রোববার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২

দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে বাঙালি জাতি একতাবদ্ধ

বাংলাদেশের জনগণ তাদের মাথার ওপর কারো দাদাগিরি একদম পছন্দ করে না। আমরা বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণকে চোখ-কান খোলা রেখে সজাগ ও সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্যই বিদেশি যে কোনো আগ্রাসন রুখে দিতে পারে।
ওসমান গনি
  ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে বাঙালি জাতি একতাবদ্ধ

একটি স্বাধীন দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও অপপ্রচার চালিয়ে একটি স্বাধীন দেশকে কখনো ধ্বংস করা যাবে না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আর বাংলাদেশ স্বাধীনতাকালীন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার মানে এই নয় যে, একটি দেশ তাদের তাবেদারি করে চলবে, কিন্তু না বাংলাদেশ কারো তাবেদারি করে চলার মতো দেশ না। গণ-অভু্যত্থানে দেশের প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর ভারত এরপর থেকে একের পর এক বাংলাদেশ সম্বন্ধে যে মিথ্যাচার অপপ্রচার করে চলছে তা শুধু বাংলাদেশের জনগণ নয় সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে হেয়প্রতিপন্ন করে তোলার লক্ষ্যই ভারতের। কিন্তু এটা কখনো সম্ভব হবে না ভারতের পক্ষে, যে যাই বলুক না কেন, বাঙালি জাতি দেশপ্রেমিক জাতি; তারা নিজ দেশের জন্য জীবন দিতে রাজি আছে।

ভারতের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুরা হত্যা-নিপীড়ন-ধর্ষণ ইত্যাদির শিকার, এমন অপতথ্য প্রচার করে বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর চোখে হেয় প্রতিপন্ন এবং অন্তর্র্বর্তী সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করাই এই মিথ্যা-বানোয়াট প্রচারণার মূল লক্ষ্য। ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর ভারতের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা শুরু হয়- যা পরবর্তী সময়ে দিন দিন বৃদ্ধি পায়। ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেপ্তার হওয়ার পর তা চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। 'হাজার হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হচ্ছে', 'হিন্দু নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে', 'হিন্দুদের বাড়িঘর-দোকান-পাট পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে', 'হিন্দু মন্দিরে হামলা করা হচ্ছে' বলে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে এবং বাংলাদেশ বিরোধী বিক্ষোভগুলোতে তা উচ্চারিত হচ্ছে। এই মিথ্যাচার একদিকে যেমন ভারতীয়রা বিশ্বাস করছে এবং তাদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি বিদ্বেষ বিস্তার লাভ করছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এটা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও ভারতবিদ্বেষ সৃষ্টি করছে। আরো লক্ষণীয়, ভারতীয় মিডিয়া ও সরকারের এই যূথবদ্ধ অপপ্রচার বিশ্বের কোনো কোনো দেশ বিশ্বাস করে বিরূপ প্রতিক্রয়া ব্যক্ত করছে, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর।

এ ধরনের ভুয়া পোস্টগুলোতে দেখা যাচ্ছে, 'জেহাদিরা বাংলাদেশের হিন্দুদের কেটে ফেলছে অথচ বিশ্ব একেবারে চুপ করে আছে ইত্যাদি কথা।

বহু ভুয়া তথ্য ও অসত্য খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক ভুয়া তথ্যই আবার মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে। যেখানে একদল টুপিপরা মানুষ লাঠি ও লোহার বড় হাতে চাষের ক্ষেতের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, যেখানে পেছন থেকে গুলির শব্দ শোনা গেছে। কট্টরপন্থি জনতা বাংলাদেশের শেরপুর জেলার একটি গ্রামে হামলা চালিয়েছে হিন্দুদের বাড়ি ও ক্ষেতের ফসল ধ্বংস করে দিয়েছে। একজনকে হত্যা করেছে। আসলে এই ভিডিওটি হলো ওই গ্রামের দরবার শরিফে ২৬ নভেম্বর যে হামলা হয়েছিল তার।

ভারতের মূলধারার এবং সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা খবর ও ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়ি। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির কোনো বালাই নেই। প্রচন্ড বাংলাদেশবিদ্বেষ বা মুসলিমবিদ্বেষই এর প্রধান কারণ। ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর থেকেই ভারতের গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবর ও গুজব ছড়াচ্ছে। স্মরণ করা যেতে পারে, মিথ্যা ও ভুয়া খবর এবং গুজব প্রচারকারী গণমাধ্যমের মধ্য বিখ্যাত গণমাধ্যমও রয়েছে। অধিকাংশ গণমাধ্যমের ভাষা ইংরেজি হওয়ায় এই ভুয়া ও মিথ্যা খবর, গুজব ও অপতথ্য দ্রম্নত বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কী ধরনের ভুয়া ও মিথ্যা খবর গুজব প্রচারিত হচ্ছে, নমুনা হিসেবে শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর তার নামে খোলাচিঠি, অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইসিইউতে ভর্তি, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, পাকিস্তানি জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র আনা, চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী হিসেবে প্রচার ইত্যাদির কথা উলেস্নখ করা যায়।

এসব মিথ্যা খবর, ভুয়া তথ্য ও গুজব সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ, তার সরকার ও জনগণের বিষয়ে ভুল বার্তা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া, সরকার ও রাজনৈতিক পর্যায় থেকে শুরু করে জনগণ পর্যায় পর্যন্ত পারস্পরিক বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব যে ভারতের সংশ্লিষ্ট মহলগুলো জানে না বা বোঝে না, এমন নয়। তবে, তারা প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে হাসিনা সরকার বিদায় নেওয়ায়। হাসিনা সরকার ছিল তাদের ভালোবাসার মানুষ। তার আমলের প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক বদলে গিয়ে এখন সম্পর্ক হচ্ছে সমানে সমানে। এটা ভারত মোটেই মানতে পারছে না। তার এতদিনের বাংলাদেশ নীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পরাজয়ের গস্নানি তাদের পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্যই ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একের পর এক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সে বেদিশা বা পাগলপারা হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা তার মূল উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনারই অংশ। ভারতের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার প্রভাব বিভিন্ন দেশে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইসু্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ও প্রভাবশালী দেশের শীর্ষ সংসদীয় শুনানিতে অন্যায্যভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।

সংবাদপত্র ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো যদি বাংলাদেশে আসে এবং সরজমিনে সবকিছু প্রত্যক্ষ করে তবে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। এছাড়া, সংখ্যালঘুদের, বিশেষত হিন্দুদের যেসব সংগঠন আছে, তারা সবাই যদি অপপ্রচারণার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় তবে উচিত জবাব হতে পারে। সরকারকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। অপপ্রচারণা, অপতথ্য ও গুজবের মোকাবিলা করার জন্য সরকারের একটি পৃথক সেল থাকতে পারে- যার কাজ হবে, সত্য ও সঠিক তথ্য তুলে ধরে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রতিহত করা। দেশের মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী উসকানিমূলক অপপ্রচারের ফলে সৃষ্ট আঞ্চলিক উত্তেজনায় দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো।

ভারত নিজের দেশে তার প্রতিবেশী দেশের কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা দিতে যেখানে ব্যর্থ, সেখানে সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির দেশ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দেশ বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলার কোনো অধিকার তাদের থাকতে পারে না।

বাংলাদেশের জনগণ তাদের মাথার ওপর কারো দাদাগিরি একদম পছন্দ করে না। আমরা বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণকে চোখ-কান খোলা রেখে সজাগ ও সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্যই বিদেশি যে কোনো আগ্রাসন রুখে দিতে পারে।

বাংলাদেশের জনগণ কখনোই ভারতের মাতব্বরি পছন্দ করে না আগেও করছে না এখনো করে না ভবিষ্যতেও করবে না। কারণ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। স্বাধীন দেশের ওপর অন্য কোনো তৃতীয় দেশে এসে মাতব্বরি করবে আর সে দেশের জনগণ বসে বসে আঙুল চুষবে তা কখনো হতে দেওয়া হবে না। বাংলাদেশের জনগণ কোনো দেশের দান-দক্ষিণায় চলে না। একটি স্বাধীন দেশের ওপর অন্য তদারকি দেশের মানুষ কখনো মানবে না। ভারত যতই অপপ্রচার চালাক। দেশের সাধারণ মানুষ এখন সব বুঝে গেছে। ভারতের একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যত রকমের গোলযোগ থাকুক না কেন, দেশের সার্বভৌমত্ব স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে সমস্ত বাঙালি জাতি এক। নিজের দশা ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য প্রয়োজনে বাঙালি একতাবদ্ধ হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে।

ওসমান গনি :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে