সাম্প্রতিক সময় বেশ কয়েকটি হৃদয়বিদারক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যেকটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা কেড়ে নিয়েছে কারও প্রিয়জনকে, ধূলিসাৎ করেছে কারও সারাজীবনে গড়ে তোলা সম্পদকে। এর মধ্যে সর্বশেষ যোগ হলো চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত এস আলম রিফাইনারি সুগার মিল। যেখানে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমদানি করা ভোগপণ্য চিনি যেমন অগ্নিপিন্ডে পরিণত হয়েছে, তেমনি কেমিক্যাল ও রাসায়নিক পদার্থ নালা হয়ে বিভিন্ন খালে ও নদীতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করবে।
কর্ণফুলী নদী থেকে ৪০০ মিটার দূরে অবস্থিত এস আলম সুগার মিল ফ্যাক্টরি। গত ৪ মার্চ অগ্নিকান্ডের ঘটনার ১৬ ঘণ্টা পরও সেনাবাহিনীর বিশেষ দল, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি দলের সাহায্যেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। যা ফলে একটি গুদামে অবস্থিত এক লাখ মেট্রিক টন কেমিক্যালজাত ও দাহ্য পদার্থ চিনি আগ্নিগিরিতে পরিণত হয়েছে। যার বাজার মূল্য ৭০০-৮০০ কোটি টাকা। যা বিভিন্ন দেশ থেকে অপরিশোধিত আকারে আমদানি করা হয়েছে। পরিশোধিত করে রমজানে যা বাজারে সরবরাহ করার কথা ছিল। এস আলম কোম্পানি সারাদেশে ১০ শতাংশের মতো বাজারে চিনি সরবরাহ করে থাকে। এই কোম্পানির আরও পাঁচ লাখ মেট্রিক টন চিনি রিফাইনারি করতে না পারলে বাজারে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের বাজারে সিন্ডিকেট ও কালোবাজারিতে এমনিতে টইটম্বুর। তারা উপায় খুঁজে, কীভাবে পণ্যের দাম বাড়ানো যায়। ফলপ্রসূতে চিনির বাজারে আগুন ধরবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
এমন অগ্নিকান্ড যেমন বয়ে আনে মানসিক, সবল জীবন-প্রবাহ ও আর্থিক বিপর্যয়, তেমনি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে পরিবেশের ওপর। যা সর্বোপরি মানুষের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমন ঘটনায় কেউ হারাচ্ছে তার প্রিয়জনকে, কেউ হারাচ্ছে তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন চাকরিটি, কেউ বা জীবনের সহজ-সরল গতিটি আর ফিরে পায় না। তাহলে এত সংকটাপন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়েও আমরা কেন সতর্ক হই না? আমরা কেন বুঝি না, কারখানা চলাচলের আগে প্রয়োজন কারখানার নিরাপত্তা?
এক সমীক্ষা থেকে দেখে যায়, গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামে ৯১১টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ফলপ্রসূতে ৬৫ জন মানুষ মারা যায় ও ২০০ জনের বেশি মানুষ অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়। এমন অগ্নিকান্ড পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে। ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ কর্ণফুলী নদীতে পড়ার কারণে ৬০ ধরনের জীববৈচিত্র্যে প্রভাব লক্ষ্য করা গেল। যার ফলে অনেক মাছের আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে গেলে, রাতারাতি দেশের বাজারে এর প্রভাব ফেলে, কিন্তু বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে পণ্যের দাম কমায় না। যার ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় না। বরং দিন দিন নানা কারণে ক্রয়ক্ষমতা কমেই যাচ্ছে। ফলে মানুষকে সংকটাপন্ন পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির জন্য ডলার সংকট ও এর বাড়তি দাম, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট ও উচ্চ শুল্ক আগে থেকে দায়ী থাকলেও এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে অগ্নিকান্ড। বর্তমানে অর্থনীতি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নেই।
প্রতি কেজি চিনি আমদানি করতে শুল্ক দিতে হচ্ছে ৪৩ টাকা। যার ফলে, ভারতে ৪৩ রুপিতে চিনি পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে এর দাম বেড়েই চলছে। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকলেও, মূল কারণ হচ্ছে ্ত- পথে পথে চাঁদাবাজি, উচ্চ শুল্ক ও অগ্নিকান্ডের মতো সিন্ডিকেটদের সুবিধাজনক অবস্থা। বাজারে একচেটিয়া সিন্ডিকেটদের আধিপত্য ভাঙতে না পারলে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েই চলবে। ফলপ্রসূতে জনমানুষের দুর্ভোগ- উৎকণ্ঠা বেড়েই চলবে।
অর্থনীতিতে ডলার সংকট নিরসন ও শুল্ক কমানো কঠিন হলেও, চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট বন্ধ তুলনামূলক সহজ। এর সঙ্গে অগ্নিকান্ডের মতো ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমে আসবে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাবে। প্রান্তিক মানুষের একটু হলেও কষ্ট লাগব হবে এবং অর্থনীতি তার সাম্যাবস্থা ফিরে আসবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জনমানুৃষের কষ্ট লাগব করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসতে হবে।