মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

গুজব ও দুর্ভাবনা

দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তারা ভোট কেন্দ্রে যাবে এবং নিজ পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবে। তাই সর্বপ্রকার প্রোপাগান্ডা ও অপপ্রচার রোধ করতে কমিশনকে আরও কঠোর হতে হবে।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
গুজব ও দুর্ভাবনা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা এখন তুঙ্গে। এই নির্বাচনকে ঘিরে জনমনে রয়েছে নানা ধরনের শঙ্কা, ভাবনা ও দুর্ভাবনা। জনগণের মনের অবস্থা বিবেচনা করে জেতার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে ছড়াচ্ছে নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা ও গুজব। প্রোপাগান্ডা ও গুজব বিষয়টি কি, তা জানা জরুরি। প্রোপাগান্ডা একটি ইংরেজি শব্দ। প্রোপাগান্ডা শব্দটি উৎপত্তিগতভাবে নিরপেক্ষ ছিল। আসলে উৎপত্তিকালে শব্দটি দিয়ে প্রচারণার কাজকে বুঝাত। বিংশ শতাব্দীতে এই প্রোপাগান্ডা শব্দটি সব প্রাশ্চাত্যের দেশ জুড়ে নেতিবাচক অর্থ ধারণ করে প্রচারিত হয়। এখন প্রোপাগান্ডা শব্দটি অর্থ দাঁড়িয়েছে ভুল এবং অপপ্রচার। কারো বিরুদ্ধে সমষ্টিগত মিথ্যাচার হলো এখন প্রোপাগান্ডার মূল কাজ। হিটলারের নাৎসী বাহিনীর ছিল পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট ও প্রোপাগান্ডা মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়টির কাজ ছিল মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করা। বিশ্বের এক হাজারের বেশি রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ভুল ও মিথ্যা তথ্য প্রচার করে এই মন্ত্রণালয়টি। যদিও এই প্রোপাগান্ডার শেষ রক্ষা হয়নি নাৎসী বাহিনীর। তবে এই প্রোপাগান্ডার কোপানলে পড়ে জীবন দিতে হয়েছে বহু সাধারণ মানুষকে। তবে পুঁজিবাদী দুনিয়ায় মুনাফা লুটার জন্য বাণিজ্যিক প্রচারে বা সমতুল্য বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে এই প্রোপাগান্ডা শব্দটির অর্থ সাধারণ শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অপরদিকে, গুজব হলো, লোক মুখে প্রচার হওয়া কিছু শব্দ বা ব্যাখ্যা। যার প্রচারিত হয় সত্যতা যাচাই ছাড়া। গুজব নানা প্রকারের হতে পারে। অতীতের কোনো ঘটনাকে নানাভাবে মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে প্রচার করা হয়, আবার ভবিষ্যতে কি ঘটতে পারে তাও নানা রঙচঙ মাখিয়ে প্রচার করা হয়। সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায়, 'গুজব হলো এমন একটি বিবৃতি যার সত্যতা অল্প সময়ের মধ্যে অথবা কখনোই যাচাই করা যায় না।' যদিও তা যাচাই করা হয় কোনোভাবে- তবে তার আর প্রতিকারের সময়ও থাকে না। তাই গুজবকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় : কিতাবি ভাষায় তা হলো, অতীতের ঘটনাকে নিয়ে প্রচারিত গুজবকে ভুতাপেক্ষ গুজব আর ভবিষ্যৎ ঘটনাকে নিয়ে প্রচারিত গুজবকে ভবিষ্যাপেক্ষ গুজব বলা হয়। বর্তমান দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দুই প্রকারেই গুজবকে নিপুণভাবে প্রচার করা হচ্ছে। রাজনীতিতে বরাবরই গুজব একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। বর্তমান নির্বাচনে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াত অংশ নিতে পারছে না, তাদের অন্যতম শরিক অর্থাৎ তাদের যে দলটি নেতৃত্ব দেয় সেই বিএনপিও নির্বাচনের বাইরে। এরা এই নির্বাচনকে ঘিরে এক ধরনের প্রোপাগান্ডা বা গুজব ছড়াচ্ছে। তাদের মতে বিদেশিরা এই নির্বাচন মেনে নেবে না। তাই সরকার নির্বাচন করতে পারবে না। এরা পশ্চিমা বিশ্বকে পুঁজি করে তাদের প্রোপাগান্ডা বা গুজবের তথ্যাদি প্রচার করছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই নির্বাচনকে ঘিরে যৎসামান্য নেতিবাচক বলে, তাকে এরা পাহাড় তুল্য করে জনসম্মুখ্যে প্রচার করার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের কিছু মানুষের ভারত সম্পর্কে এলার্জি রয়েছে। তাই জামায়াত-বিএনপি ভারতকে বর্তমান সরকারের সমর্থক হিসেবে নানাভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতা স্বপক্ষের কিছু রাজনৈতিক দল ভিন্ন পস্নাট ফরমে যুক্ত হয়ে করেছে নির্বাচন বয়কট। তাদের প্রচারকৃত গুজব ও প্রোপাগান্ডার ধরন একটু ভিন্ন। তারা আবার পশ্চিমাদের আর্দশিকভাবে পছন্দ করে না। তবে পরোক্ষভাবে এদের রাজনৈতিক কাজকর্ম জামায়াত-বিএনপির মতোই হয়ে যাচ্ছে। এদের ভাষায় এরা তদারকি সরকারের দাবিতে এবং স্বৈরশাসক হাসিনার বিরুদ্ধে লড়ছে। যদি কোনো কারণে এই সরকারের পতন হয়, তবে পতনের ফলে উদ্ভূত রাজনৈতিক ফসল এদের কপালে জুটবে না, ফসলটা যাবে জামায়াত-বিএনপির ঘরে।

নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা এখন তুঙ্গে। গত ২০১৮ সালের চেয়ে অধিক সংখ্যক প্রার্থী এবারের নির্বাচনী মাঠে। নির্বাচনে জনমনে এটা সংশয় তা হলো ভোটারবিহীন নির্বাচন হবে কি না। আবার প্রচার করা হচ্ছে ভোটারবিহীন বা ভোটারা ভোট দিলেও ভোট কাজে লাগবে না। এই তথ্যটি প্রচার করছেন যারা নৌকা পেয়ে হেরে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। যে সব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে সেই সব আসনের নৌকার প্রার্থীর কর্মীসমর্থকরা নানা গুজব রটাচ্ছে; যেমন রাজশাহী-২ আসনের নৌকা প্রার্থীর কর্মীসমর্থকরা বলছেন, শেখ হাসিনা চায় বাদশা জিতুক। শেখ হাসিনা থাকলে বাদশাও সংসদে থাকবে (উলেস্নখ্য, এটা নৌকা প্রতীকের বাদশা, তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নামও বাদশা যিনি পেয়েছেন কাচি প্রতীক, কাচির জেতার সম্ভাবনা ১০০ ভাগ)। তাই ভোটারদেরকে এবং নির্বাচনী মাঠকে বিভ্রান্ত করতে তাদের এই প্রোপাগান্ডা ও গুজব। তাদের ভাষায় এবারের নির্বাচনেও ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হবে। তাই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নৌকার বাদশাকে জিতিয়ে নিবেন। রাজশাহী-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শফিকুর রহমানের স্বপক্ষে রাজশাহী মহানগরের গণজোয়ার বইছে। এই গণজোয়ার ঠেকানোর জন্য নৌকার কর্মীসমর্থকরা তাদের প্রার্থীকে সরকারি প্রার্থী হিসেবে প্রচার করছে এবং বলে বেড়াচ্ছে তাদের পক্ষে প্রশাসন থাকবে এমন কথাও। ফলে এই আসনের সাধারণ ভোটার পড়ছে বিভ্রান্তিতে। অনুরূপ ঘটনা ঘটছে ময়মনসিংহ-১১ আসনেও। এই আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন এম এ ওয়াহেদ। তিনি দানবীর, বিশিষ্ট সমাজসেবক তার পক্ষে এলাকা জুড়ে গণজোয়ার চলছে। তাই তাকে ঠেকাতে নানা কায়দায় অপপ্রচার করছে নৌকার প্রার্থীর কর্মীসমর্থকরা। রাজশাহী-১ আসনে চিত্র নায়িকা মাহিয়া মাহীর প্রচারণা ইউটিবে ব্যাপক। তার এই ব্যাপক প্রচারণার মাঝে নেট দুনিয়ায় ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে তার ব্যক্তিগত জীবনের কিছু ঘটনা। এগুলোর মধ্যে তার বিবাহ সংক্রান্ত বিষয় ও আচরণিক কিছু কথাবার্তা। তাছাড়া তাকে শুনতে হচ্ছে নারী হওয়ার জন্য কিছু কুরুচিপুর্ণ কথাবার্তা। এতদ্‌সম্পর্কিত বিষয়গুলো নির্বাচনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, কিন্তু তারপরও তাকে নিয়ে এ ধরনের কথাবার্তা বলা কতটা যৌক্তিক। অপরদিকে, মানিকগঞ্জের প্রার্থী ফোক সম্রাজ্ঞী মমতাজও নেট জগতে ভাইরাল। তাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ তথ্য প্রচার করা হচ্ছে বিশেষ করে তার বিবাহের সংখ্যা নিয়ে। প্রশ্ন হলো, এই নির্বাচনে বহু পুরুষ প্রার্থী আছেন যাদের একাধিক বিবাহ, বউ তালাকসহ বহু নারীতে গমন এ ধরেন তথ্যও আছে, কিন্তু তাদেরটা এত ভাইরাল মুখরোচক হচ্ছে না। এবারের নির্বাচনে উলেস্নখ করার মতো তিনজন তারকা ভোট যুদ্ধে লড়ছেন, তারা হলো চিত্র নায়ক ফেরদৌস, ফোক সম্রাজ্ঞী মমতাজ ও মাহিয়া মাহী। এই তিনজনকে উলেস্নখ করার কারণ হলো, জৈবিক আচরণের বিষয়গুলো যেভাবে মাহিয়া মাহী ও ফোক সম্রাজ্ঞী মমতাজেরটা মুখরোচক হচ্ছে, ফেরদৌসেরটা কিন্তু সেভাবে প্রচারে আসছে না। এতে প্রমাণ হয়, দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা এখনো নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। দেশের সরকার পরিচালনায় গত ত্রিশ বছর ধরে নারীরা নেতৃত্ব প্রদান করে আসছেন। তারপরও দুঃখের বিষয় এখনো রাজনীতির মাঠ নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি।

নারীরা রাজনীতির মাঠে আসলেই তাদের চরিত্র হরণ করা হয়, জৈবিকতাকে মুখ্য করে- যা অত্যন্ত নোংরা ও হীনকর কাজ। অথচ পুরুষেরা কত জঘন্য হীন থেকে হীনতর জৈবিক অপকর্ম করে রাজনীতির মাঠে দাপিয়ে বেড়ায়, তাদের নিয়ে কোনো কথা হয় না। এটি মানবিক সমাজ গঠনের মারাত্মক অন্তরায়। এ ধরনের প্রোপাগান্ডা নির্মূল করা জরুরি।

দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তারা ভোট কেন্দ্রে যাবে এবং নিজ পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবে। তাই সর্বপ্রকার প্রোপাগান্ডা ও অপপ্রচার রোধ করতে কমিশনকে আরও কঠোর হতে হবে।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে