সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কার্ল মার্কস ও শ্রেণিসংগ্রাম

এস ডি সুব্রত, সুনামগঞ্জ
  ১২ মে ২০২৪, ০০:০০
কার্ল মার্কস ও শ্রেণিসংগ্রাম
কার্ল মার্কস ও শ্রেণিসংগ্রাম

কার্ল মার্কস ইতিহাসের যে বস্তুতান্ত্রিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা ইতিহাসের বিকাশ ও বিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করেন, ইতিহাস তথা মানবজীবনের যাবতীয় ঘটনা একমাত্র অর্থনৈতিক বিচার-বিবেচনার দ্বারা পরিচালিত হয়। ইতিহাসের ঘটনাবলিকে নৈতিক, আধ্যাত্মিক বা যে কোনো কারণের অভিব্যক্তি বলে বর্ণনা করা হোক না কেন সেগুলো আদতে অর্থনৈতিক বিচার-বিবেচনা থেকে উৎসারিত। তার মতে, সামাজিক উৎপাদনের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন সম্পর্কের যোগফল নিয়েই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো গঠিত হয়। এই ভিত্তির ওপর আইনগত এবং রাজনৈতিক অধি-কাঠামোসমূহ প্রতিষ্ঠিত এবং সামাজিক চেতনার বিভিন্ন প্রকাশ এই ভিত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। কার্ল মার্কসের চিন্তাধারার মূল ভিত্তি ছিল ইতিহাস সম্পর্কে তার ধারণা। আমাদের দেশ এবং বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে ইতিহাস সম্পর্কে তার ধারণা বা চিন্তাধারা ছিল জীবন্ত এক অভিজ্ঞতা আর সেটা হলো মানবজাতির অতীতের সমগ্র অভিজ্ঞতা থেকে কীভাবে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি এবং মানবসমাজের গতিধারার প্রবণতা সম্পর্কে বোঝাপড়াকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হতে পারি। আধুনিক ইতিহাসবিদ ও প্রখ্যাত তত্ত্ববিদরা যেভাবে তাত্ত্বিক বিষয়ে নিশ্চিত হন ঠিক সেভাবেই মার্কসও এগিয়েছেন।

মার্কস বলেন, 'যেমন একজনকে বিচার করা যায় না সেই ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে কী ভাবেন তা দ্বারা, ঠিক তেমনই অতীতের পরিবর্তনের সময়টাকে সেই সময়কার চেতনা দিয়ে আমরা বিচার করতে পারি না।' দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো, মানব ইতিহাসের বিশ্বজনীন সাধারণ ব্যাখ্যার সঙ্গে কোনো দেশের বা অঞ্চলের নিজস্ব ইতিহাসের বর্ণনা মিলিয়ে দেখা। ইতিহাসের বিশ্বজনীন ব্যাখ্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশ বা অঞ্চলের ইতিহাসের নিরন্তর আদান-প্রদানই আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে এক সঠিক বোঝাপড়ায় পৌঁছাতে সাহায্য করবে যা ইতিপূর্বে অতীত ইতিহাসে অস্বীকৃত ছিল। এমনকি খ্রি. পূ. ৫ম শতাব্দীর হেরোডোটাসের তথ্যানুসন্ধানের ব্যাপকতা বা চতুর্দশ শতাব্দীর ইবনে খালদুনের মতো নিখুঁত মনের ঐতিহাসিকের কাজেও এই অস্বীকৃতি দেখা যায়।

