রোববার, ১১ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২

চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগিতায় আধিপত্যের লড়াই ও বৈশ্বিক প্রভাব

চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগিতা শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সারাবিশ্বে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমীকরণ বদলে দিচ্ছে। এ ধরনের প্রতিযোগিতার কারণে অন্যান্য দেশগুলোকে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
নুরুলস্নাহ আলম নুর
  ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগিতায় আধিপত্যের লড়াই ও বৈশ্বিক প্রভাব
চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগিতায় আধিপত্যের লড়াই ও বৈশ্বিক প্রভাব

বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান প্রতিযোগিতা এবং উত্তেজনা স্থান করে নিয়েছে। এই দুই পরাশক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব শক্তির আধিপত্য বিস্তারই নয়, বরং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্যও উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। প্রভাবশালী প্রযুক্তি, অর্থনীতি, সামরিক সক্ষমতা এবং কৌশলগত অবস্থান নিয়ে এই দ্বন্দ্বের জের বিশ্ব রাজনীতির চেহারাকে প্রতিনিয়ত নতুন মাত্রায় রূপান্তরিত করছে।

প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিশেষভাবে তীব্র। চীন বিশ্বব্যাপী তার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ক্ষমতা বিস্তার করতে চাইছে। হুয়াওয়ে এবং টিকটকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো চীনের প্রযুক্তিগত ক্ষমতার প্রমাণস্বরূপ। ৫জি নেটওয়ার্ক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এবং বিগ ডেটা ব্যবস্থাপনায় চীন শক্তিশালী অবস্থান দখল করতে চাইছে- যা চীনকে প্রযুক্তির দিক থেকে বিশ্ব নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পথে এগিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে চীনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। হুয়াওয়ে এবং টিকটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রতিযোগিতায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে।

চীনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি শুধু ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামরিক প্রযুক্তিতেও যুক্ত হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সামরিক রোবোটিক্সের মাধ্যমে চীন আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা রাখছে- যা ভবিষ্যতের যুদ্ধনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। এ ধরনের প্রযুক্তিগত আধিপত্য শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয়, বরং বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর জন্যও উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠছে।

আমরা জানি যে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধ ২০১৮ সালে শুরু হয়েছিল এবং এখনো তা চলমান। শুল্ক আরোপ, বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি এবং মুদ্রানীতি নিয়ে এই দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে। চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেছে- যা তাদের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে শক্তিশালী করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের অবকাঠামোগত প্রকল্প এবং ঋণ প্রদান কার্যক্রম বিশ্ব রাজনীতির নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে। চীনের এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে এবং তারা এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাদের বাণিজ্য নীতি পুনর্বিবেচনা করছে।

যুক্তরাষ্ট্র এই প্রতিযোগিতায় চীনের অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে সংযত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা চীনের অর্থনীতিতে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে, এতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে এবং অনেক দেশ এই বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব অনুভব করছে।

পাশাপাশি দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সামরিক ক্ষমতার বিস্তার নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা রয়েছে। এই সাগরে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং আন্তর্জাতিক নৌপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় চীন তার সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে নৌবাহিনী পাঠাচ্ছে এবং স্বাধীন নৌচলাচল অভিযান পরিচালনা করছে- যা চীনের প্রভাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার বার্তাই দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি চীন তার সামরিক প্রভাব বাড়িয়ে তোলে, তবে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলবে।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগিতা শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সারাবিশ্বে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমীকরণ বদলে দিচ্ছে। এ ধরনের প্রতিযোগিতার কারণে অন্যান্য দেশগুলোকে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।

বিশ্ব এখন এমন একটি সময়ের মধ্যে রয়েছে, যেখানে পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা ভবিষ্যতের রাজনীতি এবং অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে। এই প্রতিযোগিতার পরিণতি সারা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব কি নতুন কোনো স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাবে, নাকি বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে তা এখন সময়ের ব্যাপার। তবে, এ প্রতিযোগিতার গতি-প্রকৃতি সারাবিশ্বকে চিন্তা করতে বাধ্য করছে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ আনছে।

নুরুলস্নাহ আলম নুর : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে