বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব দেশ। প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে এ দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। শুধু ৩০ লক্ষ মানুষই না সেই সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের ত্যাগ ও ইজ্জতের বিনিময় স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব দেশের মর্যাদা লাভ করে। সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-ছাত্রী ইত্যাদি নানান পেশার মানুষ। প্রায় নয় মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর লিখিতভাবে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়। যেখানে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অপ্রশংসনীয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, প্রতিটি ক্ষেত্রে ছাত্ররা জান-মাল দিয়ে দেশকে রক্ষা করার জন্য প্রতিবাদ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। দেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণে কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা আজ অসহায়। প্রতিটি সেক্টরে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তরুণ সমাজ তার যোগ্যতা অনুযায়ী তেমন কোনো ভালো কাজে যোগদান করতে পারছে না। দুর্নীতির কারণে তরুণ সমাজ আজ হতাশাগ্রস্ত। গত কয়েক বছরে যে পরিমাণ দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে, যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষিত বেকার। যারা লোকলজ্জার ভয়ে নিম্নশ্রেণির কাজও করতে পারছে না। আবার তার যোগ্যতা অনুযায়ী একটা ভালো চাকরিও পাচ্ছে না। তারা তৈরি হচ্ছে পরিবারের বোঝা এবং সৃষ্টি হচ্ছে তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা। সিস্টেমের কারণে তারা যে তাদের যোগ্য স্থানে যেতে পারছে না সেটা কাউকে বলতেও পারছে না। আবার এটা মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু এই তরুণ সমাজে ভূমিকা রেখেছে পূর্বের ঐতিহাসিক সব সংগ্রাম, অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে। আমরা যদি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের কথা চিন্তা করে তাহলে অনায়াসে আমাদের উত্তর পেয়ে যাব যে, '৫২-এর ভাষা আন্দোলনে তরুণ সমাজ কতটা ভূমিকা রেখেছে। যেখানে আমাদের প্রিয় ভাইয়েরা শহীদ হয়েছিলেন। রফিক, শফিক, বরকতসহ নাম না জানা অনেক শিক্ষার্থী ভাষা আন্দোলনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন। আবার আমরা যদি এই কিছুদিন আগের কথায় চিন্তা করে তাহলে দেখতে পাব এই তরুণ সমাজের কারণে দেশে নতুন শাসনব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। যেখানে শহীদ হয়েছেন আবু সাঈদের মতো বীর সাহসী একজন শিক্ষার্থী। আবু সাঈদ ছাড়াও আমরা স্মরণ রাখতে চাই সেই মুগ্ধকে। যে 'পানি লাগবে, পানি লাগবে' বলে সবাইকে পানি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এত ত্যাগ ও জীবন আর বিনিময়ে তরুণরা পেয়েছে আমাদের অধিকার?
আজ বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত তালিকা মধ্যে অন্যতম। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে চলেছে দুর্নীতি। যোগ্য ব্যক্তি যোগ্য স্থানে তার স্থান গড়ে তুলতে পারেনি। সামান্য পুলিশে চাকরির জন্য অনেক ব্যক্তিকে দিতে হয়েছে কয়েক লক্ষ টাকা। যেটা দেশের জন্য খুবই হতাশাজনক ও লজ্জাজনক। আজ উন্নত বিশ্ব যেখানে তরুণ সমাজকে নিয়ে উন্নতি শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে আজ সেখানে বাংলাদেশে চলছে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিযোগিতা। দেওয়া হচ্ছে না তরুণদের অধিকার। ভাষা আন্দোলনে মাধ্যমে বাক্স্বাধীনতা পেলেও কেউ কথা বলতে পারেনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু তরুণদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। আমরা যদি পূর্বের ইতিহাস আলোচনা করি তাহলে দেখতে পাব হাজার হাজার নেতা যারা যুবক বা তরুণ অবস্থায় তাদের দেশের জন্য অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে। আমরা যদি আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলে তাহলে দেখতে পাব তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নরত অবস্থায় দেশের বিভিন্ন অপরাধ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজের প্রতিবাদ তৈরি করেছেন। '৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সর্বক্ষেত্রে তার অবদান বাঙালি কখনো ভুলে যাবে না। এছাড়াও যুগে যুগে যারা বিশিষ্ট ও বিখ্যাত ব্যক্তি তাদের কথা আলোচনা করলে তাহলে দেখতে পাব হাজার হাজার মানুষ যারা তরুণ অবস্থায় তাদের ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মাত্র ১৭ বছর বয়সে গঠন করেছিলেন সামাজিক সংগঠন 'হিল-ফুল ফুজুল'। মাস্টারদা সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম বসু, প্রীতিলতা, তারুণ্যে বুক পেতে দিয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সম্রাট বাবর, সম্রাট আকবর, নেলসন ম্যান্ডেলা, মোহাম্মদ বিন কাশেম, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী, বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়সহ বহু বীর সেনা ও মনীষী তাদের কৃতিত্ব অর্জন করেছে তরুণ অবস্থায়।
তরুণ অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের বিখ্যাত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। তিনি এই তরুণ অবস্থার মনোভাব পোষণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন এক বিখ্যাত কবিতা 'আঠারো বছর বয়স'। এছাড়াও অনেক মনীষী এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তারা তরুণদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমনকি জাতিসংঘ তরুণ অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। আমরা যদি বিখ্যাত ফেসবুক কোম্পানির মালিকের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পাব তিনি তরুণ বয়সে ফেসবুকের মতো একটা বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। আবার মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস-এর কথা চিন্তা করি তাহলেও দেখতে পাব তিনি তরুণ বয়সে হয়েছেন বিলিয়নিয়ার। তাহলে তরুণরা অবহেলিত কেন?
আজ তরুণেরা দেখিয়ে দিয়েছে তারা কী পারে। তরুণরা যেমন দেশরক্ষার্থে গর্জে ওঠে তেমনি দেশের সংস্কার উন্নয়নেও মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আমাদের দেশে সংঘটিত কোটা সংস্কার আন্দোলন পরবর্তীকালে দেশের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তৎপর তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা রাস্তা পরিষ্কার, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, দেওয়াল চিত্র, ক্যালিগ্রাফি, উপাসনালয় পাহারা, বাজার তদারকিসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজে লিপ্ত হয়েছেন। এমনকি ট্রাফিকের কাজও দক্ষতার সঙ্গে করছেন। সেই সঙ্গে নিজ নিজ এলাকার নিরাপত্তার কাজেও তৎপর আমাদের তরুণ প্রজন্ম। তাহলে কেন তারা অবহেলিত থাকবে...?
আজ জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত। এখন সময় এসেছে এই লজ্জা থেকে নিজেকে মুক্তি পাবার। সময় এসেছে দেশের সর্বস্তরে শিক্ষিত তরুণদের নিয়োজিত করে দেশকে নতুন রূপে তৈরি করা। মেধা ও মনন শক্তি, সততা, নৈতিকতা ইত্যাদি সব কিছু কাজে লাগিয়ে এক নতুন দেশ তৈরি করা যেটা দাঁড়াতে পারবে মাথা উঁচু করে। যেখানে থাকবে না দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপরাধমূলক কর্মকান্ড। আজ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হয়ে ঘুরতে হচ্ছে দ্বারে দ্বারে। কেন ঘুরতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয় আসন নির্বাচনের আগে প্রশাসনের কি উচিত ছিল-না আমরা যে পরিমাণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী প্রতিবছর পাস করিয়ে বের করে দিচ্ছি তারা কোথায় যাবে? তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান কী হবে? তারা কী দেশের মূল্যবান সম্পদ হবে না আবর্জনা হবে? কোনো উত্তর নেই। তাই প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয় 'নতুন বিশ্ববিদ্যালয় নয়, প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মান'। প্রয়োজন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা কমিয়ে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে তার পড়াশোনা শেষ করার পরে যেন চাকরির মুখ দেখতে পারে এটা নিশ্চিত করা। যাতে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে এভাবে অকালে আত্মহত্যার মতো সামাজিক ও ব্যক্তিগত অপরাধে জড়াতে না হয়। পরিশেষে বলতে চাই, দলমত নির্বিশেষে হোক একটা নতুন আধুনিক গ্রহণযোগ্যমূলক বাংলাদেশ। যেখানে প্রয়োগ হবে সঠিক গণতন্ত্র। থাকবে বাক্স্বাধীনতা থাকবে মেধাবীদের স্থান। থাকবে নিজ যোগ্যতায় নিজের স্থান গড়ে তোলার সুযোগ।
মো. সোহান হোসেন :নবীন কলাম লেখক