1

মার্কসের ইতিহাস সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি এসেছে যতটা তিনি জানতে পেরেছেন তার বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতার নিষ্কাশনের মধ্য দিয়ে। আধুনিক যুগের দার্শনিকরা বিশেষত হেগেল, যেভাবে অতীতকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক আলোকে বিশ্লেষণ বা উন্মোচন করে জ্ঞানের যে সমন্বয় করেছেন মার্কস তাকে অনুসরণ করেছেন এবং প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে তার নির্যাস তিনি তুলে এনেছেন। যে কোনো ইতিহাস পাঠ করার ক্ষেত্রে এই নির্যাস এক সুসংহত কাঠামো হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। সর্বপ্রথমে মার্কস মনে করেন মানুষের সামাজিক সংগঠনে কাজ করার মূল বৈশিষ্ট্য হলো যে সে তার বস্তুগত চাহিদা পূরণ করার জন্য সদাসর্বদা চেষ্টা চালায়। তার এই অভাব বা চাহিদা পূরণ হয় উৎপাদনের দ্বারা। এবং উৎপাদন করা তখনই কেবলমাত্র সম্ভব যদি নারী ও পুরুষ কোনো সমাজে বাস করে। মার্কস বলেছেন : 'মানুষের বস্তুজীবনে উৎপাদন মানুষের সামাজিক রাজনৈতিক এবং বৌদ্ধিক জীবনের স্বাভাবিক পদ্ধতিকে নির্ধারণ করে।' মার্কসবাদের মূল ভিত্তি হলো এই ধারণা এবং এই কারণে ইতিহাসের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা হয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ভাববাদী দার্শনিকদের কাছে ইতিহাস ভাব বা স্বর্গীয় অধ্যাদেশ বলে মনে হয়েছে অথবা আরও নিম্নস্তরের কাছে ইতিহাস পরিগণিত হয়েছে সহজাত ধর্মীয় অথবা জাতীয় অধ্যাদেশ হিসেবে। মার্কসবাদ এই দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণবিরোধী। পরবর্তীকালে মার্কস মানুষের ইতিহাস-পূর্ব জীবনের অস্তিত্বকে চিহ্নিত করেন। তখন মানুষ উৎপাদন করত না। তারা শিকার, মাছধরা, ফল সংগ্রহ ইত্যাদির মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহ করত। মানুষ তখন ছিল প্রাগৈতিহাসিক এক শ্রেণিহীন সমাজে এক গোষ্ঠী হিসেবে। কিন্তু সেই মায়া কৃষিকার্য শুরু হলো, সে 'উদ্বৃত্ত' অথবা 'উৎপাদকের বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন তার তুলনায় সে বেশি উৎপাদন' করতে শুরু করল। সমাজ তখন দু্থটি ভাগে বিভক্ত হলো- একদল যারা উৎপাদন করে এবং অন্যদল যারা উৎপাদনকারীকে উদ্বৃত্ত উৎপাদন ত্যাগ করতে বাধ্য করে। দ্বিতীয় দল বলপ্রয়োগ করে তাদের এই অবস্থান অর্জন করে এবং এর ফলে রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি মালিকানার প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ওঠে। মানুষ দাসের মতো মালিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। একই রকমভাবে জমিও ব্যক্তি মালিকানায় চলে আসে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বস্তুগত চাহিদা পূরণের জন্য মানুষের প্রচেষ্টা শ্রমজীবী মানুষের শ্রমে উৎপন্ন উদ্বৃত্ত দখল করার সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। এই শ্রমজীবী মানুষ মূলত শ্রমিক এবং কৃষক। মানুষের সমাজও শোষণের সমাজে পরিণত হয় এবং তাই মার্কস ও এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে যথার্থই বলেন 'সমাজের এতদিনকার প্রচলিত ইতিহাস হলো শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস।' মার্কস মনে করেন যে, নিয়ম কখনোই পালটায় না তা হলো এই যে সবকিছুই পরিবর্তনশীল। উত্তরোত্তর এই পরিবর্তনশীলতা এমন সার্বিক পরিবর্তন সূচিত করে যে, মানুষের ইতিহাস কতগুলো বিচ্ছিন্ন সামাজিক রূপের পরম্পরা বলে মনে হয়। তবে কিভাবে উৎপাদন সংগঠিত হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিটি সামাজিক রূপ বা গঠন। সামাজিক গঠনের এই ভিত্তিকেই মার্কস বলেছেন উৎপাদন সম্পর্ক। এই উৎপাদন সম্পর্কের সীমারেখা তৈরি হয় 'উৎপাদনের উপায়' অর্থাৎ সেই সময় প্রচলিত যন্ত্রপাতি এবং উৎপাদন প্রকৌশল দ্বারা।

সমাজ সংগঠনের এই যে পরিবর্তনের পরম্পরা- এর পেছনে কারণ কিছু স্পষ্টতই অন্ধ প্রাকৃতিক শক্তি নয় এবং স্পষ্টতই শ্রেণিসংগ্রাম যা মানুষ প্রতিনিয়ত করেছে। যেখানেই মানুষ কোনো কর্মপ্রক্রিয়া গ্রহণ করুক, সেই কর্মপ্রক্রিয়ার পেছনে থাকে তার স্বেচ্ছাকৃত চিন্তাভাবনা অথবা 'চেতনা' এবং কর্মপ্রক্রিয়ার চালিকাশক্তিই হলো এই চেতনা।

চেতনার এই মুক্তি যন্ত্রপাতি, আধুনিক প্রযুক্তি, অর্থনীতি প্রভৃতির মতো বস্তুগত উপাদানের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো যে সম্ভাবনা তৈরি করে তার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং তা সম্ভব হয় শ্রেণিশোষণের অবলুপ্তি এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। মার্কসবাদ অথবা বৈজ্ঞানিক সমাজবাদ মুক্তিপ্রাপ্ত চেতনার চূড়া তৈরি করে এবং শ্রমিকশ্রেণি তার লড়াই সংগ্রামের দ্বারা আসন্ন নতুন ধারার অগ্রদূত হয়ে ওঠে। কিন্তু এক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণিকে নিজেকে সচেতন হতে হবে এবং বাস্তব পরিস্থিতি যে নতুন সম্ভাবনাকে সফল করে তুলতে পারে তা লাভ করার আগে শ্রমিকশ্রেণিকে তার নিজের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে