সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

একটি টেকসই সমুদ্র অর্থনীতির মূল উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে সঠিক মৎস্য আহরণ কৌশল অনুশীলন, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, সমুদ্র থেকে নবায়নযোগ্য শক্তির অনুসন্ধান ও ব্যবহার, টেকসই সামুদ্রিক পরিবহণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলোতে উপকূলীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তি।
সুমাইয়া আকতার
  ২০ জুন ২০২৪, ০০:০০
টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

বস্নম্ন ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি হলো অর্থনীতির এমন একটি বিষয়, যেখানে সুনীল অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো একটি দেশের সামুদ্রিক পরিবেশ কিংবা সামুদ্রিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে আলোচনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করা, দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করা, সামাজিক পুঁজি সৃষ্টি করা, আয় বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি পরিবেশে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করা। বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনীতির উপকরণগুলোর টেকসই উন্নয়নকে সমুন্নত করা এবং সামুদ্রিক সম্পদকে যথাযোগ্য ব্যবহার ও সরবরাহ করার মাধ্যমে ২০৪১ সালে বাংলাদেশ 'স্মার্ট বাংলাদেশে' রূপান্তরিত হওয়ায় এক ধাপ এগিয়ে থাকার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থনীতি সমুদ্র সম্পদকে স্থিতিশীলভাবে কাজে লাগাতে বলে, যা পরিবেশজনিত সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে; সমুদ্র থেকে সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার হবে এমনভাবে, যা সমুদ্রকে প্রাণবন্ত ও সুস্থ রাখতে সহায়তা করবে, এর ইকো-সিস্টেমের দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতার সঙ্গে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ভারসাম্য নিশ্চিত করবে। এ অর্থনীতির কেন্দ্র হচ্ছে মহাসাগর, সাগর ও উপকূল। বিশ্বব্যাংক সমুদ্র অর্থনীতিকে উপস্থাপন করেছে দু'দিক থেকে। সমুদ্র অর্থনীতি সাগর ও উপকূলীয় এলাকার সঙ্গে সম্পর্কিত আর্থিক বিষয়মাত্র নয়, বরং এর সঙ্গে যুক্ত আছে কার্বন সংরক্ষণ, উপকূলীয় প্রতিরক্ষা, সাংস্কৃৃতিক মূল্যবোধ এবং জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ। এসবের মধ্য দিয়ে জ্বালানি, জাহাজ চলাচল, মৎস্য শিকার, খনি থেকে সম্পদ আহরণ এবং পর্যটন ব্যবস্থাপনার একটি গতিশীল শৃঙ্খলা কামনা করে সমুদ্র অর্থনীতি।

বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার, যা দেশের আয়তনের প্রায় ৮২ শতাংশ। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের (পিসিএ) রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায়। ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। তারপর সমুদ্র অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে পারলাম আমরা? বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ বস্নম্ন ইকোনমি থেকে আসে। এটার পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৯৬০ কোটি ডলার। অথচ সমুদ্র থেকে শুধু মাছ রপ্তানি থেকেই ১০-১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। আগাছা, লতা, গুল্মতে ভরপুর দেশের সমুদ্র অঞ্চল। মৎস্যসম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণী, সামুদ্রিক আগাছা, লতা, গুল্মতেও ভরপুর বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে ৪টি মৎস্যক্ষেত্র। এখানে প্রায় ৪৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী, ২০০ প্রজাতির সামুদ্রিক ঘাস আছে বলে জানা যায়।

1

তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ও মোনাজাইটের মতো অতি মূল্যবান খনিজসম্পদসহ প্রায় ১৭ ধরনের খনিজ বালি আছে বলে ধারণা করেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া পস্নাটিনাম, ফসফরাস, সালফাইড, ইউরেনিয়াম, তামা, সিসাসহ আরও অজস্র খনিজ পদার্থ রয়েছে। সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণিজ সম্পদ রপ্তানি করে কয়েক বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ আয় করতে পারে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করা বে সরকারি প্রতিষ্ঠান সেফ আওয়ার সি'র তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্র থেকে মাছ ধরে শুধু বিদেশে রপ্তানি করে বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। এ ছাড়া মাছ থেকে খাবার, মাছের তেল দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ওষুধ, সস টিটেসিনান তৈরি করা সম্ভব, যা নতুন ধরনের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তা বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

মাছের বাইরেও বঙ্গোপসাগরের কিছু উদ্ভিদ এবং শামুক-ঝিনুকের চাহিদা রয়েছে দেশে ও বিদেশে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে শামুক, ঝিনুকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এছাড়া বিদেশেও এটা রপ্তানি হয়। ফলে বাংলাদেশে এটি প্রচলিত একটি খাবার না হলেও সমুদ্র থেকে এটাও আহরণ করা হয়।'

খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের উপস্থিতিরও যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। অনেক সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও প্রাণীতে বিভিন্ন ধরনের দুর্লভ পুষ্টি উপাদান রয়েছে। দৃশ্যমান জলাভূমি ও স্থলসীমায় বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদের মাধ্যমে ওই পুষ্টি উপাদানের চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব।

সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি সুস্বাস্থ্য এবং জীবনীশক্তি নিশ্চিত করে বিশ্বের সাগর-মহাসাগরগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য একটি চমৎকার উপায় টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি। সমুদ্র সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে সমুদ্র পর্যবেক্ষণ এবং অধ্যয়ন অপরিহার্য। একটি টেকসই বিশ্ব বিনির্মাণে স্থল ও সমুদ্রের মধ্যে সংযোগকে শক্তিশালী করতে সামুদ্রিক বিজ্ঞানকে মৌলিক গবেষণা এবং অনুশীলনের ক্ষেত্র হিসেবে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি বিশাল সামুদ্রিক অঞ্চলের অধিকারী। দেশের সুনীল অর্থনীতির মধ্যে মৎস্য, শিপিং, প্রতিবেশবান্ধব পর্যটন, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অন্তর্ভুক্ত।

সমুদ্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বঙ্গোপসাগরে আছে বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক আগাছা। এসব আগাছা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরি করা যায়। এসব আগাছার মধ্যে ইসপিরুলিনা সবচেয়ে মূল্যবান। চীন, জাপান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানুষ এগুলোকে খাদ্য হিসেবে খেয়ে থাকে। বাংলাদেশের জলসীমায় সমুদ্র থাকার বড় একটি সুবিধা হলো, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে লবণ উৎপাদন। উপকূলে সমুদ্রের পানি ধরে, রৌদ্র বা সৌরশক্তি ব্যবহার করে শুকিয়ে অপরিশোধিত লবণ আহরণ করা হয়।

বর্তমানে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের এক লাখ একরের বেশি জমিতে লবণ চাষ করা হয়। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ১৮ লাখের বেশি মানুষ।

এ ছাড়া বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণে বিশ্বে ১৩তম আর শিপরেকিংয়ে ৩য়। পৃথিবীর মোট জাহাজ ভাঙার ২৪.৮ শতাংশ বাংলাদেশে সম্পাদিত হয়। দেশের দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলকে এ শিল্পের জন্য পরিবেশবান্ধবভাবে কাজে লাগাতে পারলে জাতীয় অর্থনীতিতে তা আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫% প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ

প্রতিবছর বছর ২ কোটি ৩০ লাখ টন অনুমোদিত টেকসই সামুদ্রিক খাদ্য ১ হাজার ১৫০ কোটি ডলারের বিশ্বজুড়ে বিক্রি হয়, যা বৈশ্বিক উৎপাদনের ১৪%। বিশ্বে ১০-১২ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবিকার জন্য সামুদ্রিক খাদ্যশিল্পের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর ৩০% গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। বাণিজ্যিক পরিবহণের ৯০% সম্পন্ন হয় সমুদ্রপথে। ইউরোপের উপকূলীয় দেশগুলো অর্থনীতি থেকে প্রতিবছর বিলিয়ন ইউরো আয় করতে পারে, যা তাদের জিডিপির ১০ শতাংশ। প্রতিবছর সমুদ্রপথে ১৫০টিরও বেশি দেশের প্রায় ৫০ হাজারের ওপর বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে।

গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি, বাংলাদেশের বন্দরের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজসমূহের ফিডার পরিষেবা কার্যক্রম বাড়ানোর মাধ্যমে আমাদের বন্দরসমূহ কলম্ব, সিঙ্গাপুর বন্দরের মতো আরও গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হয়ে উঠতে পারে। বিশেষত চট্টগ্রাম কিংবা মাতারবাড়ীতে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ।

একটি টেকসই সমুদ্র অর্থনীতির মূল উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে সঠিক মৎস্য আহরণ কৌশল অনুশীলন, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, সমুদ্র থেকে নবায়নযোগ্য শক্তির অনুসন্ধান ও ব্যবহার, টেকসই সামুদ্রিক পরিবহণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলোতে উপকূলীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তি।

\হঅতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস, দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামুদ্রিক পরিবেশের হুমকি নির্মূলে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং সামুদ্রিক পরিবেশ এবং সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার সংরক্ষণে কার্যবিধির সংস্কার ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। দেশের সুনীল অর্থনীতির মধ্যে মৎস্য, শিপিং, প্রতিবেশবান্ধব পর্যটন, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অন্তর্ভুক্ত। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত না করে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য এই খাতে টেকসই উন্নয়ন অপরিহার্য।

সুমাইয়া আকতার : নবীন কলাম লেকক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে