রার্থী দিয়েছে তারা কী প্রত্যেকেই নিজ নিজ নির্বাচনী এলকার ১ শতাংশ ভোট পাবেন? যদি না পায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নিয়ম আছে? গত ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে মোট ভোটারের কত শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৫, ১৮, ১৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ড এবং ঢাকা সেনানিবাস এলাকা নিয়ে গঠিত এই আসনে ভোট কেন্দ্র আছে ১২৫টি এবং ভোটার ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের পর এই আসনটির নতুন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন নৌকা প্রতীকে মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তিনি পেয়েছেন ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী একতারা প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম যিনি হিরো আলম নামে পরিচিত তিনি পেয়েছেন ৫ হাজার ৬০৯ ভোট। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ১১.৫১ শতাংশের মতো। এই নির্বাচনে সর্বমোট ভোট পড়েছে ৩৭ হাজার ৪২০টি। এর মধ্যে ৩৮৩টি ভোট বাতিল বলে ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচিত প্রার্থী মোট ভোটারের ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন মোট ভোটারের ১ দশমিক ৭২ শতাংশ ভোট। ভোট কত শতাংশ ভোট পড়লে নির্বাচনটা বৈধতা পাবে তার কোনো সঠিক নির্দেশনা আছে কি? যদি না থাকে তাহলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর বেলায় বেঁধে দেওয়া নিয়মটাও যৌক্তিক না।

1

আরেকটি বিষয় প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গোপন ব্যালটে। তাই একজন ভোটার কে কাকে ভোট দিল তা জানার কোনো উপায় নেই, যদি নির্বাচন কমিশন তার গোপনীয়তা বজায় রাখে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য অগ্রিম ভোটারদের ভোট দিতে হচ্ছে। তাই এই এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরটা গোপনীয়তা বজায় রাখার পরিপন্থি একটি বিষয়। কারণ যিনি প্রার্থী হবেন আর নিয়ম যদি থাকে এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরের তাহলে এই স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য প্রার্থী হতে হলে ভোটারের দ্বারে দ্বারে যেতে হবে প্রার্থীকে এবং ভোটারের সমর্থনও পেতে হবে। অপরদিকে, যে ভোটারটি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য স্বাক্ষর দিলেন তিনি প্রকাশ্যে একজনের পক্ষ নিয়ে নিলেন। স্বতন্ত্র মানে নির্দলীয় বা নিরপেক্ষ প্রার্থী আর এই নির্দলীয় হওয়ার জন্য যে ভোটার তাকে সমর্থন করে স্বাক্ষর করলেন, সেই ভোটারকে দলীয় নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়তে হবে। বাংলাদেশে কেয়ারটেকার সরকার বানানোর কথা উঠলে, রাজনৈতিক নেতারা বলেন, নিরপেক্ষ ব্যক্তি বলে বাংলাদেশে কোনো মানুষ নেই। এক সময় বিএনপির শীর্ষ নেতাও বলেছিলেন, নিরপেক্ষ বলতে পাগল আর শিশুদের বুঝায়। অথচ এই সমস্ত কথার পর কী করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর রাখাটা বাধ্যতামূলক করা হলো। ধরা যাক, ঢাকা-১৭ আসনেই একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলে তাকে স্বাক্ষর লাগবে প্রায় ৩ হাজার ২ শত ৫২ জন ভোটারের। এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন দলীয় ব্যানারে ১ হাজার ৯ শত ৬৬ জন প্রার্থী। এই প্রার্থীদের মধ্যে শতকরা ৬০ শতাংশ প্রার্থী তার নির্বাচনী এলাকায় যে পরিমাণে ভোট পাবেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায়, তা ওই নির্বাচনী এলাকার মোট ভোটারের এক শতাংশের অনেক কম হবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সিপিবির প্রার্থী এনামুল হক রাজশাহী-২ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মোট ভোট পেয়েছিলেন ৩০০ (তিন শত) এর কম। এই আসনটিতে তখন ভোটার ছিল প্রায় তিন লাখের বেশি। এটা মোট ভোটারের কত শতাংশে পড়ে? এই এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর এটা দেশের নির্বাচনী গণতান্ত্রিক ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই মনে হয়। ভোট প্রতিটি ব্যক্তির অধিকারের বিষয়। মানবাধিকার সনদে স্পষ্টত উলেস্নখ আছে, প্রতিটি ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত বিষয়টি গোপন রাখার অধিকার সংরক্ষণ করতে পারবে। তাহলে স্বাক্ষরের বিষয়টি গোপনীয়তাটা বজায় রাখছে না। তাই এই নিয়মটি মানবাধিকারকে ক্ষুণ্ন করে। আর মানবাধিকারকে ক্ষুণ্ন করা বিষয়টি দিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্রের কথা ভাবা যায় না। এবারের নির্বাচনে মোট প্রার্থীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ হলো স্বতন্ত্র প্রার্থী। অর্থাৎ মোট প্রার্থীর ৩৩ শতাংশই স্বতন্ত্র। যদি এক শতাংশ বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয় তাহলে ৩৩ শতাংশ বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র আনতে হলে নিরপেক্ষ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা বাড়াতে হবে।

দেশের মানুষ এখন আর বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। তাই এর পরিবর্তন আনা জরুরি। দলীয় রোষানলে পড়ার ভয়ে সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যে এখন নিরপেক্ষ হতে পারছে না। তাই মানুষের অবাধ গণতন্ত্র চর্চার জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে গোপনীয়তার বিষয়টি সঠিকভাবে বজায় রাখতে হবে। সুতরাং, এক শতাংশ স্বাক্ষরের বিষয়টি বাদ দেওয়াটা জরুরি।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে