সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

শীতার্তদের উষ্ণতার আকুতিতে সাড়া দেওয়ার সময় এখনই

গরিব ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেক বিত্তবান ও সামর্থ্যবান মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। আসুন, সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে যার যার অবস্থান থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই শীতার্ত মানুষের প্রতি। এতে শীতার্তরা একটু হলেও উষ্ণতা পাবে, ভালো থাকবে।
সাধন সরকার
  ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শীতার্তদের উষ্ণতার আকুতিতে সাড়া দেওয়ার সময় এখনই
শীতার্তদের উষ্ণতার আকুতিতে সাড়া দেওয়ার সময় এখনই

শীত তার চিরচেনা রূপে আবির্ভূত হতে শুরু করেছে। শীতের ভরা মৌসুম ডিসেম্বর ও জানুয়ারি। শীতকাল হতদরিদ্র-ছিন্নমূল মানুষের জন্য যেন এক অভিশাপের নাম! শীতের সময় দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। বিশেষ করে প্রান্তিক এলাকার গরিব মানুষের সবচেয়ে বেশি কষ্ট পোহাতে হয়। তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে প্রায় ২ কোটিরও বেশি মানুষ। এর মধ্যে আবার অতিদারিদ্র্যের নিচে বাস করে প্রায় এক কোটির মতো মানুষ। মূলত গ্রামীণ এলাকায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি। বিপুলসংখ্যক গরিব মানুষের বিভিন্ন কারণে শীতকালে আবার কাজের সুযোগ কমে যায়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দুর্যোগ ও সমস্যার শিকার হয়ে খেটে খাওয়া মানুষের বিশাল একটা গোষ্ঠীর কাজের সুযোগ কমে গেছে। চরম মানবেতর জীবনযাপন করে থাকে এসব কর্মহীন শীতার্ত মানুষ। এছাড়া, রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। মূলত বস্তিতে ও ভাসমানভাবে বিভিন্ন এলাকায় শীতার্ত এসব মানুষের বাস। বাস্তবতা হলো, শীতের কবলে পড়ে ছিন্নমূল গরিব মানুষের অনেকে এ সময় মারা যায়। অনেক ছিন্নমূল শিশু শীতবস্ত্রের অভাবে খুব কষ্টে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। এমনকি শিশুরা শীত মৌসুমজনিত রোগে-শোকে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। শীত মৌসুমে দেশজুড়ে হাসপাতালগুলোতে গেলেই তা টের পাওয়া যায়।

শীতে জনজীবন জবুথবু হয়ে পড়ে। শীতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গরিব তথা খেটে খাওয়া মানুষ 'যম' বনে যাওয়া শীত মোকাবিলা করে অনেক সময় ঘরের বাইরে যেতে সাহস পায় না। উত্তরবঙ্গে তো বটেই, খোদ রাজধানী ও দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতে গৃহহীন মানুষ শীতের রাতে কোনো রকমে পরস্পরের উত্তাপ নিয়ে জড়াজড়ি করে নিশিযাপন করে থাকে। শহরের ফুটপাতে, উড়ালসড়কের নিচে, অলিতে-গলিতে, পার্ক-উদ্যানে অনেক মানুষ কোনো রকমে রাতযাপন করে। শীত সচ্ছল মানুষের কাছে পছন্দের ঋতু হলেও গরিব মানুষের কাছে যমদূতের সমান। কষ্ট ও ভোগান্তি ছাড়া শীত ঋতু গরিব মানুষের আর কিছুই দিতে পারে না! তাপমাত্রার পারদ যতই নিচের দিকে নামতে থাকে ততই শ্রমজীবী মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়তে থাকে। আবার তীব্র শীতে ঘন কুয়াশার কারণে নদীপথ, আকাশপথ ও সড়কপথে ঠিকমতো যানবাহন চলাচল করতে পারে না। অতিদারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করা মানুষের একটা বিরাট অংশ শিশু ও বৃদ্ধ। তাদের কাছে শীতকাল মানে এক আতঙ্কের নাম। শীত-ই একমাত্র ঋতু, যে ঋতুতে জনসাধারণকে আলাদাভাবে অর্থ খরচ করতে হয়! কেননা, শীতবস্ত্র না হলে টিকে থাকা দায়। এমনিতেই শীতের সময় অতিদরিদ্র পরিবারে ঠান্ডাজনিত রোগবালাই নতুন এক সমস্যা। শীতের কারণে ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশিসহ হৃদরোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। তীব্র শীতে কমবেশি প্রতিদিনই হাসপাতালে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর পাওয়া যায়। বিশেষ করে শিশুরা আক্রান্ত হয় সবচেয়ে বেশি। আবার শীতের প্রকোপ থেকে রেহাই পেতে আগুন পোহাতে গিয়ে অনেকে অসাবধানতাবশত দগ্ধ হওয়ার খবর আসে!

সত্যি কথা বলতে, ঋতুচক্রের গতি-প্রকৃতি আর আগের মতো নেই। আবহাওয়া দিনে দিনে চরমভাবাপন্ন হয়ে ওঠছে। কখনো প্রচন্ড গরম, আবার কখনো প্রচন্ড শীত। এই পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না ছিন্নমূল-গরিব মানুষ। শীতে প্রকৃতি আরও রুক্ষ রূপ ধারণ করে। প্রকৃতির উদাস সুর শীতার্তদের আরও কাবু করে ফেলে। অন্যভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, শীতকালে অতিথি পাখির আগমন প্রকৃতি-পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। আবার ভ্রমণের জন্যও উপযুক্ত সময় এই শীত ঋতু। যদিও ছিন্নমূল-গরিব মানুষের কাছে এসব মূল্যহীন! গরিব মানুষের পক্ষে খাদ্য ও স্বাভাবিক বস্ত্রের জোগান করা এমনিতেই কষ্টকর। তার ওপর আবার শীত বস্ত্রের উষ্ণতা পাওয়া সে তো বিলাসিতা! কিন্তু অন্য সব মানুষের মতো গরিব মানুষেরও শীতের সময় সুন্দরভাবে জীবনযাপন করার অধিকার আছে। এ ব্যাপারে সামর্থ্যবান যে কোনো মানুষ ও বিভিন্ন সংস্থার উচিত শীতার্ত মানুষের পাশে এগিয়ে আসা। দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বিত্তশালীদের শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়। নতুন কিংবা পুরনো পরিষ্কার শীতবস্ত্র, অল্প দামে বাজারে পাওয়া দেশি-বিদেশি শীতবস্ত্র দিয়ে শীতার্তদের সহায়তা করা যেতে পারে। কিংবা টাকা-পয়সা দিয়েও শীতার্তদের সহায়তা করা যেতে পারে। প্রতি বছর দেখা যায় শীতার্তদের সহায়তায় সরকার, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি উদ্যোগ, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। সম্মিলিত প্রচেষ্টা কখনো বৃথা যায় না। তাই শীত মৌসুমে শীতার্তদের কথা কখনো ভুলে গেলে চলবে না। শীতের প্রকোপ থেকে রেহাই দিতে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি হাসপাতালের মাধ্যমে শীতজনিত রোগের ওষুধ বিতরণের ব্যবস্থা থাকা উচিত। গরিব ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেক বিত্তবান ও সামর্থ্যবান মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। আসুন, সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে যার যার অবস্থান থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই শীতার্ত মানুষের প্রতি। এতে শীতার্তরা একটু হলেও উষ্ণতা পাবে, ভালো থাকবে।

সাধন সরকার :জলবায়ু ও পরিবেশকর্মী

সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে