মানুষের মন ও মননে, বইপুস্তক কিংবা অনুষ্ঠানে জাতীয় কবি হিসেবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে স্থায়ীভাবে গেজেটভুক্ত হয়েছে ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪। এতদিন কেন নজরুল 'জাতীয় কবি' হিসেবে গেজেটভুক্ত হয়নি- তার কোনো সদুত্তর নেই। তাই বলা যায়, নজরুলকে জাতীয় কবি হিসেবে মর্যাদা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করার ফলে বর্তমান সরকার উদারতা ও আন্তরিকতার জন্য প্রশংসা এবং ধন্যবাদ পাচ্ছেন। চব্বিশের গণ-অভু্যত্থানের স্স্নোগানই হচ্ছে, 'বৈষম্যহীন বাংলাদেশ'। নজরুলও চেয়েছেন বৈষম্যহীন পৃথিবী- জাতি ও সমাজ থেকে যাবতীয় অনাচার দূরীকরণ।
বৈষম্যমুক্তের প্রথম অগ্রাধিকারই হচ্ছে, আইন তার নিজের গতিতে চলবে। আইনকে প্রভাবিত করা যাবে না। কবি নজরুলের বিদ্রোহী স্বভাব কিন্তু সমাজের বিভিন্ন অনাচার, অন্যায্য, বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সমাজের নিচু স্তরের মানুষ সব সময় অবহেলিত হয়ে বৈষম্যের স্বীকার হয়ে থাকে। মানিকের মতোই 'ঈশ্বর থাকেন ভদ্র পলস্নীতে'। নজরুল বিভিন্ন অন্যায্য, অনিয়ম ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে উচ্চকিত। 'মানবতা' প্রতিষ্ঠিত করাও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার অন্যতম হাতিয়ার। সমাজের সব স্তরে মানবতা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী নজরুল ইসলামের মতো এত বড় মানবিক কবি বিশ্বে খুব কমই আছে। মানবতা প্রতিষ্ঠিত করতে কবিতা-গান-প্রবন্ধের পাশাপাশি তিনি সৈনিক হিসেবেও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি রুটির কারখানাতেও কাজ করেছেন। কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের পাশে থাকতেন সব সময়। অমানবিকতার বিভিন্ন অংশের বিরুদ্ধে তিনি ছিলে রক্তজবার মতো উজ্জ্বল প্রতিবাদী। 'সবার উপরে মানুষ সত্য'- এ উপলব্ধিকে প্রতিষ্ঠিত করতে কবি নজরুল কবিতায় লেখেন, 'গাহি সাম্যের গান/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ জাতি,/সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।' অথবা বলতে পারি, 'গাহি সাম্যের গান-/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চিয়ান।'(সাম্যবাদী কবিতা)। 'সাম্যবাদী' কাব্যের বীরাঙ্গনা, কুলি-মজুর, মানুষ, রাজা-প্রজা, নারী, পাপ, চোর-ডাকাত প্রভৃতি কবিতায় সাম্যবাদী নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। আর উচ্চারণে ছিল অগ্নিবর্ষা। প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করেছেন। 'নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই' অথবা 'পীড়িতের নাই জাতি ও ধর্ম, অধীন ভারতময়, তারা পরাধীন, তারা নিপীড়িত, এই এক পরিচয়' বলে স্বাধীনতা চেয়েছেন। শোষণ-পীড়িতের অবসান চেয়েছেন। 'একতাই বল' হিসেবে অগ্রসর হতে বলেছেন। ধর্মকে কেন্দ্র করে কোনো বিভাজন চাননি তিনি। বিভাজন থাকলে স্বাধীনতা বা অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়। কৃষকের চোখে নজরুল বলেছেন, 'আজ জাগরে কৃষান সব ত গেছে, কিসের বা আর ভয়,/এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সুধার জগৎ জয়'(কৃষানের গান)। এমন অভয় বাণী নজরুলের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব। নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য মিলিয়ে দেওয়া বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার অন্যতম অনুষঙ্গ। যে জাতিতে এ দু-ভাগের মধ্যে বৈষম্যের পার্থক্য কম সে জাতি ততই উন্নত। নজরুল নারীর পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট ও জোরালো। বিভিন্ন সম্প্রদায় ও ধর্ম-শ্রেণিপেশার মানুষ যতটা নির্বিঘ্নে চলাচল ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে সে রাষ্ট্র কিংবা জাতি ততটাই সভ্য। নজরুল সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমরণ লড়াই করেছেন। তাই তাকে সাম্যের কবি বলা হয়।
'মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান'- তিনি বাংলার হিন্দু-মুসলিমকে এক চোখে দেখেছেন। তিনি গজলের পাশাপাশি হিন্দুদের শ্যামাগীতি রচনা করেছেন। এমন সম্প্রীতির বন্ধনের চেষ্টা ও জনপ্রিয়তা বিশ্বের আর কোনো ব্যক্তি কিংবা সাহিত্যিকের নেই। এক্ষেত্রে নজরুল পুরোপুরি সফল। তাকে অসাম্প্রদায়িক কবি বলা হয়। বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি জড়িত। 'রমজানের ওই রোজার শেষে', কিংবা রণসঙ্গীত আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। নজরুল বর্তমানেও খুবই প্রাসঙ্গিক। তার জাতীয়তাবোধ, ধর্ম, বর্ণ, জাতিবিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে মনুষ্যত্বকে প্রাধান্য দেওয়ার উদার জীবনদর্শন, নতুন প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত জরুরি একটি পাঠ হতে পারে। আজকের পৃথিবীতে যখন মানুষ সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হতে হতে ক্রমশ ছোট হতে বসেছে। শেষ হতে বসেছে সম্প্রীতি, সমানুভাবের মতো বিষয়গুলো। ফলে, নতুন করে কাজী নজরুল প্রাসঙ্গিকতা এখনো আছে।
সামাজিক এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বা অসাম্প্রদায়িকতার মতো বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে সুস্থ পরিবেশ, দৃঢ় মানসিক গঠনের জন্য নজরুলকে সামনে আনা দরকার। স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামে আরও বেশি করে নজরুল ইসলামকে জানানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। কারণ তার অসাম্প্রদায়িকতার চেতনতার দৃঢ়তা আমাদের অনেক শিক্ষা দেয়। ১৯৭৫ সালেই তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করলে আরও ভালো হতো। এ ব্যর্থতা নজরুলের নয়, এ ব্যর্থতা আমাদেরই। যাহোক, দেরিতে হলেও কাজী নজরুল ইসলামকে 'জাতীয় কবি' হিসেবে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে, সেজন্য ইউনূস সরকারকে অভিবাদন।
আবু আফজাল সালেহ : কবি ও প্রাবন্ধিক