শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দুর্নীতির বিপজ্জনক বিস্তার

আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির প্রভাবগুলো আমাদের দেশের সঠিক উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এবং দক্ষ শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে বড় বাধা। কারণ 'ঘুষ লেনদেন পরিবেশ কাঠামো' কর্মসংস্থান কাঠামোকে প্রভাবিত করছে। 'ঘুষ লেনদেন পরিবেশ কাঠামো'তে অদক্ষকর্মী বিভিন্ন পদে নিয়োগ পান। এটা দেশের উন্নয়নের জন্য বিপজ্জনক।
অভিজিৎ বড়ুয়া অভি
  ০৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
দুর্নীতির বিপজ্জনক বিস্তার
দুর্নীতির বিপজ্জনক বিস্তার

চারিদিক দুর্নীতিগ্রস্ত। বাজারে আলু ও পেঁয়াজ একশ' টাকা। পাঁচশ' টাকায় বাজার হয় না। সাধারণ মানুষ দিশেহারা। রাজনীতিবিদরা তামাশা করে। উন্নয়নের ঢেঁকুর তোলে। সব বিবেকহীন। অন্যদিকে, আমলা, প্রশাসন, মন্ত্রী, সামরিক বাহিনী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিক্ষক সর্বক্ষেত্রেই অবক্ষয়। নির্লজ্জ সমাজ, বিবেকহীন নেতৃত্ব। গরিব মানুষ সারাজীবনের সঞ্চয়ের টাকা রাখছে পোস্ট অফিসে, সেই টাকাসহ গরিবের ৫৫ কোটি টাকা হাওয়া। আগের ভূমিমন্ত্রী ছিল বড় সৎ, গরিবের জমি করল দখল তার লোক, তার হলো লন্ডনে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। শেয়ারবাজার খেয়ে ফেলে যারা তারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ করে। খেলোয়াড়দের কোনো আশা নেই। সেখানেও শুনি নয় ছয়। আদালতের ওপর অনেক অভিযোগ।

দুর্নীতিগ্রস্ত তারা- এত নষ্ট হয়েছে যে, তাদের কোনো লজ্জা নেই। ঘুষ তাদের অধিকার। সাধারণ মানুষের টাকা মেরে খায়, কিছুই করতে পারে না কেউ। মেধাবীদের চাকরির জন্যও লাগে ৯-১০ লাখ টাকার ঘুষ। গলা কাটছে শিক্ষিত দুর্বৃত্তরাও। শিক্ষিতদের গলাকাটা বড় নির্মম, দেশটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে। দুর্নীতিবাজদের সন্তান ১২ লাখ টাকায় ছাগল আর কোটি টাকার গরু খায়। এমপি নিজের কন্যার বয়সের যুবতীর হানিট্র্যাপের শিকার হয়ে খুন। সে নাকি ছিল চোরাচালানের নিয়ন্ত্রক। তার কন্যা লজ্জিত নয়। বরং দুর্নীতিগ্রস্ত দুর্নীতিবাজদের সন্তান স্ত্রীর দাপট আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে। প্রশাসনের বড় কর্তার স্ত্রীর সন্তানের জন্য আইন নাকি ভিন্ন। ভয়াবহ অসভ্যগোষ্ঠীর আমরা। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি ওষুধের দাম বৃদ্ধি করেই চলছে। যারা অতি উচ্চশিক্ষিত ডাক্তার এবং যাদের পেছনে রাষ্ট্রের কোটি টাকা খরচ হয় তারা সত্য মিথ্যা বলে চিকিৎসার নামে টাকা নেয়, অপরেশনে শিশুদের মৃতু্য। মেয়াদউত্তীর্ণ ওষুধ, আইসিইউতে রেখে গলা কাটে- তারা নাকি মানবিক মানুষ?

1

এই যে অরাজকতা, এই যে ভেজাল জিনিস, এই যে উচ্চমূল্য, এই যে গলাকাটা সেবা, এই যে পেনশনের টাকা তুলতে ফাইলের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যাওয়া, এই যে পরীক্ষায় ভালো করলেও চাকরি না হওয়া, এই সবের মূলে তো দুর্নীতিবাজরা। আমাদের দেশে এখন চলছে 'দুর্নীতিবাজদের অর্থনীতি'! এই দুর্নীতিবাজরা কারা? সাব-রেজিস্ট্রারের কোটি কোটি টাকার সম্পদ, চিকিৎসা খাতের অনিয়ম, খাদ্যে ভেজাল, শেয়ার মার্কেটের লুটপাট, ব্যাংকের টাকা লুটপাট, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশ্নফাঁস, প্রশাসন রক্ষক নয় ভক্ষকের ভূমিকায়, সামরিক বাহিনীতে অনিয়মের অভিযোগ, রাজনীতিবীদরা ভয়ংকর। সংসদে দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার সাংসদ মৃতু্যর হুমকি প্রাপ্ত হয়ে ঘুরছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর আস্থা নেই। এনবিআর এখন সোনার রাজ্য, সবাই সেখানে চাকরি করতে চায়।

আমাদের দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক, প্রশাসনিক কাঠামই দেশের দুর্নীতির জন্য থাকা কঠোর আইনগুলো থেকে দুর্নীতিবাজদের রক্ষা পেতে সাহায্য করছে। বিশেষত যখন দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলভাবে এবং প্রভাবিত হয়ে কাজ করছে, যাদের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব ছিল। তারচেয়েও ভয়ংকর হলো, যখন দুর্নীতিগ্রস্তরা অন্যরাষ্ট্রের থেকে বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করে রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কাজ করে। আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের অনানুষ্ঠানিক অর্থ লেনদেন দেশের উন্নয়ন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে। ঘুষ এবং দুর্নীতিসহ অদৃশ্য কারণগুলো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রভাবিত করছে। আন্তর্জাতিকভাবে রাষ্ট্র একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।

'ঘুষ লেনদেন পরিবেশ কাঠামো' এর অন্তত সিংহভাগ ঘুষদাতাই রাষ্ট্রের সব সংস্থার ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পায়- যা তাদের দ্রম্নত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি পেতে এবং অন্যান্যভাবে লাভবান হতে সাহায্য করে। ঘুষ দিয়ে ফায়দা লুটা প্রতিযোগীরা খুবই দক্ষ, তারা আমলাতান্ত্রিক নিয়ম মেনে চলার ক্ষেত্রে খুবই কৌশলী, কারণ তা না হলে তারা তাদের দুর্নীতির মাধ্যমে লাভবান হওয়া থেকে বাস্তুচু্যত হবে। কম ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা 'ঘুষ লেনদেন পরিবেশ কাঠামো' এর সমস্ত সংস্থা একইভাবে ঘুষ লেনদেন চলছে। আসলে আমাদের দেশে ঘুষ একটি অতিরিক্ত ফি হিসেবে কাজ করছে।

আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির প্রভাবগুলো আমাদের দেশের সঠিক উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এবং দক্ষ শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে বড় বাধা। কারণ 'ঘুষ লেনদেন পরিবেশ কাঠামো' কর্মসংস্থান কাঠামোকে প্রভাবিত করছে। 'ঘুষ লেনদেন পরিবেশ কাঠামো'তে অদক্ষকর্মী বিভিন্ন পদে নিয়োগ পান। এটা দেশের উন্নয়নের জন্য বিপজ্জনক।

প্রশ্ন এই দুর্বৃত্তদের দেশে, এই কালো টাকার দেশে, এই দুর্নীতিবাজদের আস্ফালনের দেশে প্রশাসনের ওপর এই ভয়ংকর আস্তাহীনতার দেশে, দ্রব্যমূল্যের নাকাল হয়ে, রাজনীতির এই খেলায় সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির বিভিন্নমুখী প্রভাব আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে, অর্থনীতিকে, সমাজব্যবস্থাকে এক ভয়ংকর অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের সুখস্বপ্ন আর কতদিন টিকবে 'দুর্নীতির অর্থনীতি'র এই 'ঘুষ লেনদেন পরিবেশ কাঠামো'য়?

অভিজিৎ বড়ুয়া অভি : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে