বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা মীর আব্দুল আলীম

রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জনগণের আস্থা এবং সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কারের প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হতে পারে। তবে, রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ এবং সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে যদি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনগণের স্বার্থে কাজ করা হয়, তবে বাংলাদেশে সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
মীর আব্দুল আলীম
  ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা মীর আব্দুল আলীম
গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা মীর আব্দুল আলীম

ড. ইউনূস সরকার নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে এই আলোর পূর্ণ প্রতিফলন ঘটাতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা জরুরি। জাতির স্বার্থে ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থ ত্যাগ করে, সরকারকে সঠিকভাবে সহায়তা করা আজ সময়ের দাবি। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কার, প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং আইনগত পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব সংস্কারের বাস্তবায়ন কখনো সহজ হয়নি। দেশের শাসন কাঠামো ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে যে সংস্কারের প্রস্তাবনা চলমান সময়ে উঠে এসেছে, তা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং কার্যকর শাসন ব্যবস্থার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। সম্প্রতি চারটি সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশসংবলিত রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করেছেন, যা রাষ্ট্র কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব সংস্কারের বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব? এর জন্য কি রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন প্রয়োজন, নাকি এটি কেবল বর্তমান সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল? এসব প্রশ্নের উত্তর দেশের ভবিষ্যৎ জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

জাতীয় স্বার্থে ড. ইউনূস সরকারের প্রতি সহযোগিতা প্রয়োজন :বাংলাদেশ বর্তমানে এক জটিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। এই সংকটময় সময়ে ড. ইউনূস সরকার পরিপূর্ণ সংস্কারের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তবে সরকার যে সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে চলেছে, তা পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা অপরিহার্য। ড. ইউনূস সরকার দেশের রাজনীতিকে একটি স্থিতিশীল পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পরিপূর্ণ সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা শুধু দেশের গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করবে না, বরং অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ তৈরি করবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি বড় অংশ দ্রম্নত নির্বাচন চায়। এই চাহিদার মধ্যে অনেক যুক্তি থাকলেও, দীর্ঘমেয়াদে একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকারের পরিপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগকে সময় দেওয়া উচিত। বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হলো জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সরকারকে সহযোগিতা করা।

সহযোগিতার অভাব ও প্রভাব :দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু রাজনৈতিক দল সরকারের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করছে। সহযোগিতা যদি জোরালো হতো, তবে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং রাজনীতিতে শৃঙ্খলা আনার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হতো। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসন এবং গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ অপরিহার্য। ড. ইউনূস সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা এ লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় হবে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার দ্রম্নততর হবে। রাজনীতিতে পারস্পরিক আস্থা ও সম্মান বৃদ্ধি পাবে।

জাতীয় ঐক্য আলোর মুখ দেখাচ্ছে এক নতুন সম্ভাবনা :জাতীয় ঐক্য কোনো জাতির জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি, যা ভিন্নমত পোষণকারী রাজনৈতিক দল, সামাজিকগোষ্ঠী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহযোগিতার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এটি শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই নয়, বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির দিকেও একটি জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐক্যের অগ্রগতি আলোর মুখ দেখাচ্ছে, যা দেশের সংকট উত্তরণের পাশাপাশি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিভাজন, মতপার্থক্য এবং সংকটের কারণে জাতি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি শুধু জাতীয় উন্নয়নকে ব্যাহত করেছে তা নয়, বরং সামাজিক ভাঙনের ঝুঁকিও বাড়িয়েছে। জাতীয় ঐক্য এই বিভেদকে দূর করে একটি সুষম, শক্তিশালী ও টেকসই সমাজ গড়ে তোলার পথ উন্মোচন করতে পারে। বিশ্বজুড়ে উদাহরণ রয়েছে যে, জাতীয় ঐক্য কেবলই সংকট মোকাবিলায় নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে উন্নত রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখে। যেমন- দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যের পর ঐক্যবদ্ধ রাজনীতি একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। একইভাবে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও জাতীয় ঐক্য নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করতে পারে।

জাতীয় ঐক্যের পথে চ্যালেঞ্জ :জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা সহজ নয়। দলীয় স্বার্থ, মতপার্থক্য এবং ক্ষমতার লড়াই জাতীয় ঐক্যের পথে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া কিছু গোষ্ঠীর ইচ্ছাকৃত বিভেদ সৃষ্টির প্রবণতাও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে পারে। তবে জনগণের চাহিদা এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি দলগুলোকে এই বাধা অতিক্রম করতে অনুপ্রাণিত করছে। জাতীয় ঐক্য একটি জাতির উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। এটি শুধু বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে নয়, বরং একটি স্থায়ী সমৃদ্ধি ও উন্নত ভবিষ্যতের জন্য ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক। একমাত্র সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পারব। তাই জাতীয় ঐক্যের এই আলোকিত পথ যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়, সেটাই আমাদের সবার কাম্য। তবে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকট মুহূর্তে সংস্কারের কোনো বিকল্প নাই। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে সে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

সংস্কারের প্রস্তাবনা এবং তার গুরুত্ব :সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশে একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দিয়েছে, যেখানে রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য নানা দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দু'টি মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এটি সাংবিধানিক পরিবর্তনের দাবি রাখে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস হবে, অন্যদিকে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং অন্যান্য প্রশাসনিক সংস্কারের প্রস্তাবনা দেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ এবং সুশাসনের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে। যদিও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। সরকারি ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কার্যকরী সংস্কার প্রয়োজন। এসব সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং কার্যকর আইনগত ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনৈতিক দলের ভূমিকা এবং বিতর্ক : রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের প্রস্তাবনাকে নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এছাড়া, কিছু বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সংস্কার প্রস্তাবনার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। যেমন- দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম বলেছেন, 'প্রতিবেদনটি ভালো মনে হয়েছে, তবে এর বাস্তবায়ন সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।' অতীতে অনেক সংস্কার কমিশন তৈরি হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ সময়েই রাজনৈতিক বিভাজন এবং শাসন কাঠামোর দুর্বলতার কারণে তারা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, '৯০-এর গণ-অভু্যত্থানের পর তিনটি রাজনৈতিক জোটের রূপরেখা মেনে ৩৬টি কমিশন গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু তার পরেও কোনো উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি।

দুর্নীতি দমন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা :বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক। বিভিন্ন সময়ে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দুর্নীতি দমন করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে তা কার্যকর হয়নি। দুর্নীতি দমন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যদি দীর্ঘমেয়াদি ফলপ্রসূ পরিবর্তন চান, তবে সংশ্লিষ্ট আইনি কাঠামোকে পুনর্গঠন করা দরকার। বর্তমানে জনগণ এবং সরকার-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা দুর্নীতি দমনের পথে অন্যতম বাধা। দুর্নীতি নির্মূলের জন্য বর্তমান সরকারকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে এবং সেইসঙ্গে সংসদ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে সুসমন্বয় তৈরি করতে হবে। এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে কার্যকরী হতে হলে, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে একযোগে কাজ করা এবং সমঝোতার মাধ্যমেই সম্ভব।

সংস্কার বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ :যেহেতু সংস্কারের জন্য সাংবিধানিক পরিবর্তন প্রয়োজন, তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দলীয় মতপার্থক্য সংস্কারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ থেকে যে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, তা সংস্কারের প্রস্তাব বাস্তবায়নে বড় ধরনের প্রতিবন্ধক হতে পারে। অতীতে, ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় ১২২টি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, যার মধ্যে অনেকগুলো পরবর্তীতে বাতিল হয়ে গেছে। সে সময় সরকার একাধিক অধ্যাদেশ জারি করলেও, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ এবং সমঝোতার অভাব ছিল। এছাড়া, একটি সংস্কার পরিকল্পনা কখনো সফল হয় না যদি তাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থাকে। অর্থাৎ, সরকার যে ধরনের সংস্কার প্রস্তাব করেছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবেই শুধু জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

পরিশেষে, বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রশাসনিক সংস্কার বাস্তবায়ন কেবল সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্জন করা সম্ভব। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জনগণের আস্থা এবং সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কারের প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হতে পারে। তবে, রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ এবং সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে যদি ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনগণের স্বার্থে কাজ করা হয়, তবে বাংলাদেশে সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

মীর আব্দুল আলীম : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে