উত্তাল জুলাইয়ের অভিঘাতে প্রিয় মাতৃভূমিকে দংশন করছে প্রেতাত্মা শরীর। অথচ এই অভিঘাতের মূলে না গিয়ে বিষয়টি রাজনৈতিক মারফতি প্রোপাগান্ডায় অর্বাচীন গতিতে সরকার রাষ্ট্র্রকে ফেলেছে হুমকিতে। হাজারো আত্মজ ছাত্রের আহাজারিতে রাষ্ট্র্রকে গিলছে যেন ক্ষমতাখোর প্রতিক্রিয়াশীল অশুভ গং। এভাবে চললে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বৈষম্যের আগুনে পুড়তেই থাকবে। ছাত্রদের উপর্যুপরি আন্দোলন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ৫৩ বছরের পূর্ণ যুবক রাষ্ট্র্রটি অশুভ ক্ষমতা খেলায়, অবহেলা আর প্রতিক্রিয়াশীলতায় একটি হাইব্রিড রিজম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, যেখানে ক্ষমতাই মূল কথা। একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন আমাদের উত্তরপ্রজন্ম দেখেছিল। যে ন্যায্যতা, সাম্যতা এবং মানবিক মর্যাদার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্ত দিয়েছিল, তা আজ ব্যর্থতায় পরিণত হতে চলছে। ছাত্রসমাজ আজ বুঝিয়ে দিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে কীভাবে জন্ম নিয়েছে বৈষম্য আর প্রতিমুক্তিযুদ্ধের চেতনার বশংবদ। পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে যার সূচনা। কিন্তু দুঃখের বিষয় দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেও সরকার যখন সেই প্রতিক্রিয়াশীল চেতনার পরাকাষ্ঠ সম্পূর্ণ করে, তখন প্রশ্ন জাগে বঙ্গবন্ধুকে আমরা শুধু পোস্টার সর্বস্র কিংবদন্তি নেতায় পরিণত করেছি, তার চেতনার রঙে বিন্দুমাত্র রাঙাতে পারিনি প্রিয় সোনার বাংলাকে। যার হাত দিয়ে তৈরি ছাত্রলীগ বাংলাদেশের জন্মের অন্যতম কারিগর ছিল, সেই ছাত্রলীগ আজ সাধারণ দেশপ্রেমিক ছাত্রসমাজের প্রতিপক্ষ। অথচ আমরা দেখেছি, এই আন্দোলনে ছাত্রলীগও যুক্ত হয়েছিল, কিন্তু ক্ষমতা কাঠামোর লেজুড়বৃত্তি ব্যক্তিত্বহীন নেতৃত্বের মেকি মুখোশে আন্দোলনরত ছাত্রদের পেটাতে তাদের হাত একটুও কাঁপেনি। তারা কল্যাণ রাষ্ট্র্র চেতনার প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ছাত্রলীগের এই দ্বিচারিতা আচরণ বরং ছাত্রলীগের মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশকেই করেছে ক্ষতবিক্ষত। এর রেশ অন্তত দুটি প্রজন্মে বেঁচে থাকবে। এর দায় রাজশক্তির কেন্দ্রকেই নিতে হবে। কিন্তু কেন? প্রশ্নটা এখানেই, অর্থলোলুপ ক্ষমতা কাঠামোয় পুরো সমাজই যেন আজ অনাচার-ভ্রষ্টাচার আর মেকি নেতৃত্বের ভেক ধরা অরুচির বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পাটিসহ সব দলই একই দোষে দুষ্ট। ফলে ঘুণে ধরা এই রাষ্ট্রের ক্রান্তিকালে সব দায় বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হয় বারবার। অথচ এই সংকটকালে তার চাটুকার লেহনধারী পর্ষদ কোনো ভূমিকা রাখতে পারল না। তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা এই রক্তপাত থেকে দেশকে বাঁচাতে পারত। এ থেকেই বোঝা যায় রাষ্ট্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। আমার ১৯ বছরের শিক্ষক জীবনের চেতনা চাষের নিরলস কর্মচেষ্টার কোনো ফলই থাকলো না বলে নিজেকে তুচ্ছ মনে হচ্ছে। কেন, আমার ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি চেতনার সেই শব্দটিকে বেঁচে নেয় তার স্বরূপ নির্ণয়ে রাষ্ট্র্র ব্যর্থ হলে আরও কঠিনে নিমজ্জিত হবে আমার প্রিয় মাতৃভূমি। তাই আজই বোধোদয় হোক ক্ষমতাকেন্দ্রের- সেই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
এবার অন্য প্রসঙ্গে আশা যাক, কোটাবিরোধী থেকে রূপ নেওয়া বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে পুরো জাতি আজ নড়ে বসেছে। প্রথমে শুধুই কোটা নিয়ে চলমান আন্দোলন শুরু হলেও এবার এই আন্দোলন এক সামষ্টিক রূপ নিয়ে আশার আলো জ্বালিয়েছে যেন দেশটি প্রতিক্রিয়াশীল দলবাজদের হাত থেকে হয়ত রক্ষা পাবে। প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালিরা ক্ষমতাকেন্দ্র নিয়ে তেমন ভাবেনি। তারা নিজেদের সংসার এবং পারিপার্শ্বিক প্রচলিত ঐক্যবদ্ধ সমাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। কিন্তু জাতীয় প্রশ্নে তারা ঠিকই সামনে থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশমাতৃকার সেবায় নিজের প্রাণকেও উৎসর্গ করেছে- যার উদাহরণ ইতিহাসে ভূরি ভূরি পাওয়া যায়। বিগত ৫৩ বছর ধরে অরুচির বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে ক্ষমতাকেন্দ্রের ছত্রছায়ায়। মহান সংবিধানের তোয়াক্কা না করেই নির্বাহী আদেশে এসব জঞ্জাল সৃষ্টি করা হয়েছে পরিকল্পিকভাবে। তাই আজ ক্ষমতাকেন্দ্রকে ভাবতে হবে এই বাংলাদেশ আর চলতে পারে না, মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই সাম্যতা, ন্যায্যতা আর মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ বিনির্মাণে রাষ্ট্র্র সংস্কারে সবাইকেই একযোগে কাজ করতে হবে, তবেই মহান শহীদের রক্তের দায় পূরণ সম্ভব।
একটি জাতির জাতীয়তাবোধ ও রুচিশীলতা গড়ে ওঠে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক জীবনযাপন এবং জাতীয় বিষয়াবলির চর্চিত রূপায়ণের মাধ্যমে, যেখানে রাষ্ট্র্র আরোপিত জাতীয়তাবাদী ভূমিকা এ ক্রিয়ায় মূল অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। সংকট শব্দটি মূলত নেতিবাচকতা অর্থেই ব্যবহৃত হয়। সাধারণত জোগানের ঘাটতি থেকেই সংকটের জন্ম। কাঙ্ক্ষিত আচরণিক বৈশিষ্টের কমতি সেই সংকটকে দৃশ্যমান করে। সংকট মূলত তৈরি হয় শ্রেণি বৈষম্য এবং শোষণ-শাসনের অসাম্য অবস্থা থেকে। একটা সমাজ বা দেশে যত বেশি বৈষম্য সেখানে তত বেশি রুচির তারতম্য। আজকের বাংলাদেশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যত বেশি অর্থ আয়, তত বেশি বৈষম্য। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র্র কাঠামোর দুর্বলতা, শাসনের বৈকল্য, রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচার, নীতি নৈতিকতার অবক্ষয়, দালাল-লেহন-তোষণ রাজনৈতিক চর্চা ও দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি ও ঠগী রাজন্যতন্ত্র এবং শিক্ষার অপরিণামদর্শিতাসহ সংস্কৃতির মনোবৈকল্য সমাজে সংকট প্রকট করে তোলে। এখানেই রাজনৈতিক অপরিণামদর্শিতা ও অপরাজনৈতিক চর্চা সমাজে মনোবৈকাল্যের সুবাধে প্রচলিত কাঠামো বিপর্যস্ত করে তোলে- যার ফল হিসেবে সমাজে অন্যায়, অনাচার, ঘুষ এবং প্রচলিত আইনের প্রতি অনস্থা তৈরি করে সমাজে ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির অশুভ মহড়ার জন্ম দেয়, যা শেষপর্যন্ত রুচির প্রশ্নে অপরুচির সংস্কৃতির সৃষ্টি করে। ক্ষমতা কাঠামোর উপরিকাঠামো নিজেদের সমাজের ধর্তাকর্তা মনে করে নিচের কাঠামোকে অপাংক্তেয়-শ্লেষ এবং অমার্জিত বলে ধরে নিয়ে সমাজে মোটাদাগে দুটো শক্তিশালী ধারার জন্ম হয়। একথা প্রণিধানযোগ্য যে, বঙ্গবন্ধু তার জাদুকরী ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে প্রায় সমগ্র জাতিকে একই সংস্কৃতিক চেতনায় উজ্জ্বীবিত করেছিল বলেই ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন বাঙালির অমিয় গৌরব ও অহংকারের বস্তু, এখানেই বাঙালি-বাংলাদেশি সব জনতাকে একই জাতীয়তাবোধের সুযোগ তৈরি করেছিল আমাদের মহান সংবিধান, যার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ক্ষত থেকে। বাংলাদেশের ৫৩ বছরে আমরা সেই ঐক্যের সংস্কৃতিক বিপস্নব ঘটাতে পারিনি। যদিও আমাদের মহান সংবিধান সেই চর্চার জায়গাটি শুরু করে দিয়েছিল, কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে অরুচির রাজনৈতিক চর্চা শুরু হয়- যার দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হলো আজকের এই সংকট। শ্রেণি সম্প্রদায়িকতা রোধ করতে না পারলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ অধরাই থেকে যাবে আর এর প্রতিক্রিয়া জাতিকে সংকটাপন্ন করতেই থাকবে। সরকারপ্রধান আমি চেতনায় রাষ্ট্রিক বিভক্তি যেন আরও স্পষ্ট করেছেন। সব সময় ভাবতে হবে আমি কে কীভাবে আমরায় পরিণত করা যায়, আমি আমরা হলেই রাষ্ট্র্র হবে কল্যাণময়।
আর এ জন্য প্রয়োজন সংঘের, কারণ একা একা কাঙ্ক্ষিত সফলতা সম্ভব নয়। কেননা, ব্যক্তি টেকসই হয় না, টেকসই হয় সংগঠন, তাই সাংগঠনিক চর্চাই আজকের সংকট থেকে উত্তরণের পথ হতে পারে। পরিবর্তন একদম গোড়া থেকেই আনতে হবে। আজ শহরগুলো যেন দেবতার তুষ্টি অর্জনে অঘ্র হাতে লেহনকারীদের দৌরাত্ম্য, সেখানে গরিব ও মেহনতি মানুষের স্থান যেন নিকৃষ্ট। ফলে, তার উন্নয়ন নিয়ে ভাববার সময় রাষ্ট্রের নেই। আজ আরোপিত এবং প্রভূত্ববাদী চর্চা পরিহার করতে পারলেই রুচির দুয়ার খুলে যাবে। এ কথা তো সত্য যে আমরা ফুল নয় তার গন্ধতে বিমোহিত হই। তাই রাষ্ট্র্রকে আমাদের রাজ্য তৈরি করতে হবে। চিন্তার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে, কেননা, চিন্তা করতে শিখলেই, চিন্তার দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করতে পারলেই মানুষের মুক্তি। তাই নিজের স্ব-রাজ তৈরির চর্চা হওয়া উচিত বর্তমান সময়ের অন্যতম এজেন্ডা, জনকণ্ঠস্বরের স্বরূপ সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্টা করতে পারলেই এই সংকট ও মহামন্দা থেকে কাটিয়ে উঠতে পারবে জাতি। সরকার ব্যবস্থার দেউলিয়াত্ব সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ সরকারকে এড়িয়ে চলার পথ খুঁজছে। এ চরম সত্য প্রমাণ করে মানুষ ইতিহাস থেকে শিখতে চায় না, সরকার ১৫ বছর ধরেই শিখতে চায়নি বরং শিখাতে চেয়েছে, এটাই শাসনের সীমাবদ্ধতা- যা অর্জন তা হলো অহং যা কিনা দাসত্বের অহং।
ক্ষমতার বলয়ে আজ আটকে গেছে সব, সেখানে সবকিছু চলছে ক্ষমতার দখলে। তাই তো ক্রমশ আমারা পরনির্ভশীল হচ্ছি। আপন সংস্কৃতি থেকে সরে যাচ্ছি কিংবা সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাঁচার পথ আজ একটাই-সংগঠিত হওয়া, একতা সংস্কৃতিই পারে এ দৈন্যতা থেকে মুক্তি দিতে। মুক্তির পথ যে একতা এ কথা আজ সত্য। যৌথ না হলে আর ভাগ হয়ে এগোনো যাবে না, একলা চললে আর হবে না। আমরা এবং আমাদের নেতৃত্ব ও সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে হবে, কারণ নেতৃত্ব হয়েছে আজ কর্তৃত্ব; ফলে, সংস্কৃতিই হয়েছে কর্তৃত্বের সফল হন্তারক। মনে রাখতে হবে, নেতৃত্ব শব্দটি যৌথ প্রয়াস থেকেই উদ্ভূত। সেখানে একক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নেতৃত্ব একক হলেই তা হয়ে ওঠে কতৃত্ববাদী এবং স্বৈরচার। তাই আমরা দেখছি উন্নয়ন একটি যৌথ শব্দ হলেও উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু বিকাশ হচ্ছে না, কারণ উন্নয়নও হয়ে পড়েছে একক সত্ত্বায় আবদ্ধ। আমরা স্বাধীন হয়েছি কিন্তু সার্বভৌমত্ব কি পেয়েছি, স্বাধীনতা একটি সংস্কৃতি। এর জন্য প্রয়োজন সংস্কার। মনে রাখতে হবে ভূমি থেকেই অর্থের উৎপত্তি। ভূমি থেকেই সংস্কৃতি তথা জীবনজীবিকার উৎপত্তি, তাই তো মানুষকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে আমরা মানুষকে করেছি আরও গরিব এবং সাংস্কৃতিকভাবে নিঃস্ব। ভূমি থেকেই মানুষ তৈরি করেছে তার বংশ বুনিয়াদ; তাই প্রয়োজন ভূমিজ সাংস্কৃতিক বিপস্নব, তবেই বাংলাদেশ রুচির প্রশ্নে দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পাবে বলে মনে করি। আবার দুর্বৃত্তায়নের ক্ষমতাকেন্দ্র দখল এবং প্রচলিত চোর-বাটপার আর আত্মহননের গণতন্ত্রও হা'ভাতে সংস্কৃতির ধ্বজাধারী হয়ে সমাজে সর্বত্র অরুচির জন্ম দিয়ে আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষার মূলে পেরেক ঠুকেছে যেখানে উপর থেকে নিচ সব যেন পচনের শেষ বিন্দুতে পৌঁছেছে। এটা তো দিব্যলোকের মতো পরিষ্কার যে, ধর্মকে নিয়েও নিরপেক্ষ হওয়া যায়, আবার ধর্মকে বাদ দিয়েও নিরপেক্ষ হওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হলো আমি কীভাবে নিরপেক্ষ হবো, এটা নির্ভর করে ব্যক্তির বোধ, বুদ্ধি আর বিবেকের ওপর। তাই এই সংস্কৃতিবোধ জাগলেই রুচি আপনা-আপানি তৈরি হয়ে যাবে। সুযোগ পেলেই শাসকরা বাণী দেয় ঈশ্বরের মতো, আর আমজনতা গোলামিতে সেই বাণীতে যেন বুদ হয়ে থাকে আর চুষে খায় ঘামের দাম। এজন্য আজ প্রয়োজন স্বনিয়ন্ত্রিত এবং নিজ নিজ কাজে নিবদ্ধ সংগঠনের, যারা এ ভ্রান্ত এবং অ-জনকেন্দ্রিক সমাজ কাঠামো ভেঙে নতুন করে এক জনকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সৃষ্টি করবে। বোধকে মূল্যবোধে নেবে।
আবার আমার বদলকে কেউ যদি নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে সেই বদল হয়ে পড়ে প্রতিক্রিয়াশীল। এজন্য রাষ্ট্র্রকেও বদলাতে হবে। সংস্কার করতে হবে সব নীতি আইন। শাসকরা আজ এক হয়েছে নিজেদের গোছাতে, রাষ্ট্র্র আজ তাইতো শোষণের হাতিয়ার, অর্থের পাহাড় বানানোর মূলধনী ব্যবসায়। সব সংকট যে রাষ্ট্রের বানানো নাটক। এটা বুঝেই কাজে নামতে হবে। রাষ্ট্র্র ইচ্ছে করেই অরুচির চর্চা করে আমাকে করে জ্ঞানপাপী। আমার জ্ঞানপাপে আজ ডুবতে বসেছে আমার সব, রাষ্ট্র্র আর ভালোর স্রোতে আজ চেপে বসেছে জ্ঞানপাপ। আর এর প্রভাবই হলো আজকের এই সংকট।
একটু চোখ মেলে দেখলেই আমরা দেখি, কোথাও রাষ্ট্র্র কি দিয়েছে নিরাপত্তা ঘরে ঘরে, এখন প্রশ্ন হলো এ ঘর তো আমার, এর নিরাপত্তা কি আমি নেব না, আমি কি আমার ঘরকে নিরাপদ করব না, এ ঘরের দেয়াল আমি কি সযত্নে সুরক্ষিত করব না, ঘরের খুঁটি তাই ভাঙতে হলে ভাঙ, সংস্কারের খড়গকোপে প্রচলিত চাদর ছিঁড়। আমাকে বিশ্বাস আজ তুমি কেন কর না, কেন আমি তোমার আস্থাভাজন হই না, এর উত্তর কি আমি খুঁজব না; এ শিকল কি আমি টুটবো না; নাকি পায়ের বেড়ির মতো কোমরেও আমি পরব রুপার বিছা। সংকল্পের মাটিতে স্বপ্নের বীজ কেন রোপণ করব না, নাকি প্রশ্নের উত্তরে দিয়ে যাব বিভ্রান্তির জবান। এভাবেই এই সংকটের উত্তর আমিই হয়ে উঠতে পারি, আর রচনা করতে পারি সমৃদ্ধ আমার বাংলাদেশ। ভাবাবেগ থেকে বের করতে হবে সবাইকে। পুরনো স্মৃতি, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতির সংরক্ষণ করতে হবে। সমাজ আজ আচ্ছন্ন পশ্চাৎপদতায়, জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে সমাজকে বদলাতে হবে। সংস্কার করতে হবে। মানুষ-প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে। জানাকে গভীর করতে হবে আর তখনিই জানতে আগ্রহ বাড়বে, আর এখানে আমারও অতিরিক্ত দায়িত্ব আছে। তাই সমাধানযোগ্য চিন্তায় নিজেকে নিমগ্ন রাখতে হবে। আজ যদি আমি নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চাই, তবে আমাকে অবশ্যই জানতে হবে এর কারণ।
বাংলাদেশের ৫৩ বছরের প্রাপ্তি শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে। সরকার মনে করেন বড় বড় বিল্ডিং, ঝকঝকে রাস্তাঘাট আর মেগা প্রকল্পই যেন উন্নয়নের মূল সূচক। অথচ এই বিপুলসংখ্যক যুবদের নিয়ে তেমন কোনো মহাপরিকল্পনা সরকার জাতির সামনে আনতে পারেনি। এটাও যুব অসন্তোষের অন্যতম কারণ। তারা কি করবে তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। একটা হুজুগে জাতীয় চরিত্র নিয়ে রাষ্ট্র্র চলছে, ফলে হাজারো বৈষম্যের পাহাড় জাতিকে সহ্য করতে হচ্ছে। এই যুবসমাজ কেন তা সহ্য করবে?
সমাজে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের উৎস খুঁজলে সহজেই অনুমিত হয় বর্তমান ক্ষমতাকেন্দ্র শ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ী, অসৎ রাজনীতিবিদ ও অসৎ আমলার ত্রিভুজ অশুভ ক্ষমতা কাঠামোর যা দিব্যলোকের মতো পরিষ্কার। বিগত ৫৩ বছরে শাসকশ্রেণির প্রধান দুই অংশের ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতা দখলের লড়াই থেকে রাষ্ট্র্রকে বাঁচাতে নতুন বিকল্প সামাজিক শক্তির উত্থান সময়ের দাবি ছিল। তবে সমাজের ভেতর থেকেই এবং রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হলে আজকের এই দৃশ্য দেখতে হতো না, এটাই আফসোস।
যে দেশে অল্প ক'টা টাকায় জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার লোক পাওয়া যায়, সে দেশে সরকার যে উন্নয়নের কথা বলে, সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। অবকাঠামোগত উন্নয়নই একমাত্র উন্নয়ন নয়। যদি উন্নয়নই হয়, তবে এত কম টাকায় লোক ভাড়া পাওয়া যাবে কেন? এর উত্তর কি খুঁজবেন না। তাই এম এম, আকাশ স্যারের কথায় বলতে চাই 'সরকারকে এ মুহূর্তে সবার আগে উন্মুক্ত যুক্তি-তর্ক-আলোচনা-পর্যালোচনা-ভিন্নমত, সরকারপ্রধানের প্রশংসা-সমালোচনা ইত্যাদির সুযোগ দিতে হবে। এসবের মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটনের স্বাধীনতা দিতে হবে। সন্ত্রাস-সহিংসতা, বলপ্রয়োগ, জবাবদিহিহীন হস্তক্ষেপের সংস্কৃতি, তথ্য গোপন ও মিথ্যা প্রচার থেকে আমাদের সব পক্ষকেই বের হয়ে আসতে হবে'।
\হবৈষম্যবিরোধী আন্দোলন প্রমাণ করেছে 'কীভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই সংগ্রামের মাধ্যমে সর্বজনের কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনতে হয় এবং কীভাবে মেধা ও যোগ্যতাবিহীন বলপ্রয়োগকে ঠেকাতে হয়'। এটা ঘটেছে বেশিরভাগ অরাজনৈতিক সাধারণ ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ উত্থানের মাধ্যমে। এই পথ ধরেই আগামী দিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন সৎ-যোগ্য-মেধাবীদের নেতৃত্ব ফিরে আসতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে এভাবেই সুস্থ রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠবে। এভাবে সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ টেকসই করার সুযোগ তৈরি হবে। রাষ্ট্র্র মহান সংবিধানে যা বলেছে তা রক্ষা এবং পরিচর্যা করার দায়িত্ব সরকারের। নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য প্রসঙ্গে সংবিধানের ২১ (১) বলা হয়েছে 'সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিকদায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য'? আবার ২১ (২) এ বলা হয়েছে 'সব সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য' তাই আজকের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সবাইকেই দায়িত্বশীল থকার আহ্বান জানাচ্ছি। অনুরুপভাবে অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্ম নিয়ে সংবিধানের ২০ (১) এ বলা হয়েছে- কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়, এবং 'প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী'- এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন? এবং ২০ (২) এ বলা হয়েছে- রাষ্ট্র্র এমন অবস্থাসৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক-সকল প্রকার শ্রম্নম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতার অভিব্যক্তিতে পরিণত হইবে তাই আজকের এই পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী। আসুন রাষ্ট্র্রকে বাঁচাই। কারণ রাষ্ট্র্র বাঁচলে আমি বাঁচবো। আজকের সংকট প্রকট আকার ধারণ করার পেছনে যে অজ্ঞতা কাজ করেছে তা হলো অবিবেচক কথা। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করেই কথা বলা উচিত। প্রজ্ঞাবান চুপ থাকাকেই সমাধান ভাবেন। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে অক্ষম অন্তরদৃষ্টিহীন সরকার কাঠামোই বঙ্গবন্ধুসহ ত্রিশ লাখ শহীর সোনার বাংলা বিনির্মাণের মূলমন্ত্র ধ্বংসের হন্তারক, এ গস্নানি আজ বহন করার বিকল্প হয়তো আর নেই।
চাষা হাবিব : কবি ও গবেষক